রিচার্ড বেল কোরআনের বিন্যাসের প্রশ্নে ইসলামের প্রমাণপঞ্জীকে উপেক্ষা ও প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি নিজের মাথায় বিন্যস্ত বিন্যাসকে কোরআনের উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। যা শুধু অনুচিত বা অনৈতিক নয়, বরং অবজ্ঞাপূর্ণও বটে। নিজের পছন্দকে তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন কোরআনের আয়াতের উপর। যেন কোরআনের সম্পাদকের টেবিলের কাটাকুটির খসড়া। যেন তিনিই বুঝতে পেরেছেন কোরআনকে আসলে কীভাবে সাজানো উচিত। ফলে তিনি আয়াতসমূহের উপর কাচি চালিয়েছেন। এখানে তার একরৈখিক নাবালকত্ব যেন ফুটে উঠেছে বার বার। আমরা দেখেছি সুরা বাকারার আয়াতে আয়াতে কী গভীর ও সূক্ষ্ম যোগসূত্র। কিন্তু রিচার্ড বেল কোনো যোগসূত্র খুঁজে না পেয়ে আয়াতসমূহে সম্পাদনার কাচি চালাতে শুরু করেন। যেমন সুরা বাকারার ২০ থেকে ২২ নং আয়াত সম্পর্কে তিনি লিখেছেন যে, এই আয়াতসমূহের আলোচনা সূরা বাকারার ১৮ নম্বর আয়াতেই পূর্ণতা পেয়ে গেছে। আয়াতটি হলো- ‘ তারা বধির-মূক-অন্ধ। তাই তারা ফিরে আসবে না।’ বেলের মনে হয়েছে ১৮ নম্বর আয়াতেই যা পূর্ণ হয়ে গেছে, সে বিষয়কে আর সামনে বাড়ানোর কী দরকার ছিল? অতএব, ১৯ নম্বর আয়াত বাড়ানোর কোনো দরকার ছিল না। আয়াতটি হলো- অথবা যেমন আকাশের বর্ষণমুখর মেঘ, যাতে আছে গাঢ় অন্ধকার, বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুৎ চমক, বজ্রধ্বনিতে মৃত্যু ভয়ে তারা তাদের কানে আঙুল ঢুকিয়ে দেয়। আল্লাহ কাফেরদের পরিবেষ্টন করে আছেন। অথচ ১৮ নম্বর আয়াতে উগ্র ও চূড়ান্ত হটকারি মুনাফিকদের ব্যাপারে সর্বশেষ ফলাফল জানানো হচ্ছে, যারা সত্যের সঙ্গে ঔদ্ধত্যে ও প্রতারণায় ব্যাপারে সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু তাদের স্বরূপ কেমন? তাদের কর্মকাণ্ডের সারবস্তু ও ফলাফল কেমন? তাদের মানসিক প্রকৃতি ও আচার-আচরণের স্বভাব কেমন? মহান আল্লাহ তাদের সঙ্গে আচরণের কোনো নীতি অবলম্বন করছেন? ইত্যাদি বিষয় অত্যন্ত জরুরি, যা আল্লাহর প্রজ্ঞাভাষ্যে উপস্থাপিত হয়েছে ১৯ নম্বর আয়াতে।
রিচার্ড বেল এখানে নিজের অজ্ঞতার প্রতি মোটেও সচেতন নন। সচেতন হলে এমন গুরুতর দাবির আগে তার জানা উচিত ছিল, উল্লেখিত আয়াতসমূহের বিষয় সম্পর্কে তার অনুমান আগাগোড়া ভুল। বেল খুঁজে পাচ্ছেন না সূরা বাকারার ১৯ নম্বর আয়াতের যুক্তি। তার মতে ১৮ নম্বর আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পরে ১৯ নম্বর আয়াত এখানে থাকতে পারে না। আবার ১৮ ও ১৯ নম্বর আয়াতে যেহেতু মুনাফিকদের আলোচনা হয়েই গেছে, তাহলে ২০ নম্বর আয়াতে আবার কেন মুনাফিকদের আলাপ? আয়াতটিতে ইরশাদ হয়েছে- বিদ্যুৎচমক তাদের দৃষ্টিশক্তি প্রায় কেড়ে নেয়, যখনই বিদ্যুৎচমক তাদের সামনে প্রকাশিত হয়, তখনই তারা পথ চলতে থাকে এবং যখন তাদের উপর অন্ধকার ছেয়ে যায়, তখন তারা থমকে দাঁড়ায়, আল্লাহ ইচ্ছে করলে তাদের শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি হরণ করতে পারতেন, আল্লাহ সববিষয়ে সর্বশক্তিমান। আগের আয়াতগুলো থেকে এ আয়াতের বিষয় ও প্রকৃতি একদমই আলাদা। কারণ আগের আয়াতে মুনাফিকদের যে শ্রেণির কথা এসেছে, এখানে তাদের আলোচনার পুনরাবৃত্তি করা হয়নি। বরং এখানে মুনাফিকদের স্বতন্ত্র একটি দলের কথা বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সাধারণ পাঠকও জানেন যে, সূরা বাকারার প্রথম থেকে এ পর্যন্ত মানুষকে কয়েক শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এক. খাঁটি মুমিন। সূরা আল-বাকারার প্রথম চার আয়াতে তাদের পরিচয় দেয়া হয়েছে। দুই. খাঁটি কাফের। তাদের বর্ণনা পরবর্তী সময়ে দুই আয়াতে প্রদত্ত হয়েছে। তিন. মুনাফিক, যারা আবার দুই শ্রেণির। প্রথম. খাঁটি মুনাফেক। আগুন জ্বালানোর উপমা দিয়ে তাদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয়, সন্দেহের দোলায় দোদুল্যমান মুনাফেক। তারা কখনো ঈমানের আলোকে আলোকিত হয়, কখনো কুফরীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। বজ্র ও বিদ্যুতের উদাহরণ পেশ করে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথম দলের অবস্থা থেকে তাদের মুনাফেকী একটু নরম। ২০ নম্বর আয়াতে সেই শ্রেণীরই বিবরণ এসেছে। যাদের সামনে কখনো সত্য পরিষ্কার হয়ে যায়, আবার কখনো তারা এ ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যে নিমজ্জিত থাকে। কাজেই তাদের সন্দিগ্ধ ও সংশয়ী অন্তর হল সেই বৃষ্টির ন্যায় যা অন্ধকারে বর্ষিত হয়; এর গর্জন ও চমকে তাদের অন্তর ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে; এমনকি ভয়ের কারণে নিজেদের আঙ্গুলগুলো কানের মধ্যে গুঁজে দেয়। কিন্তু এই ব্যবস্থাপনা এবং ভয়-ভীতি তাদের আল্লাহর পাকড়াও থেকে বঁচাতে পারবে না। কেন না, তারা আল্লাহর বেষ্টনীর মধ্য থেকে বের হতে পারবে না। কখনো সত্যের কিরণ তাদের উপর পড়লে তারা তার প্রতি ঝুঁকে পড়ে; কিন্তু আবার যখন ইসলাম ও মুসলিমদের উপর কঠিন সময় আসে, তখন তারা উদভ্রান্ত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। (ইবনে কাসীর) মুনাফিক্বদের এ দল শেষ পর্যন্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সন্দেহ সংশয়ের শিকার হয়ে সত্য গ্রহণ করা থেকে বঞ্চিতই থেকে যায়।
এভাবেই কোরআনের আয়াতে আয়াতে তদন্ত করেছেন রিচার্ড বেল। নিজস্ব অজ্ঞতা, অবজ্ঞা ও ফ্যালাসির ওপর ভর করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, কোন আয়াত কোথায় থাকা উচিত নয়, কোন সূরা কোথায় গিয়ে শেষ হওয়া উচিত ছিল, কোন প্রসঙ্গ কতটুকু বলা উচিত ছিল আর কতটুকু অতিরিক্ত বলা হয়েছে। এর বিবিধ নমুনা ছড়িয়ে আছে তার গ্রন্থের নানা অংশে।
খোদার ওপর রিচার্ড বেলের এই খুদকারির যুক্তি কী? তার যুক্তি হলো আধুনিক লিখন-পদ্ধতিতে বিষয়ের ধারাবাহিকতা থাকা জরুরি। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথাও যদি অপ্রাসঙ্গিক হয়, তাহলে ওই কথাকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত, অথবা টিকা টিপ্পনীতে লেখা উচিত। কিন্তু রিচার্ড বেল এই দিকটি এড়িয়ে গেছেন যে, বর্তমান যুগের লিখন-পদ্ধতি যুগের পর যুগের লিখন-পদ্ধতিসমূহের সমন্বয়ের একটি ফলাফল মাত্র। তার প্রস্তাবিত পদ্ধতি প্রচলিত পদ্ধতি বটে। কিন্তু এটাই যে সর্বোত্তম পদ্ধতি, এর অকাট্য প্রমাণ কী? এটি শুধু আমাদের যুগেরই গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। অতীতে নানারকম প্রকাশ পদ্ধতি ছিল, আর ভবিষ্যতেও জন্ম নেবে বহু পদ্ধতি। কিন্তু কোরআনের প্রকাশ ও বিন্যাস পদ্ধতি কোনো পদ্ধতির শাসনাধীন নয়। প্রতিটি যুগের সর্বাধুনিক পদ্ধতি তার বিন্যাসরীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। যদিও এই ক্ষমতা মানবীয় প্রতিভার আওতাধীন নয়। কারণ কোরআনের সব কিছুতেই মুজিজার প্রতিফলন রয়েছে। আমরা যদি আধুনিক বিন্যাস পদ্ধতির দিকে তাকাই, তাহলে কোরআনে কি এর প্রয়োগ দেখি না? বস্তুত বেলের প্রস্তাবিত ও প্রচলিত রীতির তুলনায় কোরআনের বিন্যাস পদ্ধতি অনেক বেশি সূক্ষ্ম, আধুনিক, অলৌকিক ও তাৎপর্যমণ্ডিত।
কোরআনের বিন্যাসের বৈজ্ঞানিক বিস্ময় : Circular Formation Arrangement বা বৃত্তাকার গঠনবিন্যাস আধুনিক বিশ্বের অগ্রসর ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এ ধরনের বিন্যাস বস্তুসমূহের আপেক্ষিক অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। আল কোরআন আয়াত ও বিষয়গুলো একটি রেখা বা সারি বরাবর বিভিন্ন রকমভাবে বিন্যাস করেনি। এমন বিন্যাসও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মধ্যে পড়ে এবং তাকে রৈখিক বিন্যাস (Linear Permutation) বলা হয়। এই বিন্যাস সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। রিচার্ড বেল কোরআনের মধ্যে এই বিন্যাস পাচ্ছেন না বলেই আপত্তিমুখর। তিনি ভাবতেও পারছেন না আল কোরআনে প্রচলিত প্রক্রিয়ার চেয়ে অধিকতরো সূক্ষ্মবিন্যাস প্রক্রিয়া কীভাবে অবলম্বন করা হয়েছে! বস্তুত এমন বিন্যাসের উদাহরণ হিসেবে হাজির করা যেতে পারে কোরআনের সবচেয়ে বড় সূরা আল বাকারা। সূরাটিতে আছে ২৮৬ আয়াত। বিষয়ের বিচারে পুরো সূরাকে ৯টি অংশে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ভাগে আলোচিত হয়েছে বিশ্বাস ও অবিশ্বাস। সূরাটির শেষ ভাগেও একই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, যে অংশকে নবম ভাগ হিসেবে স্থির করা যায়। ২য় অংশে আলোচিত হয়েছে সৃষ্টি রহস্য এবং জ্ঞান নিয়ে, যার প্রতিফলন হয়েছে শেষ থেকে ২য় অর্থাৎ ৮ম অংশে। ৩য় অংশে আছে, সেইসব আইন যা বনি ইসরাইলকে দেয়া হয়েছিল। যার প্রতিফলন হয়েছে ৭ম অংশে, যেখানে আছে মুসলিমদের দেয়া আইনগুলো। ৪র্থ অংশে আছে ইব্রাহিম (আ.)-এর পরীক্ষাগুলো, যার প্রতিফলন হলো মুসলিমদের জন্যও পরীক্ষা, যা হলো ষষ্ঠ অংশের বিষয়। আর মাঝের অংশ অর্থাৎ ৫ম অংশটি হলো পুরো সূরাটির মুখ্য আলোচনা, সালাতের কেবলার দিক পরিবর্তন। ‘এমনিভাবে আমি তোমাদের মধ্যপন্থি সম্প্রদায় করেছি, যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবম-লীর জন্য। আপনি যে কেবলার উপর ছিলেন, তাকে আমি এজন্যই কেবলা করেছিলাম, যাতে একথা প্রতীয়মান হয় যে, কে রাসূলের অনুসারী থাকে, আর কে পিঠটান দেয়।’ (আল কোরআন ২ : ১৪৩) এই কেবলার পরিবর্তন, যা ছিল জেরুজালেম থেকে মক্কার দিকে, এটি ছিল আসলে বিশ্বাসীদের জন্যও এক বিরাট পরীক্ষা। আর এই ঘুরে দাঁড়ানোর উল্লেখ আমরা দেখতে পাই, সুরাটির ঠিক মধ্যম অংশে। ঠিক ১৪৩তম আয়াতে। আরো উল্লেখ্য হলো এই আয়াতেই আছে ‘মধ্যপন্থি সম্প্রদায়’ শব্দটি।
নোমান আলী খান দেখান, ‘এই ৯টি অংশ একসঙ্গে একটি বিশাল বৃত্তাকারবিন্যাস গঠন করে। খুব সহজেই দেখা যাচ্ছে, যে এই বৃত্তাকার বিন্যাসটি হলো একটি পূর্ণবৃত্ত যার মূল অর্থটি আছে-এর কেন্দ্রে। আপনারা একে আয়নার প্রতিফলনের মতোও ভাবতে পারেন, যেখানে আয়নাটি আছে বৃত্তের ঠিক মাঝে। যেখানে প্রথম পাশে যা বলা হয়েছে তা দ্বিতীয় পাশে প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা যদি আরো ভেতরে তাকাই, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে, প্রতিটি অংশের ভেতরে আবার একটি করে নিজস্ব বৃত্তাকারবিন্যাস আছে। তার মানে দেখা যাচ্ছে, একটি মূল বৃত্তটি আসলে অনেকগুলো বৃত্তের সমন্বয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ৮ম অংশের কথা, যার বিষয় হলো আল্লাহর সৃষ্টি এবং জ্ঞান। আমরা দেখতে পাই যে এই অংশটির শুরু এবং শেষের বিষয় হলো দানশীলতা, আর আল্লাহর ক্ষমতা এবং জ্ঞান হলো-এর কেন্দ্রীয় বিষয়। একে আরো গভীরভাবেও দেখা যায়।’ (চলবে)