বন্ধু সবার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বন্ধুত্বের পবিত্র সম্পর্ক নির্ভরতা, সহযোগিতা ও ভালোবাসার সমন্বয়ে গঠিত। একাকিত্ব নিরসন কিংবা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আদর্শ বন্ধুর কোনো বিকল্প নেই। ইসলাম বন্ধু নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা দিয়েছে। এখানে নারী-পুরুষের বন্ধুত্বের বিধান নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব : ইসলামে নারী-পুরুষকে পরস্পরের কাছে আসার কিংবা বন্ধুত্বের অটুট বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য বিয়ের বিধান দিয়েছে। বিবাহবহির্ভূত সমাজে প্রচলিত নারী-পুরুষের বন্ধুত্বের সম্পর্ক একেবারেই হারাম। কারণ এতে পর্দার বিধান লঙ্ঘন করা হয়। নারীর কণ্ঠও পর্দা। ফোনালাপে বা প্রেমালাপে সে পর্দাও রক্ষিত হয় না। বিবাহবহির্ভূত বন্ধুত্বের জের ধরে সমাজে ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত নানা ঘটনা। তাই বিয়ের সম্পর্ক ছাড়া অপরিচিত গায়রে মাহরম নারীর সঙ্গে কোনো পুরুষের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভীষণ ক্ষতিকর। এ জন্যই ইসলাম এ বিষয়ে কঠোরতা আরোপ করেছে। নারী-পুরুষের দেখা-সাক্ষাতের সীমারেখা নির্ণয় করে দিয়েছে। কোরআন বলে ১৪ জন ব্যতীত নারী-পুরুষের জন্য অন্য কারো সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ বৈধ নয়।
আল্লাহপাক বলেন, মোমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহতায়ালা অবহিত আছেন। ঈমানদার নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। (সুরা নুর : ৩০-৩১) বন্ধুত্ব স্থাপন তো দূরের বিষয় একান্ত প্রয়োজন ছাড়া নারী-পুরুষ পরস্পরকে দেখাও শরিয়তে নিষিদ্ধ। অনিচ্ছাকৃত হঠাৎ দৃষ্টি পড়া সম্পর্কে হজরত আলী (রা.) রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞেস করেন। রাসুল (সা.) বলেন, হে আলী! অনাকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টি পড়ে গেলে পুনরায় তুমি দৃষ্টি দিও না। কেন না, প্রথম দৃষ্টি তোমার জন্য ক্ষমাযোগ্য; কিন্তু পুনরায় দৃষ্টিপাত করা তোমার জন্য ক্ষমাযোগ্য নয়। (তিরমিজি : ২৭৭৭)। চলার পথে নারীর প্রতি দৃষ্টি পড়তে পারে। দৃষ্টি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ তার দৃষ্টি নত করবে। ফিরিয়ে নিবে। বার বার তাকাবে না। বার বার তাকানো পাপ। হাদিস থেকে এ কথাই বুঝা যায়।
অনলাইন বন্ধুত্বের স্বরূপ : অনলাইন বন্ধুত্ব আর সত্যিকারের বন্ধুত্বের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান। ফেসবুকের বন্ধুত্ব মূলত একটি পদ্ধতিগত বাহ্যিক রূপ। বাস্তবতার সঙ্গে-এর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে অনেক সময় তা সত্যিকার বন্ধুত্বের রূপ নেয়। অফলাইনে নারী-পুরুষ পরস্পরকে দেখা এবং অনর্থক কথা বলা যেমন নিষিদ্ধ অনলাইনের বিধানও তাই। অনলাইনে বেগানা নারীদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা বলা, দ্বীনি দাওয়াত দেওয়া জায়েজ থাকলেও আকৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকলে কথা বলা বৈধ নয়। ছবি আদান-প্রদান করা কিংবা চ্যাটিং করাও বৈধ নয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেছেন, আদম সন্তানের ওপর জিনার যে অংশ লিপিবদ্ধ আছে, তা অবশ্যই সে প্রাপ্ত হবে। দু’চোখের জিনা হলো দৃষ্টিপাত করা, দুই কানের জিনা হলো শ্রবণ করা, জিহবার জিনা হলো কথোপকথন, হাতের জিনা হলো স্পর্শ করা, পায়ের জিনা হলো হেঁটে যাওয়া, অন্তরের জিনা হলো আকৃষ্ট ও বাসনা করা, আর লজ্জাস্থান তা বাস্তবায়িত করে এবং মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। (মুসলিম : ৬৫১৩, মুসনাদে আহমাদ : ৮৯৩২)।
বিয়ের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব : বিয়ের আগ পর্যন্ত ছেলে মেয়ে পরস্পর অপরিচিত। বন্ধুত্বের স্লোগান তোলা ছেলেটি চুটিয়ে প্রেম করা শেষে অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারে আবার ওই মেয়েটি ইচ্ছা করলেও অন্য কোনো ছেলেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। অতএব, বিয়ের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব করাও হারাম। বিয়ের প্রয়োজন বোধ করলে সরাসরি পারিবারিকভাবে বিয়ে করাই উত্তম। যাতে করে পরবর্তী সময়ে কোনো প্রকার সমস্যা না হয়। সেই সঙ্গে সম্পর্কটি ভেঙে না যায়। বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছাড়াও বিয়ের কথাবার্তা হওয়া অবস্থায় ছেলেমেয়ে একসঙ্গে শপিং করতে যাওয়া, পার্কে বা রেস্টুরেন্টে যাওয়া নিষিদ্ধ।
হজরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী কারিম (সা.)বলেছেন, কোনো পুরুষ অপর (বিয়ে বৈধ এমন) নারীর সঙ্গে নিঃসঙ্গে দেখা হলে শয়তান সেখানে তৃতীয়জন হিসেবে উপস্থিত হয়। (তিরমিজি : ১১৭১)।
নারী-পুরুষ বিয়ের উপযুক্ত হলেই অভিভাবকদের উচিত দ্রুত তাদের বিয়েসম্পন্ন করে দেওয়া। সম্বন্ধের আলোচনাকে অনর্থক দীর্ঘায়িত না করা। হজরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেন, হে আলী! তিনটি বিষয়ে বিলম্ব করবে না। যখন নামাজের ওয়াক্ত হয়ে যায়, যখন জানাজা উপস্থিত হয়, যখন অবিবাহিতাদের বিয়ের সমমানের সম্বন্ধ পাওয়া যায়। (তিরমিজি : ১০৭৫)।
হিন্দু মুসলিম বন্ধুত্ব : হিন্দু ও মুসলিম যার যার ধর্ম পালন করবে। যার যার ধর্ম মতে জীবনযাপন করবে, বিয়ে করবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো হিন্দু পুরুষ মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করা বা কোনো মুসলিম মেয়ে হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করা। বিয়ের আগে প্রেম করা সবই ইসলামে নিষিদ্ধ। কোনো মুসলিমণ্ডঅমুসলিমকে বিয়ে করলে, সে উত্তম থেকে অনুত্তমের দিকে ধাবিত হলো। ঈমান ছেড়ে শিরকের দিকে গেল। এটা ধর্মীয় পতন। যে বন্ধুত্ব নিজের ঈমানকে নষ্ট করে দেয়, সে বন্ধুত্ব বর্জনীয়। হিন্দু মুসলিম নিজ নিজ ধর্মে থেকে একে অপরের প্রতি সহমর্মী হবে, মানবিক হবে। এটা সামাজিকতা। ধর্মের সৌন্দর্য। তাই বলে স্বকীয়তা বর্জন করে বন্ধুত্ব রক্ষার কথা ইসলাম সমর্থন করে না। ঈমান ছেড়ে কুফর অবলম্বন করতে হয়, এমন বন্ধুত্ব ইসলাম সমর্থন করে না।
লেখক : কবি ও শিক্ষক