রিচার্ড বেলের কোরআন গবেষণা : খোদার ওপর খুদকারী

মুসা আল হাফিজ

প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

নোমান আলী খানের ভাষ্য হলো- ‘এই কেন্দ্রীয় বিষয়টিও আসলে একটি বৃত্তাকার বিন্যাস। যা হলো আয়াত নম্বর-২৫৫, আয়াতুল কুরসি। সিংহাসনের আয়াত। পুরো সুরাটির মতো এই সিংহাসনের আয়াতটিকেও ৯টি অংশে ভাগ করা যায়- বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে। ১ম এবং ৯ম অংশে আছে আল্লাহর গুণবাচক নাম। ২য় এবং ৮ম অংশে বলা হয়েছে, আল্লাহ কখনও ক্লান্ত হন না। ৩য় এবং ৭ম অংশে আছে, আসমান ও জমিনের সবই আল্লাহর অধীনে। ৪র্থ এবং ৬ষ্ঠ অংশে আছে, যে আল্লাহ আমাদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখেন এবং আমরা তার কাছেই মুখাপেক্ষী। লক্ষ্য করুন, মাঝের অংশে আছে আগে এবং পিছে এই শব্দ দুটি। যা আরো একবার বৃত্তাকার বিন্যাসের নির্দেশনা দিচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, সিংহাসনের আয়াতটি শুধু নিজেই বৃত্তাকারে বিন্যস্ত নয়, বরং এটি আরো দুটি বৃত্তের উপবৃত্ত। যারা হলো সমকেন্দ্রিক। আমরা দেখতেই পাচ্ছি যে, এই সুরাটি বিস্ময়করভাবে বিন্যস্ত। খুবই সূক্ষ্ম এবং বিশুদ্ধভাবে এই বৃত্তাকার বিন্যাসটি গঠিত হয়েছে।’

এই বিন্যাসের বিস্ময়কর আবেদন ও নির্ভুলতা স্পষ্ট করার জন্য অবতরণের সময় ও প্রেক্ষাপটের বিচার অত্যন্ত জরুরি। বিষয়টাকে বুঝানোর জন্য নোমান আলী খান একটি দালান তৈরির উদাহরণ হাজির করেছেন। তার দীর্ঘ উদ্ধৃতি গোটাবিষয়কে সুন্দরভাবে খোলাসা করবে। খান লিখেন- ‘মনে করুন যে আপনাকে একটি বাসা বানানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আপনি সকল উপকরণ সংগ্রহ না করে এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা না করে বরং আপনি কাজ শুরু করে দিলেন এর সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান ছাড়াই। একটির সঙ্গে আরেক টুকরোজুড়ে দিলেন, হাতের কাছে যা পেলেন তা দিয়েই। এটার সম্ভাবনা কতটুকু যে এই পদ্ধতিতে আপনি একটি ভালো বাড়ি বানাতে পারবেন? একটি পরিকল্পিত পদ্ধতি যেখানে সকল উপাদানের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত হয়েছে, তার বদলে এখানে মনে হচ্ছে যেনতেনভাবে যখন যেটা হাতের কাছে ছিল, তাই দিয়ে কাজ সারা হয়েছে। এমন অবস্থায় খুব সম্ভবত বাড়িটি হবে খুবই অপরিকল্পিত। যা যেকোনো সময় ধসে যেতে পারে। এর সম্ভাবনা নেই বলেই চলে যে, এই অপরিকল্পিত পদ্ধতিতে যে ফলাফল পাওয়া যাবে, তা সুপরিকল্পিত বাড়িটির মতোই চমৎকার হবে। কিন্তু আমরা কোরআনের গঠনের দিকে তাকালে ঠিক এই পদ্ধতিটি দেখতে পাই। আমাদের উদাহরণে যিনি বাড়িটি বানাচ্ছেন তিনি হলেন মহানবী (সা.), যে বাড়িটি বানানো হচ্ছে তা হলো কোরআন। আর বাড়িটির ঘর এবং ইট হলো কোরআনের সুরা এবং আয়াত। নবী (সা.)-এর পক্ষে কখনই সুপরিকল্পিতভাবে এটা করা সম্ভব ছিল না, কারণ অনেক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। যা ছিল তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেমন বিভিন্ন সামাজিক পরিবর্তন এবং চ্যালেঞ্জ যা তিনি নবুয়তের সময় সম্মুখীন হয়েছেন। এর উদাহরণ হলো, বিশ্বাসীরা তার কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে আসত, অথবা শত্রুরা আসত চ্যালেঞ্জ নিয়ে। এর উত্তর অবতীর্ণ হত তার ওপর অহি আকারে, যাতে বলা থাকত সেসবের উত্তর। তাহলে তার পক্ষে কি এটা সম্ভব ছিল পরিকল্পনা মোতাবেক করার, যেখানে কোন আয়াত কখন অবতীর্ণ হবে, এটা ছিল সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত। আর এধরনের বিন্যাস অবশ্যই পূর্বপরিকল্পিত হতে হবে; কিন্তু এটা কখনই তার নিয়ন্ত্রণের অধীনে ছিল না। তার অর্থ হলো এই যে, কোরআনের রচয়িতা হলো এমন কেউ, যিনি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানেন। আর ভবিষ্যৎ জানা হলো স্রষ্টার গুণ, মানুষের নয়। কিছু সমালোচক এটা বলে থাকে যে, কোরআনের আগেও কিছু বই ছিল, যাতে অনেকটা এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, তাই কোরআনকে অলৌকিক বলা যায় না। কিন্তু কোরআনকে অন্য বইয়ের সঙ্গে তুলনা করা অনেকটা রাত আর দিনকে তুলনা করার সমান। অনেক কারণেই তা বলা যায়।

প্রথমত, নবী (সা.) কোনো কবি ছিলেন না, এমনকি তার অক্ষর জ্ঞান ছিল না। তখনকার দিনের অনেকের মতোই তিনি লিখতে বা পড়তে জানতেন না।

দ্বিতীয়ত, অনেকেই এটা অনুমান করবেন, কোরআনকে সাজানো হয়েছে সময়ের ওপর ভিত্তি করে, অর্থাৎ প্রথম আয়াতটি সবার আগে নাজিল হয়েছে এবং শেষের আয়াতটি সবার শেষে। বেশিরভাগ বই এভাবেই লেখা হয়, একটি শুরুর অংশ তারপর মাঝের অংশ এবং সবশেষে সমাপ্তি। কিন্তু কোরআনকে যেভাবে সাজানো হয়েছে, তা আর অন্য কোনো বইয়ে পাওয়া যায় না। যেমন আল বাকারা, যে সুরাটি আমরা একটু আগে আলোচনা করলাম, তা কিন্তু প্রথমে আয়াত ১, তারপর ২, তারপর ৩ এভাবে অবতীর্ণ হয়নি। বরং আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়েছে- বিচ্ছিন্নভাবে অনেক বছর ধরে, এমনকি অন্য সুরার আয়াতও এর মধ্যে অবতীর্ণ হয়েছে। আর কোরআনের অবতীর্ণ হওয়ার এই পদ্ধতির কারণে একে বৃত্তাকারে বিন্যস্ত করা অত্যন্ত কঠিন অন্যান্য বইয়ের তুলনায়।

তৃতীয়ত, বই সাধারণত অনেক ধাপ সম্পাদনার মধ্যে দিয়ে যায়, যার ফলে একজন লেখক সহজেই লেখার মান আরো ভালো করতে পারেন। কিন্তু কোরআন কখনো সম্পাদিত হয়নি। কোনো আয়াত অবতীর্ণ হওয়া মাত্রই নবী (সা.) একে জায়গা মতো বসিয়ে দিতেন। প্রতি আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এটা চিন্তা করতেন না যে, এর আগে কি অবতীর্ণ হয়েছিল এবং কীভাবে একে বৃত্তাকারে বিন্যস্ত করা যায়। বরং সব আয়াতের অবস্থান আগে থেকেই পূর্বনির্ধারিত ছিল। যদি আমরা কোরআনের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা এমনটি কখনই দেখব না, যে কোনো আয়াতের অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে- এর বিন্যাস সুগঠিত করার জন্য।

চতুর্থত, সাধারণ বইয়ে বৃত্তাকার বিন্যাস আনা সহজ যেহেতু এর লেখকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে বইটির বিষয়বস্তুর উপর। এর ফলে একে পরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত করা সম্ভব। অথচ আমরা আগে দেখেছি যে, কোরআনের অবতীর্ণ হওয়া নির্ভরশীল ছিল নির্দিষ্ট ঘটনাবলির উপর, যা ছিল নবী (সা.) এর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলশ্রুতিতে, তার পক্ষে এটা পরিকল্পনা মোতাবেক করা সম্ভব ছিল না।পঞ্চমত, কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে মৌখিক আকারে। লিখিত আকারে নয়। লিখিত বইয়ের ক্ষেত্রে এর বিন্যাস পরিবর্তন করা সহজ, যেহেতু আগে যা লেখা হয়েছে তার বিন্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব। অথচ কোরআনের ক্ষেত্রে, যা মৌখিকভাবে অবতীর্ণ হয়েছে, নবী (সা.)-কে পূর্ণভাবে নির্ভর করতে হয়েছে তার স্মরণশক্তির উপর, এটা মনে করার জন্যও যে এর আগে কি অবতীর্ণ হয়েছে। যা আরো অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এত সব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে এটাই কি মনে করা স্বাভাবিক নয় যে, কোরআন হবে অবিন্যস্ত? অথচ আমরা দেখতেই পাচ্ছি যে, কোরআনের একটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত গঠন বিন্যাস রয়েছে। তাই কোরআন বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এর মধ্যে যে সাবলীল বিন্যাস রয়েছে, তাও জোরালো আওয়াজে দাবি করে, আল কোরআন অলৌকিক। ‘তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট হননি এবং বিপথগামীও হননি এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। কোরআন অহি, যা প্রত্যাদেশ হয়। তাকে শিক্ষা দান করে এক শক্তিশালী ফেরেশতা।’ (আল কোরআন ৫৩ : ২-৫)।

আল কোরআনের আয়াতসমূহের সম্বন্ধ-বিজ্ঞান : ইলমুল মুনাসিবাত নামে একটা বৈজ্ঞানিক শাস্ত্র গঠন করেছে ইসলামি জ্ঞানকলা, যার কাজ হলো কোরআনের সুরা ও আয়াতসমূহের পাস্পরিক সন্বন্ধের নীতি ও প্রজ্ঞার চর্চা। এই শাস্ত্রকে ইলমুত তারাবুত বলেও আখ্যায়িত করা হয়। বদরুদ্দিন যারকাশি আশ শাফেয়ি (৭৪৫-৭৯৪ হি.) জালালুদ্দিন আবদুর রহমান সুয়ুতি (৮৪৯-৯১১ হি.) প্রমুখের হাত ধরে এই শাস্ত্র বিকশিত হয়। যারকাশির আল বুরহান ফি উলুমিল কোরআন এ ধারার অন্যতম স্থপতি। সমকালেই তা অভিনন্দিত হয় মুসলিম একাডেমিয়ায়। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (৮৫২) (রহ.) লিখেছেন, ‘আমি আল্লামা যারকাশি (রহ.)-এর নিজ হাতে লিখিত আল-বুরহান ফি উলুমিল কোরআনের একটি নুসখা দেখেছি। এই কিতাব এক আশ্চর্যজনক এবং অনবদ্য সৃষ্টি। তিনি এই কিতাবে চল্লিশের অধিক উলুমুল কোরআন সম্পর্কিত আলোচনা করেছেন।

সুয়ুতির আল ইতকান ফি উলুমিল কোরআন এই শাস্ত্রকে দেয় সম্পন্নতা। উলুমুল কোরআন বা কোরআন সম্পর্কিত শাস্ত্রসমূহের মধ্যে তারাবুতের স্বতন্ত্র শাস্ত্রীয় কাঠামো তখন দাঁড়ালেও এর চর্চা ও অনুশীলন অনেক পুরোনো। নবী ও সাহাবী যুগেই-এর ভিত্তিসূত্র গঠিত হয়। তখন থেকেই কোরআনের সুরা ও আয়াতের ধারাবাহিকতা, পারস্পরিক সমন্বয় ইত্যাদির সূত্র, মূলনীতি ও পরম্পরা সূচিত হয়। এই পরম্পরা সর্বকালেই যে সত্যকে কেন্দ্রে রেখেছে, তা হলো কোরআন কীভাবে কোরআনকে উপস্থাপন করে? নিজের কোনো বিষয়ে কোরআন কীভাবে রায় দেয়? সেই উপস্থাপন ও রায়কে প্রাধান্য দিতে হবে। তারপর নবীয়ে পাক (সা.)-এর ব্যাখ্যা ও সুন্নাহ কোরআনকে কীভাবে ব্যাখ্যা করে, তার সঙ্গে সম্পর্কিত যে কোনো প্রশ্নকে কীভাবে মোকাবিলা করে, সেটা দেখতে হবে। তারপর দেখতে হবে ইসলামের প্রথম যুগের ব্যাখ্যা, উপলব্ধি, বিশ্বাস ও বর্ণনাগুলোকে। ভাষাতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক কিংবা নন্দনতাত্ত্বিক বিবেচনাগুলোকেও কাজে লাগায় তারাবুত।

রচনারীতির প্রচলিত ও ধ্রুপদি চাহিদাগুলো নিয়েও আলোকপাত করে এ শাস্ত্র। কিন্তু এই চাহিদার হাতে স্বেচ্ছাচারের স্বাধীনতা তুলে দেয় না। কোরআন কীভাবে নিজস্ব রীতির মধ্য দিয়ে এজাজ (অলৌকিকত্ব) নিশ্চিত করে, কোরআনি শাস্ত্রগুলো সেটাকে কেন্দ্রে রাখে। কারণ কোরআনের বর্ণব্যবহার, শব্দব্যবহার, বাক্যগঠন, অর্থসৃষ্টি থেকে নিয়ে আয়াত ও সুরার বিন্যাসের সর্বত্র এই এজাজ এতো বিপুল, ব্যাপক ও গভীরভাবে নিহিত, যাকে উপেক্ষা করলে আল কোরআনের ভেতর প্রবেশই করা যাবে না। এই এজাজ কোরআনকে আলাদা করেছে পৃথিবীর অন্য সব গ্রন্থ থেকে। কারণ কোরআন হচ্ছে আল্লাহর কালাম। যাকে মানবীয় সৃষ্টিকর্মের কোনো বর্গে, বিষয়ে, ধারায় বা শর্তের অধীন করা অসম্ভব। রিচার্ড বেলের সব প্রস্তাবনা এই সত্যকে অস্বীকার করে এগিয়েছে। আল কোরআনকে মানবীয় সৃষ্টিকর্মের বর্গে ফেলে প্রথাগত রূপায়নে তাকে বিন্যস্ত করতে চেয়েছে। কোরআনকে তার মূল প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের কল্পিত এক পদ্ধতিতে বিচার করেন বেল। নিজের বিচারের পূর্বনির্ধারিত উপসংহারে উপনীত হয়েছেন জোর করে। আর সেই উপসংহার হলো- মহাগ্রন্থ কোরআনকেও গতানুগতিক ধারার গ্রন্থরচনা পদ্ধতির অধীন হতে হবে। আল কোরআন মানবীয় গ্রন্থরচনা পদ্ধতির অধীন হওয়ার নয়। কিন্তু এটা তো সত্য যে, মানুষকে যেহেতু কোরআন আত্মস্থ করতে হবে, ফলে মানুষের বোধগম্য বিন্যাস তাতে থাকবে। হ্যাঁ। এই প্রশ্নকে গুরুত্ব সহকারে মোকাবিলা করেছে তারাবুত শাস্ত্র। সে প্রতিটি আয়াতে অনুসন্ধান চালিয়েছে। আয়াতসমূহের পারস্পরিক বিন্যাসের বোধগম্যতাকে ব্যাখ্যা করেছে। এমন আয়াতগুলো নিয়েও কথা বলেছে, যেখানে পূর্ববর্তী আয়াতের সঙ্গে পরবর্তী আয়াতের সম্পর্কসূত্র নিয়ে আপত্তি তুলেছে কোরআনের বিরুদ্ধবাদীরা। কোরআনের প্রতিটি আয়াতে শত্রুতার দৃষ্টি দিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে তারা। কিন্তু কয়েকটি জায়গায় শুধু অভিযোগ উত্থাপন করতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু সেই অভিযোগের অবাস্তব ও ভিত্তিহীন চিত্র প্রকাশিত হয়েছে অবিলম্বেই। (চলবে)