সমাজে প্রচলিত অযৌক্তিক কথা, ভ্রান্ত বিশ্বাস ও প্রথাকে কুসংস্কার বলা হয়। দিন বদলের এই জামানায় অনেক মানুষ কুসংস্কার পালন করে। ইসলামবহির্ভূত কর্মকাণ্ড পালনের মাধ্যমে নষ্ট হয় ঈমান-আমল। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নানাভাবে। সাধারণত নারীদের মধ্যে কুসংস্কার পালনের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। এখানে গর্ভবতী নারীদের প্রধান কয়েকটি কুসংস্কার নিয়ে আলোচনা করা হলো।
ছেলেমেয়ে নিশ্চিত করা : গর্ভবতী নারীর পেটের আকৃতি দেখে গর্ভস্থ সন্তান ছেলে হবে, নাকি মেয়ে হবে, এটা জানা সম্ভব নয়। অথচ অনেকে বলে থাকে গর্ভবতী নারীর পেট নিচের দিকে বড় হলে ছেলে এবং উপরের দিকে বড় হলে বা উঁচু হলে মেয়ে সন্তান হবে। এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা। নারীদের শারীরিক গঠন অনুযায়ী পেটের ধরন একেকজনের একেকরকম হয়ে থাকে। এর সঙ্গে ছেলেমেয়ে হওয়ার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, নিশ্চয়ই কেয়ামত সম্পর্কিত জ্ঞান শুধু আল্লাহর কাছে আছে। তিনি বৃষ্টিবর্ষণ করেন। তিনি জানেন মাতৃগর্ভে কী আছে? কোনো প্রাণী জানে না সে আগামীকাল কী অর্জন করবে এবং কোনো প্রাণী এটাও জানে না যে, কোন ভূমিতে তার মৃত্যু হবে? নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত, সবকিছু সম্পর্কে পরিপূর্ণ খবর রাখেন। (সুরা লুকমান : ৩৪)। সাম্প্রতিক সময়ে আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে ছেলেমেয়ে হওয়ার বিষয়টি জানা যায়। কিন্তু আল্লাহতায়ালা সন্তান অস্তিত্বে আসার আগে থেকেও ছেলেমেয়ে হওয়ার বিষয়টি জানেন। যা অন্য কেউ জানে না।
গর্ভবতী নারীর দোষ : যদি একজন নারীর বার বার কন্যা হয় কিংবা বার বার ছেলে সন্তান হয়, তাহলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কোথাও কোথাও সেই মহিলার ওপর জুলুমণ্ডনির্যাতন করা হয়। মিডিয়ায় তালাকের নিউজ পর্যন্ত পাওয়া যায়। এগুলো কুসংস্কার। অন্যায় কাজ। গর্ভের সন্তান ছেলেমেয়ে হওয়ার পেছনে গর্ভবতী নারীর কোনো দোষ নেই। পবিত্র কোরআন এসেছে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। যাকে চান, কন্যা দেন এবং যাকে চান পুত্র দেন। অথবা পুত্র ও কন্যা উভয়টাই দান করেন। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। (সুরা শুরা : ৪৯-৫০)।) একজন মা কষ্টের পর কষ্ট করে সন্তানকে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখান। এজন্য তার প্রতি স্বামী ও তার পরিবারের সবার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।
সন্তানের গঠন আকৃতি : মুরুব্বি মহিলারা বলে থাকেন গর্ভবতী নারীর খাবার সন্তানের শারীরিক গঠনে প্রভাব ফেলে। চকলেট বা গাঢ় রঙের খাবার খেলে শিশুর গায়ের রঙ কালো হয়, আর দুধের মতো হালকা রঙের খাবার খেলে ত্বকের রং ফর্সা হয় ইত্যাদি। তাদের প্রদত্ত এই বক্তব্যগুলো কুসংস্কার। সত্যি কথা হলো, সন্তানের গঠনাকৃতির বিষয় সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। তিনি ফর্সা-কালো, লম্বা-বেটে করে সৃষ্টি করেন। সন্তানের গঠন আকৃতি অনেক ক্ষেত্রে পিতামাতার মতো হয়। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। উম্মে সুলাইম (রা.) বলেন, তিনি রাসুল (সা.) কে সেই মহিলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন যে, ঘুমে পুরুষ যা দেখে তাই দেখতে পায়। (পুরুষের মতো যে মহিলার স্বপ্নদোষ হয়) রাসুল (সা.) বললেন, মেয়ে লোক যখন ওইরূপ দেখবে, তখন সে গোসল করবে। উম্মে সুলাইম (রা.) বলেন, এ কথায় আমি লজ্জাবোধ করলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন মহিলাদের কি এমন হয়? নবী করিম (সা.) বললেন, হ্যাঁ! মহিলাদের এরূপ না হলে ছেলেমেয়ে তার সাদৃশ্য কোত্থেকে পায়? পুরুষের বীর্য গাঢ় সাদা আর মেয়ে লোকের বীর্য পাতলা, হলুদ। উভয়ের মধ্যে থেকে যার বীর্য উপরে উঠে যায় (বেশি শক্তিশালী হয়) অথবা আগে চলে যায়, সন্তান তারই সাদৃশ্য হয়। (মুসলিম : ৬০৩)।
গর্ভকালীন নারীর খাবার : একজন গর্ভবতী মাকে নিজের ও অনাগত শিশু দুজনের জন্য নাকি সমপরিমাণ খাবার খেতে হয়। এটাও? একটি প্রচলিত কুসংস্কার। এ পরামর্শ তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। গর্ভাবস্থায় কতটুকু খাবার বেশি খেতে হবে তা নির্ভর করে গর্ভবতীর ওজন, উচ্চতা ও গর্ভের বয়স অনুপাতে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ও খাদ্য তালিকা অনুসরণ করা জরুরি। গর্ভবতী মায়ের পুষ্টির জন্যই দেশীয় ফলমূল খাবারের প্রতি উৎসাহিত করা হয়। জমজ কলা খেলে জমজ সন্তান হবে, বহুল প্রসিদ্ধ এই কথাটিও অযৌক্তিক। আল্লাহর কোনো সৃষ্টির মধ্যে অশুভ বা অকল্যাণ বলতে কিছু নেই। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, হে আমার রব! তুমি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করোনি। (সুরা আলে ইমরান : ১৯১)।
গর্ভাবস্থায় শারীরিক সম্পর্ক : গর্ভকালীন স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। গর্ভের সন্তানের কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। তবে এক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা এবং বিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। তবে ডাক্তাররা সাধারণত সন্তান গর্ভে আসার প্রথম ৩ মাস গর্ভবতী মাকে স্বামী সহবাস থেকে বিরত থাকতে বলেন। এতে গর্ভপাতের ভয় থাকে। প্রথম ৩ মাস পর গর্ভকালীন শারীরিক মিলনের সময় স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধা মতো পদ্ধতি নির্বাচন করা শ্রেয়। হজরত মুহাম্মদ ইবনে আল মুনকাদির (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হজরত জাবের (রা.) কে বলতে শুনেছি যে, ইহুদিরা বলত, যখন কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে পশ্চাত দিক থেকে তার যৌনাঙ্গে সহবাস করে, তখন যে সন্তান জন্মগ্রহণ করে সে টেরা হয়। তখন আল্লাহতায়ালা এ আয়াত নাজিল করেন, তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্য ক্ষেতস্বরূপ। কাজেই তোমরা তোমাদের ক্ষেত্রে যে রূপে ইচ্ছে সে রূপে গিয়ে ফসল উৎপাদন করো। (সুরা বাকারা : ২২৩, আবু দাউদ : ২১৬০)। এই আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ইহুদিদের ভ্রান্ত মতবাদের অসারতা প্রমাণ করে দিয়েছেন।
চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের কুসংস্কার : চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় গর্ভবতী নারী কিছু কাটাকাটি করলে, খাওয়া-দাওয়া করলে সন্তানের ক্ষতি হয়, এগুলো ভ্রান্ত ধারণা। ইসলাম ও বাস্তবতার সঙ্গে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। আরব সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারকে রাসুল (সা.) প্রত্যাখ্যান করেছেন। হজরত মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) বলেন, রাসুলের পুত্র ইব্রাহিমের ইন্তেকালের দিনটিতে সূর্যগ্রহণ হলে আমরা বলাবলি করছিলাম যে, নবীপুত্রের মৃত্যুর কারণে সূর্যগ্রহণ হয়েছে। এসব কথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহতায়ালার অগণিত নিদর্শনের দুটি। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হয় না। (বোখারি : ১০৪৩)। চন্দ্রগ্রহণ ও সুযোগ গ্রহণ হলে রাসুল (সা.) নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। হাত তুলে দোয়া করতেন। এ সুন্নাতের ওপর আমল করা সবার জন্য জরুরি।
লেখক : কবি ও মাদ্রাসা শিক্ষক