কর্জে হাসানার ফজিলত

শাহাদাত হোসাইন

প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাহায্য প্রার্থীকে সাহায্য করা। অসহায়কে সহায়তা করা মহৎ কাজ। আর মহৎ কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করা আল্লাহর আদেশ বটে। আল্লাহ বলেন, সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে তোমরা একে অন্যকে সাহায্য করো (সুরা মায়েদা : ২)। কর্জ দেয়া একটি জনহিতৈষী কাজ। এতে অভাবী লোকদের অভাব মোচন হয়। অর্থক্লিষ্ট ব্যক্তির অর্থাভাব দূর হয়। অল্প সময়ের জন্য হলেও প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারে। সামর্থবানদের উচিত কর্জে হাসানা প্রার্থীদের যথাসম্ভব সাহায্য করা।

 

কর্জে হাসানার গুরুত্ব : কর্জের মাধ্যমে প্রয়োজনার্থীর প্রয়োজন মিটানোর প্রতি আল্লাহতায়ালা এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে, বান্দার কর্জ দেয়াকে স্বয়ং আল্লাহকে ঋণ দেয়া বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুরা বাকারায় এসেছে, এমন কে আছে যে আল্লাহকে কর্জ দেবে উত্তম কর্জ, অতঃপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবেন (২৪৫)। এর থেকে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে যে, ব্যক্তিকে কর্জ দেয়ার মাধ্যমে আপনি আল্লাহকে সাহায্য করছেন। উপরন্তু, প্রতিদান স্বরূপ তিনি এটাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে ফেরত দেবেন।

কর্জে হাসানায় সাদকার সাওয়াব : কোনো ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণে কর্জে হাসানা দেওয়া। সাদকা ও দানের মতো সাওয়াবের কাজ। কর্জে হাসানার মাধ্যমে সাদকার সমপরিমাণ সাওয়াব পাওয়া যায়। হাদিসে এসেছে, নবীজি বলেছেন, ঋণ মুক্তির জন্য দু’বার কর্জ দেওয়া একবার সাদকা করার থেকেও উত্তম। (আল-জামেউস-সগীর : ৬১০০)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, যে ব্যক্তি একটি স্বর্ণ বা রৌপ্য-মুদ্রা দু’বার কর্জ দেবে, সে তা একবার দান করার সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে (আল-মুহাজ্জাব ৪ : ৮৯৩৫)। নবীজির বর্ণনা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, কর্জে হাসানার গুরুত্ব ও ফজিলত কতটা বেশি।

 

কর্জ গ্রহিতাকে অবকাশ দানে জান্নাতের সুসংবাদ : কর্জগ্রহিতা যদি নির্দিষ্ট সময়ে কর্জ পরিশোধে সক্ষম না হয় এবং কর্জদাতা তাকে অবকাশ দেয়। তাহলে প্রতিদানে আল্লাহতায়ালা সেই ব্যক্তির সকল অপরাধ মার্জনা করে জান্নাত দেবেন। হাদিসে এসেছে, একদিন নবীজি সাহাবিদের উদ্দেশ্যে বললেন, পূর্ববর্তী উম্মতের এক-ব্যক্তির আত্মার সঙ্গে ফেরেস্তারা সাক্ষাৎ করে বললেন, আপনি কি কোনো নেক কাজ করেছেন? লোকটি বললেন, না। ফেরেস্তারা বললেন, স্মরণ করুন! তিনি বললেন, দুনিয়াতে আমি মানুষকে ঋণ দিতাম। আমি আমার কর্মচারীদের বলে দিয়েছিলাম যে, তারা যেন অসচ্ছল, অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে ঋণ পরিশোধে অবকাশ দেয়। তখন আল্লাহতায়ালা ফেরেস্তাদের বললেন, তাকে ক্ষমা করে দাও। (আল-মুহাজ্জাব ৪ : ৮৯৫০)।

 

কেয়ামতের ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণ : অভাবী ব্যক্তিকে কর্জে হাসানা প্রদান কিংবা ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে ঋণ পরিশোধে সুযোগদান কর্জ প্রদানকারী ব্যক্তিকে কেয়ামতের কঠিন বিভীষিকা থেকে মুক্তি দেবে। সাহাবি আবু কাতাদাহ (রা.) এক ব্যক্তির নিকটে পাওনাদার ছিলেন। পাওনা উসুলের জন্য সেই ব্যক্তিকে খোঁজ করলে, তিনি আত্মগোপন করেন। ঘটনাক্রমে তার সঙ্গে আবু কাতাদাহর সাক্ষাৎ হলে, তিনি আবু কাতাদাকে বললেন, আমি অসচ্ছল, দরিদ্র, ঋণ পরিশোধে অক্ষম। যার কারণে অত্মগোপন করেছিলাম। আবু কাতাদাহ (রা.) বললেন, আল্লাহ! তখন সেই ব্যক্তি বললেন, আল্লাহ কেন? আবু কাতাদাহ (রা.) বললেন, আমি নবীজিকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কেয়ামতের বিভীষিকা থেকে আল্লাহতায়ালার পরিত্রাণ লাভে ধন্য হতে চায়! সে যেন অভাবীকে অবকাশ দেয় অথবা মাফ করে দেয়। (মুসলিম : ১৫৬৩)।

কর্জে হাসানায় আঠারো গুণ সাওয়াব : প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, প্রত্যেকটি কর্জ-ধার সাদকাতুল্য। (শুয়াবুল ঈমান : ৩৫৬৩)। সাধারণ দানে ব্যক্তির সাওয়াব ১০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। যেমন নবীজি বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা একটি নেক কাজকে ১০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন (বদরুল-মুনির ৪ : ৬৭০)। কিন্তু কেউ যদি কর্জ দেয়, তাহলে তার জন্য আঠারো গুণ পর্যন্ত সাওয়াব বৃদ্ধি করা হয়। নবীজি বলেছেন, সাদকায় ১০ গুণ পরিমাণ সাওয়াব আর কর্জ-ধারে ১৮ গুণ পর্যন্ত সাওয়াব দেয়া হয় (নাইলুল-আওতার ৫ : ২৭১)। তাই, সক্ষমতা থাকলে কর্জে হাসানা প্রদানে কৃপণতা ও সংকোচতায় না ভোগে খোলা মনে সাওয়াবের নিয়তে কর্জ দেয়া উচিত।

 

বান্দাকে সাহায্যে আল্লাহর সাহায্য : আমরা সবাই আল্লাহতায়ালার সাহায্যের ভিখারি। আল্লাহর সাহায্য তখনি আসবে, যখন আমরা আল্লাহর অভাবী বান্দাদের সাহায্য করব। সাহাবি আবু হোরায়রা (রা.) নবীজি থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় কোনো মোমেনকে চিন্তামুক্ত বা দুর্দশামুক্ত করবে, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতে সেই ব্যক্তিকে দুর্দশামুক্ত করবেন। আর যে ব্যক্তি অভাবগ্রস্ত কোনো ব্যক্তির ওপর সহজতা করবে, আল্লাহতায়ালা তার জন্য দুনিয়া ও আখেরাত সহজ করবেন। আল্লাহতায়ালা ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা তার ভাইকে সাহায্য করেন। (মুসলিম : ২৬৯৯)। আল্লাহর সাহায্য পেতে কর্জের মাধ্যমে বান্দাকে সাহায্য করা উচিত।

 

কর্জে হাসানা বন্ধে সুদের সয়লাব : আল্লাহতায়ালা সুদকে নিষিদ্ধ ও হারাম করেছেন আর কর্জ প্রদানকে হালাল ও সাওয়াবের মাধ্যম বানিয়েছেন। যাতে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও হৃদ্যতা প্রকাশ পায়। একে-অন্যের দুঃখ-কষ্টে পাশে থাকে। কিন্তু আমরা দিনদিন কর্জের সংস্কৃতি থেকে সরে এসেছি ও আসছি। বর্তমান সমাজে সুদের ব্যাপক প্রচলনের পেছনে প্রধান দায়ী কর্জে হাসানা প্রদান বন্ধ হয়ে যাওয়া। অভিশপ্ত সুদের সংস্কৃতি থেকে বের হতে কর্জে হাসানা প্রথার কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, কর্জে হাসানা অভাবী ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ। আর আল্লাহতায়ালা অনুগ্রহকারীকে পছন্দ করেন (সুরা বাকারা : ১৯৫)।

কর্জ গ্রহিতার দায়িত্ব : কর্জে হাসানা বা ঋণগ্রহিতার দায়িত্ব হলো, সঠিক সময়ে কর্জ পরিশোধ করা। আর পরিশোধ করতে না পারলে কর্জদাতার কাছে পরিশোধের সময় বাড়ানোর আবেদন করা। আমাদের সমাজে কর্জপ্রথা বিলুপ্তের পেছনে প্রধান দায়ী কর্জগ্রহিতাদের ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করা। কর্জ প্রদানকারী ব্যক্তির এমন অভিযোগ প্রতিনিয়ত পাওয়া যায় যে, কর্জপ্রদান করার পর কর্জগ্রহিতার দেখা পাওয়া যায় না। ফোন রিসিভ করে না। কর্জ দেয়ার পর নিজেকেই অপরাধী মনে হয়। কর্জগ্রহিতার এমন মানসিকতা পরিহার করা অত্যাবশ্যকীয়। আরেকটি বিষয় লক্ষ্য রাখা, মানুষের প্রয়োজন অনেক। সব প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই যে সময় ও যে পরিমাণ অর্থ কর্জ হিসেবে গ্রহণ করলে ফেরত দেওয়ার নির্ধারিত সময়ে ফেরত দেওয়া যাবে, নিজের সেই সক্ষমতার ভিত্তিতে কর্জ গ্রহণ করা। তাহলে কর্জ পরিশোধে গড়িমসি হবে না আশা করা যায়। আর কর্জে হাসানার ব্যাপক প্রচলনও তখন, ব্যাপক হতে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না।

লেখক : খতিব-বাইতুল আজিম জামে মজিদ,রংপুর