হজ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ। আবশ্যকীয় ইবাদতসমূহের একটি। যা হিজরি নবম সনে সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর ফরজ করা হয় (যাদুল মাআদ ৩ : ৫৯৫)। সঙ্গত কারণে, ইসলামি শরিয়াতে হজের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মাহত্ব অনেক বেশি। নবীজি নিজে হজ করেছেন এবং উম্মতের সামর্থবান ব্যক্তিদের হজ আদায়ে তাগিদ দিয়েছেন। অনাদায়ে কঠোর ধমকি এবং ভয়ংকর শাস্তির কথা বলেছেন। আসুন, কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলামে হজের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে জেনে নেই এবং তা অনুযাই আমলে সচেষ্ট হই।
আল-কোরআনে হজের আদেশ : আল-কোরআন আল্লাহতায়ালার মহামান্বিত কিতাব। মানবের জীবন বিধান। যা মান্য করা প্রতিটি নর-নারীর ওপর অত্যাবশ্যকীয়-ফরজ। হজের প্রথম ঘোষণা ইবরাহিম (আ.) এর কণ্ঠে ঘোষিত হয়। ইবরাহিম (আ.) দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, হে লোক সকল! তোমাদের রবের একটি ঘর আছে তোমরা সেখানে হজ করো। যেমনটা আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেছেন, আর মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দিন, তারা আপনার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সব ধরনের কৃশকায় উঠের পিঠে করে, তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে (সুরা হজ : ২৭)। পরবর্তী হিজরি নবম সনে উম্মতে মুহাম্মাদির ওপর হজ ফরজ করে নবীজির ওপর নাজিল করা হয়, মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (মক্কায়) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তাদের ওপর আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ করা ফরজ (সুরা আলে ইমরান : ৯৭)। যুগে যুগে এভাবেই মানুষ আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ পালন করে আসছেন।
হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ : হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। ইসলাম যে কয়টি খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে হজ সেগুলোর পঞ্চম খুঁটি। সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, নবীজি বলেছেন, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের ওপর, যথা- আল্লাহতায়ালা ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসুল এ কথার সাক্ষ্য দেয়া। নামাজ কায়েম করা। জাকাত দেয়া, রমজানের রোজা রাখা এবং সক্ষমতা থাকলে বাইতুল্লাহর হজ করা (বোখারি : ৮)। এই হাদিস থেকে হজের গুরুত্ব কতটা বেশি তা অনুধাবন করা যায়। খুঁটি ছাড়া যেমন ঘর কিংবা তাঁবুর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, তেমনি হজ ছাড়াও ইসলামের পূর্ণানজ্ঞতা ভাবা যায় না।
নবীজিকে জিবরাঈলের প্রশ্ন ইসলাম কী? : সাহাবিদের মজলিসে একবার জিবরাঈল (আ.) মানুষ রুপে আবির্ভূত হয়ে নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া-রাসুলাল্লাহ! ইসলাম কী? যা বোদ্ধা মহলে হাদিসে জিবরাঈল নামে প্রশিদ্ধ। জিবরাঈলের প্রশ্নের উত্তরে নবীজি বলেছিলেন, ইসলাম হলো, আল্লাহ এক এবং মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর রাসুল এ কথার সাক্ষ্য দেয়া। নামাজ কায়েম করা। জাকাত দেয়া এবং সামর্থ থাকলে হজ করা (মুসলিম : ১)। এ হাদিসেও ইসলামে হজের গুরুত্বের বিষয়টি পরিস্ফুটিত হয়েছে। এই হাদিস থেকে সহজে অনুমেয় হয় যে, কালেমায় স্বীকৃতি যেমন আবশ্যক। নামাজ, রোজা, জাকাত যেমন আবশ্যকীয় ইবাদত, হজও তেমনি আবশ্যকীয় ইবাদত।
হজ পালনের গুরুত্ব : ইসলামি শরিয়ত এবং ইসলামের নবী হজের প্রতি এতটাই গুরুত্বারোপ করেছেন যে, হজে সামর্থবান কোনো ব্যক্তি যদি হজ না করে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে তার মৃত্যুকে ইহুদি কিংবা খ্রিষ্টানের মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। হযরত আলি (রা.) নবীজি থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি এতটুকু পাথেয়র মালিক হয়, যা তাকে বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়, এতদাসত্তেও সে হজ করল না। তবে সে ইহুদি হয়ে মৃত্যুবরণ করল, নাকি খ্রিষ্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করল, তাতে দেখার কিছু নেই (তিরমিজি : ৭১২)। হজের গুরুত্ব বোঝাতে এর থেকে কঠোর কোনো শব্দের প্রয়োজন নেই। প্রিয় পাঠক, একটু ভাবুন! কতটা গুরুত্বপূর্ণ হলে এমনটা বলা যায়?
বৃদ্ধ হলেও হজ মাফ নয় : ইসলামের অনেক বিধান এমন আছে, শারীরিক অক্ষমতার কারণে যেগুলো মাফ হয়ে যায়। কিন্তু হজ এমন একটি ইবাদত যা ব্যক্তির শারিরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও মাফ করা হয় না। বরং অন্যের মাধ্যমে হলেও তা স¤পাদন করা ব্যক্তির ওপর ফরজ ও জরুরি থাকে। একবার একজন মহিলা নবীজির দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! হজ বান্দার প্রতি আল্লাহর ফরজ বিধান। আমি আমার বাবাকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেয়েছি। বার্ধক্যের কারণে তিনি বাহনে বসে থাকতে পারেন না। আমি কী তার পক্ষ থেকে হজ করব? নবীজি বললেন, হ্যাঁ (বোখারি : ১৫১৩)।
হজের ফজিলত : হজ ইলামের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ইবাদত হওয়ার কারণে তার ফজিলত অনেক বেশি। নিম্নে কোরআন হাদিসের আলোকে হজের ফজিলত বর্ণনা করা হলো।
হাজিরা সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ : আল্লাহয় বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষ নিজের গোনাহের ব্যাপারে চিন্তিত থাকেন। আল্লাহর ক্ষমা পেতে উৎগ্রিব হন। হজ এমন একটি নেক আমল, যা ব্যক্তির পাপ মোচন করে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ করে দেয়। হাদিসে এসছে, নবীজি বলেছেন, যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহতায়ালার জন্য হজ করবে এবং কোনো অশ্লীলকর্ম কিংবা গালি-গালাজ করবে না, সে হজ থেকে সেভাবে নিষ্পাপ হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে, যেভাবে সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তান মায়ের পেট হতে নিষ্পাপ অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে (বোখারি : ১৫২১)। অন্য হাদিসে এসেছে, নবীজি বলেন, তোমরা হজ এবং ওমরা একসঙ্গে করো। কেন না, এ দুটি গোনাহ এবং দারিদ্রতাকে এভাবে দূরীভূত করে যেভাবে আগুন লোহা, স্বর্ণ এবং রুপার জং দূর করে (তিরমিজি : ৮১০)।
আল্লাহর কাছে প্রিয় আমল : কিছু আমল-ইবাদত এমন আছে, যেগুলো আল্লাহতায়ার কাছে বড় প্রিয়। রবের কাছে সর্বোত্তম ইবাদত হিসাবে পরিগণিত। বাইতুল্লাহর হজ সেগুলোর অন্যতম। সাহাবি আবু হোরায়রাহ (রা.) বলেন, একজন ব্যক্তি নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল সর্বোত্তম আমল কোনটি? নবীজি বললেন, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনায়ন করা। সাহাবি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কোনটি? নবীজি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করা। সাহাবি আবার বললেন, অতপর কোনটি? নবীজি বললেন, কবুল হজ (বোখারি : ১৫১৯)।
জান্নাত হজের একমাত্র প্রতিদান : জান্নাত প্রাপ্তি প্রতিটি মনের শুপ্ত বাসনা। দেলের একনিষ্ট চাহাত ও তামান্না। সেই তামান্না পূরণ করা সম্ভব হজের মাধ্যমে। হজের মাধ্যমে ব্যক্তি জান্নাতের নিশ্চয়তা পায়। নবীজি বলেছেন, হজে মাবরুর তথা কবুল হজের একমাত্র প্রতিদান জান্নাত (তিরমিজি : ৮১০)। জান্নাতের আকাঙ্ক্ষায় আল্লাহর উদ্দেশ্যে আমাদের হজব্রত পালন করা উচিত।
আল্লাহর দলভুক্ত হওয়ার সুযোগ : আল্লাহতায়ালা আমাদের স্রষ্টা আমরা তার সৃষ্টি। তার নৈকট্য লাভ এবং দলভুক্ত হওয়াই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সাধনা এবং পরম চাওয়া-পাওয়া। যারা বাইতুল্লাহর হজে যায় তাদের নবীজি আল্লাহতায়ালার দলভুক্ত বলে অবহিত করেছেন। হাদিসে এসেছে, নবীজি বলেন, তিনটি দল আল্লাহর বাহিনীভুক্ত। বীর বেশে যুদ্ধ ফেরত মুজাহিদ বাহিনী। বাইতুল্লাহর হজকারী এবং ওমরাকারী (নাসাঈ : ২৬২৫)। আল্লাহর দলভুক্ত হতে হজের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
কেয়ামত পর্যন্ত হজের সাওয়াব : জীবন-মরণ সবি আল্লাহর হাতে। মৃত্যু কখন আসবে, আমরা তার কিছুই জানি না। হজব্রত পালন করতে গিয়ে যদি কোনো ব্যক্তি মারা যায়, তাহলে আল্লাহতায়ালা কেয়ামত পর্যন্ত সেই ব্যক্তিকে হজের সাওয়াব দান করবেন। এই প্রতিদান ব্যক্তি স্বীয় কবরে শুয়ে শুয়ে পাবেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি হজ কিংবা ওমরার নিয়তে স্বীয় ঘর থেকে বের হয়, অতপর রাস্তায় মৃত্যুবরণ করে। আল্লাহতায়ালা সেই ব্যক্তির জন্য কেয়ামত পর্যন্ত হজ ও ওমরাহকারীর সাওয়াব লিখে দেন (ইহয়ায়ে উলুমিদ্দীন ১ : ২৪০)।
হজ দুনিয়ার সব কিছু থেকে উত্তম : আল্লাহতায়ালা বান্দার নেক-কর্মকে ভালোবাসেন। হজ একটি নেক-কর্ম। আর একটি কবুল হজ আল্লাহতায়ালার কাছে পৃথিবী এবং পৃথিবীর সব কিছুর থেকে উত্তম। হাদিসে এসেছে, প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, হজে মাবরুর-কবুল হজ দুনিয়া এবং দুনিয়ার সবকিছু থেকে উত্তম (ইহয়ায়ে উলুমিদ্দীন ১ : ২৪০)। অথচ আমরা দুনিয়ার জন্য হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফজিলতময় ইবাদত ছেড়ে দেই।
বায়তুল্লাহর মুসাফিরদের দোয়া কবুল হয় : যারা হজ করার জন্য বায়তুল্লাহয় গমন করেন, তারা আল্লাহর ঘরে আসার কারণে তারা আল্লাহর প্রতিবেশী হয়ে যান। সে কারণে আল্লাহতায়ালা তাদের চাওয়া সকল মন-বাসনা পূরণ করেন। তাদের তাওবা এস্তেগফার কবুল করেন। নবীজি বলেছেন, হজ ও ওমরাহকারীরা আল্লাহর প্রতিনিধি এবং প্রতিবেশী। যদি তারা তার কাছে চায়, তাহলে তিনি তাদের তা দেন। আর যদি তারা ক্ষমা প্রার্থণা করে, তাহলে তাদের ক্ষমা করা হয়। আর যদি তারা দোয়া করে, তাহলে তাদের দোয়া কবুল করা হয় এবং তারা সুপারিশ করলে তাদের সুপারিশ কবুল করা হয় (ইহয়ায়ে উলুমিদ্দীন ১ : ২৪০)।
শহিদি মৃত্যুর মর্যাদা লাভ : মৃত্যু তো একদিন হবেই। তবে কতই না ভাল হয়, যদি সেই মৃত্যু শহিদি মৃত্যু হয়। যদি সেই মরণে শহিদের মর্যাদা পাওয়া যায়। হজ পরবর্তী মৃত্যু শহিদের মৃত্যুর মতো। শহিদরা আল্লাহতায়ালার কাছে যতটা দামি ও সম্মানি হজ পরবর্তী মৃত্যুবরণকারী হাজিরাও তদ্রুরুপ দামি ও সম্মানি। হাসান বসরি (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি রমজান, যুদ্ধ কিংবা হজের পরে ইন্তেকাল করবে, সে শহিদি মৃত্যু লাভ করবে (ইহয়ায়ে উলুমিদ্দীন ১ : ২৪১)।
দুনিয়া ও আখেরাত অর্জন : হাজিরা আল্লাহর মেহমান বেশে আল্লাহর ঘরের জিয়ারতে ধন্য হন। আর মেহমানের চাহিদা পূরণ করা মেজবানের নৈতিক দায়িত্ব। আল্লাহতায়ালার থেকে উত্তম কোনো মেজবান হতে পারে না। তাই তো আল্লাহতায়ালা হাজিদের দুনিয়া-আখেরাতের সকল চাহিদা পূরণ করেন। হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি দুনিয়া ও আখেরাত চায়, সে যেন এই ঘরের (কাবা) মনস্থ করে। কারণ, যদি কোনো বান্দা দুনিয়া চায়, তাহলে আল্লাহ তাকে এখান থেকেই তা দান করেন। আর যদি কেউ আখেরাত চান, তাহলে এখানেই তার জন্য গচ্ছিত রাখা হয় (আত-তাবসেরাহ : ২৬২)।
লেখক : খতিব, বাইতুল আজিম জামে মসজিদ, রংপুর।