কাবা নির্মাণের ইতিহাস
শাহাদাত হোসাইন
প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কাবা যে নাম শুনে আন্দোলিত হয় প্রতিটি হৃদয়, মম ও প্রাণ। যার ভালোবাসায় পাগল প্রায় প্রতিটি মোমেন মন। যে ভালোবাসার শিকড় প্রোথিত মোমেন হৃদয়ের গভীরে। মোমেন মাত্রই কাবা জিয়ারতের স্বপ্ন লালন করেন মনে। এ ঘর ছুঁয়ে দেখার এক-অপার্থিব টান অনুভব করেন হৃদয় মাজারে। যার আলোচনা ও ইতিহাস মোমেন হৃদয়ে কম্পনের সৃষ্টি করে। যার ঘটনা শুনে যায় অপলক নয়নে। যার ইতিহাস-ঐতিহ্যে বিমোহিত হয় শরীর, মন ও প্রাণ। আসুন, ইখবারু মক্কা কিতাবের আলোকে জেনে নিই কাবা নির্মাণের আদি-অন্ত ইতিহাস।
ফেরেশতা কর্তৃক কাবা নির্মাণ : সর্বপ্রথম আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা এ ঘর নির্মাণের সৌভাগ্য লাভ করেন। মুহাম্মাদ ইবনে আলি ইবনে হুসাইন (রা.) বর্ণনা করেন, আমি আমার পিতা আলি ইবনে হুসাইনের সঙ্গে মক্কায় কাবা তাওয়াফে রত ছিলাম। এমতাবস্থায় দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হলেন এবং বাবার কাঁধে হাত রাখলেন। বাবা তার দিকে তাকালে, তিনি সালাম দিলেন এবং বললেন, হে রাসুল তনয়ার ছেলে আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। বাবা তাওয়াফ সম্পন্ন করে দুরাকাত নামাজ আদায় করে বললেন, কী জিজ্ঞাসা করতে চাও? তিনি বললেন, আমি এই ঘরের তাওফের সূচনা সম্পর্কে জানতে চাই। জানতে চাই তা কেন করা হয়? কীভাবে এবং কখন থেকে করা হয়? বাবা প্রশ্ন করলেন, তুমি কোত্থেকে এসেছ? তিনি বললেন, শাম থেকে। বাবা বললেন, শামের কোন এলাকায় তোমার বাসা? লোকটি বললেন, বাইতুল মুকাদ্দাসে। বাবা বললেন, তুমি তাওরাত এবং জাবুর কিতাবদ্বয় পড়েছ কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। বাবা বললেন, হে শামি ভাই! মনে রেখ, আমার সঙ্গে সত্য বৈ মিথ্যা বলবে না। শুনে রেখ, এ ঘরের তাওয়াফের সূচনা হয়, যখন আল্লাহ ফেরেশতাদের বলেছিলেন, আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা-প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই (সুরা বাকারা : ৩০)। উত্তরে ফেরেশতারা বলেছিলেন, হে রব! আমাদের ছাড়াও কি আপনি এমন প্রতিনিধি সৃষ্টি করবেন? যারা সেথায় ফ্যাসাদ করবে। রক্তারক্তি করবে। হিংসা-বিদ্বেষ করবে? হে রব! আপনি আমাদেরই আপনার খলিফা মনোনীত করুন। আমরা রক্তারক্তি, হিংসা-বিদ্বেষ কিছুই করব না। তখন আল্লাহ বলেছিলেন, নিশ্চয়ই আমি যা জানি তোমরা তা জান না (সুরা বাকারা : ৩০)। আল্লাহর এমন উত্তরে ফেরেশতারা ধারণা করলেন, তারা যা বলেছে তা আল্লাহর বিরুদ্ধে হয়েছে এবং আল্লাহ তাদের প্রতি রাগান্বিত হয়েছেন। তখন তারা আরশের নিচে আশ্রয় নিলেন। নিজেদের মাথা ওপরের দিকে উত্তোলন করলেন এবং আল্লাহর কাছে অনুনয়-বিনয় করে কাঁদতে লাগলেন তাঁর দয়া ও ক্ষমার আশায়। সে সময় তারা তিনবার আরশের তাওয়াফ করেন। আল্লাহ তাদের প্রতি তাকালেন এবং দয়া করলেন। আরশকে কেন্দ্র করে তাদের কৃত তাওয়াফ আল্লাহর পছন্দ হয় এবং তিনি আরশের নিচে চার খুঁটি বিশিষ্ট ঝবরজাদ পাথরের দ্বারা একটি ঘর নির্মাণ করেন এবং লাল ইয়াকুত দ্বারা তা ঢেকে দেন। অতঃপর ফেরেস্তাদের আদেশ করেন, তোমরা এই ঘরের তাওয়াফ কর। সেই ঘরটিই হলো, বায়তুল মামুর। যা প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা তাওয়াফ করে। যারা কেয়ামত পর্যন্ত আর দ্বিতীয়বার সেই ঘরের তাওয়াফ করার সুযোগ পাবে না (জামেউস-সগির ৪ : ২৫)। অতঃপর, তিনি ফেরেশতাদের আদেশ করলেন এই পরিমাপের একটি ঘর পৃথিবীর বাসিন্দাদের জন্য তৈরি করো। যাতে পৃথিবীর বাসিন্দারা সেখানে তাওয়াফ করতে পারে। এটা শুনে ওই ব্যক্তি বললেন, সত্য বলেছেন, হে রাসুল তনায়ার ছেলে (ইখবারু মাক্কা : ৩২)।
আদম (আ.) কর্তৃক কাবা নির্মাণ : ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আদম (আ.) প্রথম মানুষ, যিনি কাবা নির্মাণ করেন এবং সেখানে নামাজ পড়েন (ইখবারু মাক্কা : ৪০)। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আদম (আ.) দুনিয়াতে এসে আল্লাহর ক্ষমা লাভে ধন্য হলে, তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আমি ফেরেশতাদের আওয়াজ শুনতে পাই না। তাদের অনুভবও করতে পারি না। আল্লাহ বললেন, তা তোমার অপরাধের কারণে। তবে তুমি যাও এবং আমার জন্য একটি ঘর নির্মাণ কর। তার তাওয়াফ কর। তার পাশে আমাকে স্মরণ কর। যেমনটা তুমি ফেরেশতাদের করতে দেখেছ আরশের পাশে। আদম (আ.) কাবার নির্মাণ শুরু করলে, জিবরাঈল (আ.) স্বীয় পাখা দ্বারা জমিনে প্রহার করেন। যার কারণে সপ্ত জমিনের নিচের ভিত্তি প্রকাশ পায়। ফেরেশতাদের সাহায্যে আদম (আ.) লুবনান, তুরে সিনা, তুরে জাইতা, জুদি এবং হেরাসহ পাঁচ পাহাড়ের পাথর দ্বারা কাবা নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। (ইখবারু মাক্কা : ৩৬)।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ আদমের তওবা কবুল করে, মক্কায় যাওয়ার আদেশ করেন। যেহেতু আদম (আ.) হিন্দুস্তানের সিংহল-শ্রীলঙ্কায় অবতরণ করেছিলেন। সেহেতু, আল্লাহ জমিনকে সংকীর্ণ করে দেন এবং সাগর, নদী, সমুদ্র ও সাগর-মহাসাগরকে শুকিয়ে দেন। এরই আগে তিনি আল্লাহর ক্ষমা লাভের জন্য অনেক ক্রন্দন করেছিলেন। তাকে সান্ত¦না দানের নিমিত্তে আল্লাহ জান্নাতি একটি তাঁবু তাকে দান করেন। তিনি সেটিকে মক্কায় কাবার স্থানে স্থাপন করেন। তাঁবুটি জান্নাতের লাল ইয়াকুতের ছিল। তাতে স্বর্ণের তিনটি বাতি ছিল। তার সঙ্গে হজরে আসওয়াদকেও নাজিল করা হয়েছিল। সঙ্গে একটি চেয়ারও ছিল, যেটাতে আদম (আ.) বসতেন (ইখবারু মাক্কা : ৩৭)।
আদম সন্তান শীস কর্তৃক কাবা নির্মাণ : ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ বলেন, হযরত আদম (আ.)-এর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জান্নাতি তাঁবুটি আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়। তখন আদমের সন্তানরা বিশেষত শীস (আ.) সেই স্থানে মাটি পাথরের কাবাঘর নির্মাণ করেন। পরবর্তী প্রজন্মও তা জারি রাখেন। যা নুহ (আ.)-এর প্লাবন পর্যন্ত ছিল। প্লাবনে অন্যান্য সবকিছুর সঙ্গে কাবাঘরটিও ধ্বংস হয়ে যায়। (ইখবারু মাক্কা : ৫১)।
ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক কাবা নির্মাণ : নুহের প্লাবনে কাবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বহুবছর পর আল্লাহ ইবরাহিমকে আদেশ করেন স্বীয় ছেলে ইসমাঈলকে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করতে। তিনি আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলেন, কাবার স্থান চিনব কীভাবে? তখন আল্লাহ মাথাবিশিষ্ট একটি মেঘখণ্ড প্রেরণ করেন। সেই মেঘখণ্ড আওয়াজ দেয়, হে ইবরাহিম! আপনার রব আদেশ করেছেন, এই স্থানে আমার বরাবর কাবা নির্মাণ করতে (ইখবারু মক্কা : ৬০)।
একটি বর্ণনায় এসেছে, ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, একদিন ইবরাহিম (আ.) ছেলে ইসমাঈলকে কুয়ার পার্শ্ববর্তী বিস্তৃত বৃক্ষের নিচে বসা পেলেন। তিনি তাকে সালাম দিয়ে সেখানে বসলেন এবং বললেন, হে ইসমাঈল! আমার রব আমাকে তাঁর জন্য একটি ঘর নির্মাণের আদেশ করেছেন। ইসমাঈল বললেন, তাহলে আপনি আপনার রবের আদেশ পালন করুন। ইবরাহিম (আ.) বললেন, ইসমাঈল! আল্লাহ আদেশ করেছেন, আমরা দুজনেই যেন সেই ঘর নির্মাণ করি। ইসমাঈল বললেন, সেটা কোন স্থানে? তখন ইবরাহিম (আ.) পার্শ্ববর্তী একটি উঁচু টিলার দিকে ইশারা করলেন, যার ওপর নুড়ি পাথরকুচি ছিল যেগুলো স্রোতের কারণে এসেছিল। কিন্তু স্রোত তার ওপর দিয়ে অতিক্রম করত না। অতঃপর তারা ভিত্তি খনন শুরু করেন এবং বলতে থাকেন, রাব্বানা তাকাব্বাল মিন্না ইন্নাকা সামিউদণ্ডদুয়া। কাবার মূলভিত্তি প্রকাশ পেলে তার ওপর নির্মাণকাজ শুরু করেন। ইসমাঈল (আ.) স্বীয় কাঁধে করে পাথর এনে দিতেন আর ইবরাহিম (আ.) তা নির্মাণ করতেন। দেওয়াল উঁচু হয়ে গেলে ইসমাঈল একটি পাথর এনে পিতার পায়ের নিচে দেন। যা মাকামে ইবরাহিম নামে প্রসিদ্ধ (ইখবারু মাক্কা : ৫৮)।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, হজরে আসওয়াদের স্থান পর্যন্ত নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে, ইবরাহিম ইসমাঈলকে বললেন, একটি পাথর খুঁজে নিয়ে এসো। সেটা এখানে স্থাপন করব। যাতে করে মানুষ তাওয়াফের সূচনাস্থল সম্পর্কে জানতে পারে। ইসমাঈল (আ.) চলে গেলে, জিবরাঈল (আ.) হজরে আসওয়াদ নিয়ে উপস্থিত হন। ইসমাঈল এসে জিজ্ঞাসা করেন এটা কোথায় পেলেন? তিনি বললেন, এটা সেই সত্তার পক্ষ থেকে, যিনি এই ঘর নির্মাণে আমার কিংবা তোমার মুখাপেক্ষী নন (ইখবারু মাক্কা : ৬১)।
আমালেকা সম্প্রদায় কর্তৃক কাবা নির্মাণ : হযরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক তৈরিকৃত কাবা ভেঙে গেলে আমালেকা সম্প্রদায় তা পুনর্নির্মাণ করেন (হারামাইনের ইতিহাস : ৬১)।
জুরহাম সম্প্রদায় কর্তৃক কাবা নির্মাণ : আমালেকা সম্প্রদায়ের বানানো কাবা ভেঙে গেলে, হযরত ইসমাঈল (আ.) এর শ্বশুরগোষ্ঠী জুরহাম গোত্র কাবাঘর আবার নির্মাণ করেন (ইখবারু মাক্কা : ৬১)।
কুরাইশ সম্প্রদায় কর্তৃক কাবা নির্মাণ : ইবনে আবি নাজিহ স্বীয় পিতা থেকে বর্নণা করেন, কুরাইশের কিছু লোক মসজিদে হারামে বসা ছিলেন। যাদের মধ্যে হুয়াইতিব ইবনে আব্দুল উজ্জা ও মাখরামা ইবনে নওফেলও ছিলেন। সেখানে কুরাইশরা কাবা নির্মাণ করতে গিয়ে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তার পর্যালোচনা করেন। আগে কাবা কেমন ছিল সে কথাও তারা উল্লেখ করেন। তারা বলেন, পূর্বে কাবাঘর সাদা-স্বচ্ছ শুষ্কপাথরের তৈরি ছিল। যাতে কোনো কাদা ছিল না। তখন তার দরজা ছিল মাটির। ওপরে ছাদ ছিল না। দেওয়ালগুলোতে কাপড় ঝুলানো ছিল। যা কাবার ভেতর থেকে বাঁধা ছিল। কাবার ভেতরে ডান পার্শ্বে একটি গর্ত ছিল। যাতে কাবার সম্পদ, উপঢৌকন রুপে পাওয়া স্বর্ণ-রৌপ্য ইত্যাদি খাজানা আকারে রাখা হত। সেই গর্তে একটি সাপ থাকত, যা জুরহাম গোত্রের সময় থেকে তা পাহাড়া দিচ্ছিল। কারণ এর আগে দুবার কাবার সম্পদ চুরি হয়েছিল। কাবার ভেতরের দেওয়ালে ইবরাহিম (আ.)-এর জবেহকৃত দুম্বাটির সিং লটকানো ছিল। অন্যান্য আরো অনেক স্বর্ণালঙ্কার ঝুলানো ছিল। একবার কাবার পার্শ্বে এক-মহিলাকে প্রস্তারাঘাত করা হয়। সেখানের সৃষ্ট আগুন কাবার কাপড়ে লেগে যায় এবং নিমিষেই গোটা কাবা পোড়ে যায়। কাবা পোড়ে গেলে তার দেওয়ালগুলো আরো দুর্বল হয়ে যায়। সেই বছরেই মক্কায় প্রবল বন্যা দেখা দেয়। বন্যার পানি কাবায় ঢুকে দেওয়াল ভেঙে বের হয়ে যায়। যার কারণে কোরাইশরা আরো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তারা কাবা ভেঙে পুনর্নির্মাণের ইচ্ছা করেন। তবে তারা এ ক্ষেত্রে ভয়ও পাচ্ছিলেন, না জানি এর কারণে কোনো শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। ঘটনাক্রমে সেই সময় রোমানের একটি নৌকা মক্কার ঘাটে ভেঙে যায়। কোরাইশরা তা শুনে ভাঙা নৌকার কাঠগুলো কিনে নেয় এবং তা দ্বারা কাবা নির্মাণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মক্কার সকলে মিলে কাবা নির্মাণের সকল আসবাবপত্র একত্রিত করেন যেখানে নবীজিও অংশগ্রহণ করেছিলেন। কাবা ভাঙার নিয়তে সামনে অগ্রসর হলে, ভেতর থেকে সাপটি বের হয়ে আসে এবং যখনই তারা ভাঙার ইচ্ছা করেন তখনই সাপটি বাঁধা দেয়। কোরাইশরা এমনটা দেখে মাকামে ইবরাহিমে আশ্রয় নেয় এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। হে আল্লাহ যদি আপনি কাবা ভাঙায় সন্তুষ্ট থাকেন, তাহলে আমাদের থেকে এই সাপকে দূর করুন। তখন আসমান থেকে বৃহদাকারের একটি পাখি আসে এবং সাপটিকে ঠোঁটে করে নিয়ে যায়। এরপরেও কোরাইশদের মধ্যে ভয় কাজ করে, যার কারণে কেউ কাবায় হাত দিচ্ছিল না। তখন ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা প্রথম কাবার পাথর সরানো শুরু করেন। মক্কাবাসী যখন দেখল যে, তার কিছু হল না। তখন তারাও একাজে অংশগ্রহণ করেন এবং ইবরাহিম ও ইসমাঈলের ভিত্তি বের করেন। সেটা ভাঙার জন্য আঘাত করলে আলোর বিচ্ছুরণ হয়। যা বিজলীর মতো চমকায়। তখন কুরাইশরা তার ওপরেই তাদের নির্মাণকাজ শুরু করেন। হজরে আসওয়াদ পর্যন্ত নির্মাণের পর দেখা দেয় বিপত্তি। কাবার দেওয়ালে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করা ছিল সম্মানের। এই সম্মান অর্জনে পিছপা হতে কেউ রাজি ছিল না। এক-পর্যায়ে যুদ্ধের পর্যায়ে চলে যায়। রক্তারক্তির উপক্রম হয়ে যায়। তখন নবীজির পরামর্শে একটি কাপড় বিছিয়ে তাতে হাজরে আসওয়াদ রাখা হয় এবং সব গোত্রে সম্মানিত লোকেরা তার কিনারা ধরে হাজরে আসওয়াদকে স্বীয় জায়গা পর্যন্ত নেওয়া হয়। নবীজি স্বীয় হাত দ্বারা তা দেওয়ালে স্থাপন করে দেন। কিন্তু কোরাইশদের হালাল অর্থাভাবের কারণে ইবরাহিম কর্তৃক নির্মিত কাবার কিছু অংশ ছেড়ে দেন। যা হাতিম নামে প্রসিদ্ধ। (ইখরারু মক্কা : ১৫৯)।
আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর কর্তৃক কাবা নির্মাণ : ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া ইসলামিক সম্রাজ্যের আমির পদে সমাসীন হলে, আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.) তার বাইয়াত অস্বীকার করে মক্কায় চলে আসেন। মক্কাবাসী তার কাছে বাইয়াত হন। মদিনা থেকেও ইয়াজিদের প্রতিনিধিকে বের করে দেওয়া হয়। তা শুনে ইয়াজিদ মুসলিম ইবনে উকবা মুররিকে প্রধান করে মদিনাবাসীর বিপক্ষে যুদ্ধে করে মক্কায় আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাহিনী প্রেরণ করেন। মুসলিম অসুস্থ ছিল বিধায় ইয়াজিদ এই আদেশও দেন যে, তুমি মৃত্যুবরণ করলে দায়িত্ব হুসাইন ইবনে নুমাইর আল-কিন্দিকে দেবে। মুসলিম মদিনা বিজয়ের পর মক্কার দিকে রাওয়ানা করেন। পথিমধ্যে তার অবস্থা বেগতিক হলে হুসাইনকে দায়িত্ব দেন এবং তিনি ইন্তেকাল করেন। হুসাইন ইবনে নুমাইর মক্কায় পৌঁছে বাধার সম্মুখীন হলে, জাবালে আবি কুবাইস ও জাবালে আহমারে ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করে মক্কায় পাথর নিক্ষেপ করেন। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত কাবাঘরেও লাগে, যার কারণে কাবার কাপড় ছিড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। লাগাতার আক্রমণে কাবার দেওয়াল দুর্বল হয়ে যায়। আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের এক সৈনিক কাবার পাশেই একটি তাঁবুতে আগুন জ্বালালে সেই আগুন কাবায় লাগে এবং কাবা জ্বলে যায়। যার ফলশ্রুতিতে কাবার দেওয়াল খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। এমন কি ওপরের অংশ নিচে খসে খসে পড়তে থাকে। এতে মক্কা ও শামবাসী সকলেই ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়েন। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর একটি প্রতিনিধি দল হুসাইন ইবনে নুমাইরের কাছে প্রেরণ করেন। তারা তাকে বোঝান যে, আপনাদের পাথরের আঘাতের কারণে কাবার এই অবস্থা। তারা আরো বলেন, ইয়াজিদ তো ইন্তেকাল করেছেন। তোমরা বরং শামে ফেরত যাও এবং নতুন আমির মুয়াবিয়া ইবনে ইয়াজিদ কি হুকুম দেন তার অপেক্ষা কর। হুসাইন ইবনে নুমাইরের বাহিনী চলে গেলে, ইবনে জুবাইর মক্কার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ডাকেন এবং কাবা ভেঙে পুনর্নির্মাণের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। ইবনে আব্বাস তার কঠোর বিরোধিতা করেন। ইবনে জুবাইর বলেন, আল্লাহর কসম আমি আল্লাহর ঘর এমন বেহাল অবস্থায় থাকতে দিতে পারি না। শেষে কাবা ভাঙার ব্যাপারে সবাই ঐকমত্য পোষণ করলে, কুরাইশরা যেখান থেকে পাথর এনেছিল, সেখান থেকে পাথর সংগ্রহ করা হয়। ইয়ামেনের সানআ থেকে উন্নত মানের সুরকি-প্লাস্টার, জিপসাম আনা হয়। কাবা ভাঙার আগে মক্কাবাসী মক্কা থেকে বের হয়ে যায় এবং তিন দিন বাইরে থাকেন আজাবের ভয়ে। ইবনে জুবাইর বলেন, আমি আয়েশা (রা.) থেকে শুনেছি, নবীজি বলেছেন, কাবা নির্মাণের ক্ষেত্রে তোমার জাতি ব্যয় বহন করতে না পারায় একটা অংশকে ছেড়ে দিয়েছে। মানুষের ফেতনার ভয় না থাকলে আমি তা পুনর্নির্মাণ করতাম। হাতিমকে কাবার অন্তর্ভুক্ত করতাম এবং কাবার দুটি দরজা করতাম। ইবনে জুবাইর নবীজির ইচ্ছানুযায়ী হাতিমকে কাবার অন্তর্ভুক্ত করেন এবং কাবার দুটি দরজা করেন। চৌকাঠ মাটির সঙ্গে করে দেন, যাতে লোকেরা একদিক দিয়ে প্রবেশ করে অন্য দিকে বের হতে পারে (ইখবারু মাক্কা : ২০৬)।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কর্তৃক কাবা নির্মাণ : আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান ইসলামিক সম্রাজ্যের খলিফা নিযুক্ত হলে, হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে মক্কায় নিযুক্ত করেন। ইবনে জুবাইরের সঙ্গে যুদ্ধ হলে, হাজ্জাজ তাকে পরাজিত করে শহিদ করে দেয়। মক্কায় প্রবেশ করে সে আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের কাছে লিখে পাঠান, ইবনে জুবাইর কাবায় এমন কিছু সংযোজন করেছেন, যা আগে ছিল না এবং নতুন একটি দরজা বানিয়েছে। আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান তাকে লিখে পাঠান যে, নতুন দরজাটি যেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। হাতিমের অংশটি যেন ভেঙে দেয়া হয় এবং সব কিছু যেন পূর্বের মতো করা হয়। হাজ্জাজ পুনরায় কাবাকে ভেঙে কোরাইশদের মত করে তৈরি করে। বর্তমানেও সেই অবস্থায়ই আছে। (ইখবারু মক্কা:২১০)।
লেখক : খতিব, বাইতুল আজিম জামে মসজিদ রংপুর