কোরবানি এবং হত্যা : লেটার বাই এ ব্রেভ গার্ল!
সুমাইয়া জহির
প্রকাশ : ১০ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
‘ইশ! কতো মর্মান্তিক। কী দরকার, এভাবে পশুদের হত্যা করা! মানুষ কতো বেশি নিষ্ঠুর হলে এভাবে প্রাণীদের জবাই করতে পারে... ‘বিখ্যাত জার্নালিস্ট অনুপমা মুখার্জী মুসলমানের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহার দিনে কোরবানির পশু জবাইয়ের বিভিন্ন ছবি কালেক্ট করে এই ক্যাপশনটা লিখে ফেসবুকে পোস্ট দিল। একটা প্রখ্যাত টেলিভিশন চ্যানেলের চিফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত থাকার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও তিনি জড়িত। অনলাইন-অফলাইনে ‘পশু প্রেমিক’ হিসেবে বেশ ভালোই পরিচিতি আছে তার। বাসা ভর্তি কুকুর-বিড়াল। তার প্রিয় কুকুর শেফার্ডের সঙ্গে ফেসবুকে প্রায়ই ছবি আপলোড করতে দেখা যায়। এ ছাড়াও তিনি মাঝেমধ্যে রাস্তায় ক্ষুধার্ত মানুষকে উপেক্ষা করে ক্ষুধার্ত কুকুরকে খাবার বিতরণ করেন! পশুদের প্রতি এ রকম ভালোবাসা (?) থেকেই গত কয়েক বছর ধরে তিনি কোরবানিতে পশু জবাইয়ের ঘোর বিরোধিতা করে আসছেন। ঈদুল আজহার কয়েক দিন আগে থেকেই তার ফেসবুকে ‘কোরবানিতে নির্মমভাবে পশু জবাই বন্ধ হোক’- এরকম ক্যাম্পেইন চলতে থাকে। সাইফার এক ফ্রেন্ডের মাধ্যমে সে অনুপমা মুখার্জীর ফেসবুক অ্যাকাউন্টের এসব ক্যাম্পেইনের লিংক পেয়েছিল। ফেমাস জার্নালিস্ট হওয়ার কারণে তার নাম সে আগেই শুনেছে। কিন্তু তিনি যে মুসলমানদের এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ের বিপক্ষে এতো জঘন্যভাবে ক্যাম্পেইন চালাবেন, সাইফা সেটা চিন্তাও করেনি। হোক তিনি অমুসলিম; কিন্তু পত্রিকায় তার আর্টিকেল কিংবা অন্যান্য লেখা পড়ে সাইফা ভেবেছিল তিনি অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন। কিন্তু নিজের এই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় সাইফা মন খারাপ করার চেয়েও আতঙ্কিত হলো বেশি।
অনুপমা মুখার্জীর এতো ফ্যান-ফলোয়ার - এর মধ্যে একটা মুসলমানও যদি তার কথা শুনে বিভ্রান্ত হয়ে যায়, কোরবানিকে নির্মম হত্যাযজ্ঞ মনে করে, কথিত পশু প্রেমিক হতে গিয়ে ইসলামবিরোধী হয়ে যায়, তাহলে দিন শেষে তো ক্ষতিটা ইসলামেরই হবে। অনেক ভেবেচিন্তে সাইফা ঠিক করল, এই ব্যাপারগুলো নিয়ে সে অনুপমা মুখার্জীকে একটা চিঠি লিখবে। এই ডিজিটালাইজেশনের যুগে চিঠি লিখবে- এটা ভেবে প্রথমে সাইফার নিজের কাছেই কেমন যেন লাগল। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, এসব সেলিব্রিটিদের কাছে ইনবক্স করলে সেটা আনসিন অবস্থায় পড়ে থাকার সম্ভাবনাই ৯৯.৯৯ শতাংশ। সাইফার কাছে ই-মেইলের অপশনটাও ছিল; কিন্তু সে ক্ষেত্রে একই পরিণতি হতে পারে। তা ছাড়া সে অনুপমা মুখার্জীর কাছে নিজের পরিচয়টা প্রকাশ করতে চাইছিল না। তার মনে হয়েছে, অনুপমা মুখার্জীর নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনলাইন-অফলাইনে এসব প্রচারণা বন্ধ করাটাই আসল, চিঠির প্রেরক সম্পর্কে জানার কী দরকার? অনুপম মুখার্জীর বেড সাইড টেবিলে সকাল ৮টার মধ্যে দুটি জিনিস উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক। তার ফেভারিট মগে এক মগ ধোঁয়া উঠা চা আর দেশের শীর্ষস্থানীয় নিউজ পেপার। হাউজ মেইড আজকে এই দুটি জিনিসের সঙ্গে একটা সাদা ইনভেলপ এনে টেবিলে রাখল। ৮টা ১৫ মিনিট এলার্মে ঘুম ভাঙল অনুপমা মুখার্জীর। বেড সাইড টেবিল থেকে চায়ের মগ নিতে গিয়ে পাশে রাখা ইনভেলফটার দিকে চোখ আটকে গেল। এই ডিজিটালাইজেশনের যুগে চিঠি পাঠাবে কে! তিনি একটু কৌতূহলী হয়ে গেলেন। একটু ঝুঁকে প্রাপকের এড্রেসটা পড়ে নিলেন। একদম স্পষ্ট অক্ষরে তার নিজের বাড়ির ফুল এড্রেস লেখা আছে সেখানে। আর এই চিঠি তার জন্য পাঠানো না হলে হাউজ মেইড এটা কক্ষনোই তার বেড সাইড টেবিলে রাখার সাহস করত না। তিনি তার সকালের ‘মহা গুরুত্বপূর্ণ’ দুই জিনিস-চায়ের মগ আর নিউজ পেপারকে উপেক্ষা করে ইনভেলফ ছিঁড়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন- ‘কোনো সম্ভোধন ছাড়াই চিঠি শুরু করলাম- কেন এটা ভেবে অবাক হচ্ছেন? আসলে আপনাকে ঠিক কি বলে সম্ভোধন করব, এটা ভেবে আমি কনফিউসড। ‘বোন’ বলতে পারছি না, কারণ আপনি বয়সে প্রায় আমার মায়ের বয়সি। সে হিসেবে আপনাকে ‘আন্টি’ বলতে পারতাম; কিন্তু আমি জানি, আপনারা এই বয়সে এসেও আন্ট্রি ডাকটা ঠিক হজম করতে পারেন না। সবকিছু ছেঁড়েছুঁড়ে ভেবেছিলাম ‘ম্যাম’ বলেই ডাকব, যেটা আপনারও অনেক পছন্দ হবে। কিন্তু জানেন? আপনাকে ম্যাম বলে ডাকতে আমার রুচিতে বাঁধছে। প্লিজ, হোল্ড! রাগ করে এখনি চিঠিটা পড়া বন্ধ করে দেবেন না। কোরবানির পশু জবাইয়ের বিপক্ষে আপনার ক্যাম্পেইন বন্ধ করতে আমি আপনাকে জ্ঞান কিংবা হুমকি কোনোটা দিতেই এই চিঠি লিখছি না।
আমি জানি, আপনার পার্থিব জ্ঞানের ভান্ডার আমার চেয়েও অনেক অনেক বেশি সমৃদ্ধ। সে জন্যই আমার বিশ্বাস! খুব সহজেই আপনার মধ্যে ‘আত্মণ্ডউপলব্ধি’ জেগে উঠার সম্ভাবনা আছে। যে আপনি কোরবানির সময়ে পশু জবাইয়ের বিপক্ষে অবস্থান করেন, সে আপনিই তো আবার দুর্গা পূজার সময় স্লোগান তোলেন, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার! আপনাকে শুধু কেন একটা উৎসবেই ধর্মীয় নিরপেক্ষবাদী হিসেবে দেখা যায়? কোরবানির ইতিহাস, এটা মুসলমানের জন্য কেন এতো তাৎপর্যপূর্ণ, এটা কি ওয়াজিব না সুন্নাত- এ বিষয়গুলো আপনাকে ধারাবাহিকভাবে বললে আসলে কোনো ফায়দা হবে বলে মনে হয় না। বরং ক্ষতি হতে পারে একটু, আপনি এই তথ্য উপাত্তগুলোকে বিকৃত করে কোরবানির বিপক্ষে আর জোরালোভাবে ক্যাম্পেইন চালাবেন। আপনার ফেসবুক পোস্টে দেখলাম, কোরবানিতে পশুর গলায় ছুঁড়ি চালানোর দৃশ্য দেখলে আপনার কলিজা কেঁপে উঠে! আপনার কাছে একটা প্রশ্ন, সারা বছর বিফ রেজালা, বিফ বিরিয়ানি, মাটন রেজালা- এসব মজাদার খাবারগুলোতে যে পশুর গোস্ত ব্যবহৃত হয়, সেসব পশু থেকে কি জবাই ছাড়াই গোস্ত কেটে নেওয়া হয়? রক্তাক্ত পশু দেখলে খুব বেশি খারাপ লাগে?
পুরো ব্যাপারটা চরম মর্মান্তিক মনে হয়? তাহলে আপনাদের মতো ‘মানবতাবাদীদের’ (?) কাছেই জিজ্ঞাসা, রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে রক্তাক্ত অবস্থায় জীবন্ত ‘মানুষের বাচ্চা’ গুলোকে দেখলে আপনাদের এই খারাপ লাগা কোথায় উধাও হয়ে যায়? আপনারা হসপিটালে-ক্লিনিকে অপরিণত ‘মানুষের বাচ্চা’ হত্যা করা জায়েয হিসেবে রায় দেন; কিন্তু পশুর গলায় ছুঁড়ি চালানো দেখলে মায়া কান্না কাঁদেন! আমি জানি না, আমার এই চিঠি লেখার মেইন উদ্দেশ্য পূরণ হবে কি না; কিন্তু একদিন ঠিকই আপনি আপনার ভুলও বুঝতে পারবেন। কিন্তু আফসোস হচ্ছে, সেদিন এই আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে আপনার বিন্দুমাত্র উপকার হবে না। আমি কোরবানির বিপক্ষে আপনার এই প্রচারণা শুধু বন্ধই করতে বলব না, এই প্রচারণা একদম ‘সমূলে উৎপাটন’ করতে বলব! আর এসব ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে এতোদিন যাদের ব্রেইন ওয়াশ করেছেন, তাদেরও এই চিঠিটা পড়ার সুযোগ করে দেবেন। - ইতি, রবের কাছে আত্মসমর্পিত এক মুসলিমাহ। চিঠি পাঠানোর তিন-চার দিন পর সাইফা অনুপমা মুখার্জীর আইডিতে ঢুঁ মারল। সেখানে সেকেন্ড পোস্টেই সাইফা নিজের লেখা পুরো চিঠিটার ছবি দেখতে পেল। সঙ্গে ক্যাপশন দেয়া আছে- ‘এক সাহসী মেয়ের বেনামী চিঠি। আই এপ্রিশিয়েট হার থট অ্যান্ড লজিক। ‘Letter By A Brave Girl’সাইফা একটু নিচের দিকে গিয়ে দেখল গত সপ্তাহজুড়ে অনুপমা মুখার্জীর প্রোফাইলে কোরবানির বিপক্ষে যতো প্রচারণা চালানো হয়েছিল, পোস্ট দেওয়া হয়েছিল- সেগুলো সব উধাও! একটু মুচকি হেসে সাইফা মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল- ‘আলহামদুলিল্লাহ’।