হিজরি বর্ষপঞ্জির দ্বাদশ ও সর্বশেষ মাস হলো- ‘যুল হিজ্জাহ, যাকে সাধারণ মানুষ জিলহজ মাস নামে চেনে। যুল হিজ্জাহ কোরআনে বর্ণিত চারটি সম্মানিত মাসের একটি মাস। এই মাসকে হজের মাসও বলা হয়। মূলত হজের মাস হলো- শাওয়াল, যুল কাদা ও যুল হিজ্জাহ এই তিনটি। তবে এই তিনটির মধ্যে প্রধান মাস হলো- যুল হিজ্জাহ। কারণ, হজের মূল কার্যক্রমগুলো এই মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যেই সম্পাদন করতে হয়। এই কারণেই এই মাসকে যুল হিজ্জাহ তথা হজওয়ালা বলে অভিহিত করা হয়। ৪১২ খ্রিষ্টাব্দে কিলাব ইবনে মুররা’র সময়ে এই মাসের এই নামকরণ করা হয়েছে।
উল্লিখিত দুটি কারণ ছাড়াও আরো বেশ কিছু কারণে এই মাস গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এই মাসের প্রথম দশক খুবই ফজিলতসমৃদ্ধ। কোরআনুল কারিমের সুরা ফজরের শুরুতে আল্লাহতায়ালা যুল হিজ্জাহ মাসের প্রথম দশক উচ্চারণ করে শপথ করেছেন, যাতে এ সময়ের গুরুত্ব সহজেই প্রতীয়মান হয়। আল্লাহতায়ালা তাঁর কোনো বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য ও দৃঢ় করার জন্য শপথ করার প্রয়োজন নেই, কারণ তার সব বক্তব্যই সর্বোচ্চ সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য। তারপরও তিনি যখন কোনো বিষয়ের নাম নিয়ে শপথ করেন, তখন সেই বিষয়টির নিজস্ব গুরুত্ব প্রকাশিত হয়। এই শপথের মধ্য দিয়ে যুল হিজ্জার প্রথম দশকের গুরুত্ব সহজেই অনুমান করা যায়। এই জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যুল হিজ্জাহর প্রথম দশকের চেয়ে কোনো দিনই আল্লাহর কাছে উত্তম নয়’। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ২৮৪২)। তাছাড়া এই দশকের দশম দিনে মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহাও পালিত হয়। আবার সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলিম নর-নারী এদিন আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আদর্শ অনুসরণে নির্ধারিত পশু কোরবানিও করে থাকে। এই দশকের নবম তারিখ ‘ইয়ামু আরাফা’। এই দিনে রোজা রাখার রয়েছে আলাদা ফজিলতও। ইবাদতের বিবেচনায় এই দশকের প্রতিটি দিন ও রাতের রয়েছে আলাদা বিশেষত্ব। একটি হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যুল হিজ্জাহ মাসের প্রথম দশকের প্রতিটি দিনের রোজা পূর্ণ ১ বছর রোজার সমতুল্য, আর প্রতি রাতের নাফল ইবাদত লাইলাতুল কদরের নাফল ইবাদতের সমতুল্য।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৭৫৮)।
আরেকটি হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এই ১০ দিনের নেক আমলের চেয়ে আর কোনো সময়ের নেক আমল আল্লাহতায়ালার কাছে এত অধিক প্রিয় নয়। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন- হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর রাহে জিহাদ করাও কি নয়? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- না, আল্লাহর রাহে জিহাদ করাও নয়, তবে কোনো ব্যক্তি যদি তার প্রাণ এবং সম্পদ নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়, আর তার কোনোটি নিয়ে যদি ফিরে না আসে (অর্থাৎ শহিদ হয়ে যায়) সেই ব্যক্তির আমলই শুধু এরচেয়ে উত্তম হতে পারে।’ (বোখারি, হাদিস : ৯৬৯; সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৭৫৭)। বহুবিধ কারণে ইসলামে যুল হিজ্জাহ মাসের প্রথম দশক অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। অতএব, প্রতিটি মুসলিমের উচিত এই সময়গুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে তা কাজে লাগানো, ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে এই মাসকে বিশেষ করে এই মাসের প্রথম দশকের ঘোষিত সকল ফজিলত অর্জন করা। তবে কোরআন ও নবীজির পবিত্র সুন্নাহতে এই দশকে কয়েকটি বিশেষ আমলের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা এখন সে আমলগুলো নিয়ে আলোচনা করব :
০১. নখণ্ডচুল-মোচ না- কাটা : যুল হিজ্জাহ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কোরবানি করার আগ পর্যন্ত নিজের নখণ্ডচুল-মোচ ও নাভীর নিচের পশম ইত্যাদি না-কাটা বা না-উপড়ানো। এটি এই সময়ের একটি ফজিলতসমৃদ্ধ নফল আমল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘তোমরা যদি যুল হিজ্জাহ মাসের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ কোরবানি করার ইচ্ছা করে, তবে সে যেন নিজের চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৯৭৭)।
যে ব্যক্তি কোরবানি করবেন তার জন্য যেমন এটি আমলযোগ্য, আবার যিনি কোরবানি করবেন না, তার জন্যও এটি আমলযোগ্য। একটি হাদিসে এসেছে, জনৈক কোরবানির সামর্থ্যহীন ব্যক্তিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘চাঁদ দেখা যাওয়ার পর থেকে কোরবানির আগ পর্যন্ত কোনো ক্ষৌরকর্ম না করে) ঈদের দিন তুমি তোমার চুল কাটবে, নখ কাটবে, মোচ ছাঁটবে, নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটিই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কোরবানি বলে গণ্য হবে।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৭৭৩)।
০২. এক থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত রোজা রাখা : ঈদের দিন ছাড়া যুল হিজ্জাহ মাসের প্রথম দশকের বাকি ৯ দিন রোজা রাখা হলো এই দশকের আরেকটি ফজিলতপূর্ণ আমল। হাদিসে এসেছে- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ৯ দিন রোজা রাখতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৩৭)। আরেকটি হাদিসে এসেছে, হজরত হাফসা (রা.) বলেছেন, ‘চারটি আমল নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো ছাড়তেন না- ১. আশুরার রোজা, ২. যুল হিজ্জাহর প্রথম দশকের রোজা, ৩. প্রতি মাসের ৩ দিনের রোজা এবং ৪. ফজরের ফরজের আগে দুই রাকাত সুন্নাত নামাজ’। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৬৪২২; সুনানে নাসাই, হাদিস : ২৪১৫)। তবে এই দশকের নবম দিন তথা ‘ইয়াওমে আরাফা’-তে রোজা রাখার ব্যাপারে আলাদা ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আরাফার দিনের রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহতায়ালার কাছে আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা বিগত ১ বছরের এবং আগামী ১ বছরের অগ্রিম গোনাহ মিটিয়ে দেবেন’। (মুসলিম, হাদিস : ১১৬২; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৪২৫)।
আরেকটি হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আরাফার দিনে রোজা রাখবে, তার লাগাতার ২ বছরের গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস : ৭৫৪৮)। পুরো ৯ দিন রোজা রাখা কারও পক্ষে সম্ভব না হলে অন্তত এই ইয়ামু আরাফা তথা নবম দিবসের রোজার ব্যাপারে কারোরই উদাসীন থাকা উচিত নয়।
০৩. জিকির করা : আগেই বলেছি, এই দশকের নেক আমলের চেয়ে আল্লাহতায়ালার কাছে অন্য কোনো সময়ের নেক আমল এত প্রিয় নয়। এই সময়ে উপরোক্ত দুটি আমলের সঙ্গে সঙ্গে জিকিরের আমলের কথাও পাওয়া যায়। কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘সুনির্দিষ্ট দিনগুলোতে তারা যেন আল্লাহতায়ালার নাম স্মরণ করে তার দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময়’ (সুরা হাজ্জ, আয়াত : ২৮)। এই আয়াতে ‘সুনির্দিষ্ট দিনগুলো’ বলতে যুল হিজ্জাহর প্রথম দশক উদ্দেশ্য। (বোখারি : ১/১৩২) ইবনে আব্বাস (রা.)সহ সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের তাই মত। ইমাম ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, এই আয়াত দ্বারা আল্লাহতায়ালার জিকির করা শুধু পশু জবেহ করার সময়ই নির্দিষ্ট নয়, বরং এই দশকের অন্য সময়ও আল্লাহতায়ালার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা উদ্দেশ্য। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ২৮৯)।
একটি হাদিসে এর সমর্থনে পাওয়া যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা এই দশকে বেশি পরিমাণে তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ), তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাকবির (আল্লাহু আকবার) পাঠ করো।’ ( মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৫৪৪৬)। তাছাড়া এই মাসের ১১ থেকে ১৩ তারিখণ্ড এই ৩ দিনকে বলা হয় ‘আইয়ামুত তাশরিক’। এই দিনগুলোতেও জিকির করার ব্যাপারে আলাদা নির্দেশ এসেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহকে (বেশি বেশি) স্মরণ করো’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২০৩)।
এই আয়াতে ‘নির্দিষ্ট দিন’ বলতে আইয়ামে তাশরিক তথা ১১, ১২ ও ১৩- এই ৩ দিনকে বোঝানো হয়েছে। (বোখারি : ১/১৩২)।
০৪. রাত্রীকালীন ইবাদত : বক্ষ্যমাণ আলোচনার শুরুতে একটি হাদিস উল্লেখ করেছিলাম (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৭৫৮), তাতে বলা হয়েছিল- ‘এই দশকের প্রতি রাতের নাফল ইবাদত লাইলাতুল কদরের নাফল ইবাদতের সমতুল্য।’ এই হিসেবে লাইলাতুল কদর তুল্য প্রতিটি রাতেই তাহাজ্জুদসহ আলাদা কিছু নাফল ইবাদতের ব্যাপারে যত্মবান হওয়া উচিত।
০৫. তাকবিরে তাশরিক : যুল হিজ্জাহর ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত মোট ৫ দিন ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পরে জামায়াতে বা একাকী আদায়কারী সকল নারী-পুরুষ মুসল্লির তাকবিরে তাশরিক বলা বহুল গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। এটি বিধানগত দিক থেকে ওয়াজিব। বিভিন্ন হাদিসে তাকবিরে তাশরিকের বিভিন্ন শব্দ এসেছে, তবে সর্বোত্তম ও সর্বজনবিদিত শব্দ হলো- (আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ) (ইলাউস সুনান : ৮/১৪৮)।
আসলে যুল হিজ্জাহ এমনিতেই শাহরুল হারাম তথা চার সম্মানিত মাসের অন্তর্ভুক্ত। এই চারটি মাসে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা এবং ইবাদতের প্রতি মনোযোগী হতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এই মাসগুলোতে ইবাদত না করাকে ‘নিজের ?ওপর জুলুম করা’ হিসেবে কোরআনে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সুরা তাওবা, আয়াত : ৩৬।
উপরন্তু এই মাসেই রয়েছে ফজিলতপূর্ণ ‘আইয়ামুল আশর’ তথা যুল হিজ্জার প্রথম দশক, ইয়াওমুত তারবিয়া (৮ তারিখ), ইয়ামু আরাফা, হজ্জ, ঈদুল আজহা, কোরবানি, আইয়ামুত তাশরিক ইত্যাদি। অতএব, প্রতিটি মুসলিমের উচিত বহুবিধ ফজিলতময় এই সময়গুলো রোজা, ব্যক্তিগত নাফল আমল, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকারের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করা। বিশেষ করে হাটে-ঘাটে সর্বত্র তাকবির ধ্বনির মাধ্যমে তাওহিদি চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে জীবনকে পরিশুদ্ধ করা খুবই প্রয়োজন। আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষাসচিব ও মুহাদ্দিস, আয়েশা সিদ্দিকা মহিলা মাদ্রাসা, কমপ্লেক্স, ৪৬২/১, ইপিজেড রোড, কুমিল্লা।