শুরু হয়েছে পবিত্র জিলহজ মাস। এ মাস হজের মাস। কোরবানির মাস। কোরবানি জিলহজ মাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত ও অন্যতম ইসলামি নিদর্শন। মানবজাতির প্রাচীন ইতিহাস থেকেই কোরবানির রীতি চলে আসছে। আদম পুত্র হাবিল-কাবিলের কোরবানি থেকেই এর প্রচলন। ধারাক্রমে প্রত্যেক শরিয়তেই কোরবানির বিধান ছিল একটি গুরুত্বপূর্র্ণ অংশ। বর্তমানে আমরা যে কোরবানি করি তা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কোরবানির অনুসরণে করে থাকি। প্রশ্ন হলো- কোরবানি আমরা কেন করব? কোন উদ্দেশ্যে করব? শুধু সামাজিক রীতি পালন ও লোক দেখানোর জন্য কোরবানি করব? না কোরবানির মাধ্যমে মনের পশুকে বধ করে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করব? কোরবানির কী উদ্দেশ্য সংক্ষেপে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা : কোরবানি শব্দটি কুরবানুন থেকে উৎসারিত। কুরবান বলা হয় প্রত্যেক এমন বস্তুকে, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। জবাই করা পশু হোক বা অন্য কিছুর মাধ্যমে। (আল মুনজিদণ্ড৬১৭)। পরিভাষায় কোরবানি বলা হয়, নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট পশু নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য আল্লাহর নামে জবাই করা। (ফতোয়া শামী : ৫/২১৯)। মানুষ আমাকে বড় কোরবানিদাতা বলবে, প্রতি বছরই কোরবানি করি, এই বছর না দিলে কেমন হয়? লোকে কী বলবে? সামনে অনুষ্ঠান, গোশত তো লাগবেই, এসব কোরবানি বিনষ্টকারী মন্তব্য পরিহার করে একনিষ্ঠতার সঙ্গে কোরবানি করতে হবে। নামাজ যেমন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই পড়া হয়, তদ্রূপ কোরবানিও করা হবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই। আল্লাহতায়ালা বলেন, (হে নবী) অতঃপর আপনি আপনার রবের জন্য নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন। (সুরা কাউসার : ২)। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, হে নবী আপনি (মানুষদের) বলে দিন (তারা যেন এই কথার স্বীকার করে নেয়) নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন এবং আমার মরণ (সব) আল্লাহর জন্য, যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক। (সুরা আনআম : ১৬২)।
সওয়াব অর্জনের জন্য : কোরবানির দিনসমূহে (১০, ১১, ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত) কোরবানি ছাড়া অন্য কোনো ইবাদত সওয়াবের দিক দিয়ে কোরবানির সমান হতে পারে না। কারণ আল্লাহতায়ালা প্রতিটি কোরবানির পশুর পশম পরিমাণ নেকি কোরবানিদাতাকে সওয়াব হিসেবে দিয়ে থাকেন। ভাবা যায়, একটি পশুতে কী পরিমাণ পশম! গুনে শেষ করতে পারবে কেউ? হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, কোরবানির দিনে বনি আদম এমন কোনো কাজ করতে পারে না, যা আল্লাহর কাছে রক্ত প্রবাহিত করা অপেক্ষা অধিক প্রিয়তর হতে পারে। কোরবানির পশু, সেগুলোর শিং, পশম ও তার খুরসহ কেয়ামতের দিন এসে উপস্থিত হবে এবং কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর দরবারে সম্মানিত স্থানে গিয়ে পৌঁছে। সুতরাং তোমরা প্রফুল্লচিত্তে কোরবানি করো। (শুআবুল ঈমান-৯/৪৪৮ হাদিস : ৬৯৫১)।
কঠিন হুঁশিয়ারি থেকে বাঁচতে : প্রতিটি স্বাধীন জ্ঞানসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্ক মুকিম ধনী মুসলমান নর-নারীর ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। তাই দায়িত্ব মুক্তির জন্য হলেও কোরবানি আবশ্যক। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ কোরবানি না করে, তার ব্যাপারে হাদিসে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করেনি, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটে না আসে। (শুআবুল ঈমান, ৯/৪৪৯)।
চিত্ত-বিত্তের মেলবন্ধনের লক্ষ্যে : ভাবতে হবে সদা, আল্লাহতায়ালা আমাকে কত শত নেয়ামতের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছেন। সেই মহান রবের তরে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু সন্তানের পরিবর্তে আল্লাহর দেওয়া সম্পদ থেকে একটি প্রাণীই তো কোরবানি করব। তাই কীসের কৃপণতা? তাই পশু কোরবানি করে এক-তৃতীয়াংশ গোশত উদারমনে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে বিলিয়ে দেব। শরিয়তে গোশত বণ্টনের এ নিয়মটি মুস্তাহাব। আমাদের আশপাশে একটু চোখ মেলে তাকালে দেখা যাবে, কত মানুষ সর্বশেষ কবে গোশত খেয়েছিল জানা নেই। গত কোরবানিতে অনেকের ভাগ্যে সামান্য জুটেছিল। প্রকৃত কোরবানিদাতা কখনোই দরিদ্রদের বঞ্চিত করতে পারে না। কোরবানি একটি ইবাদত পাশাপাশি সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করার একটি অন্যতম মাধ্যম। কোরবানি করে গরিব মানুষকে, প্রতিবেশী ও স্বজনকে নিজের কোরবানির গোশত দিয়ে আপ্যায়ন করার মধ্যে এক অন্যরকম সুখময় অনুভূতি রয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন এবং কাবার জন্য উৎসর্গকৃত উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের জন্য মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে বাঁধাবস্থায় তাদের জবাই করার সময় তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। অতঃপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায়, তখন তা থেকে তোমরা আহার করো এবং আহার করাও তাকে, যে কিছু হাত পেতে চায় না এবং যে হাত পেতে চায় তাকে। এমনিভাবে আমি এগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি। যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (সুরা হজ, আয়াত : ৩৬)।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া ইবনে আব্বাস (রা.), সামান্তপুর জয়দেবপুর, গাজীপুর সিটি।