বরিশাল বিভাগের ঐতিহাসিক মসজিদসমূহ

আবদুল্লাহ নুর

প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দক্ষিণবঙ্গের রূপ-যৌবনে টইটম্বুর একটি বিভাগের নাম বরিশাল। নদনদী, খালবিল ও নান্দনিক স্থাপনায় সাজানো এ বিভাগ। বরিশাল, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, ভোলা ও পটুয়াখালী জেলা নিয়ে বৃহত্তর এ বিভাগটি গঠিত। আদিকাল থেকেই এ বিভাগের প্রতিটি জেলা মুসলমানের বসবাসের নগরী ছিল। অনেক মুসলিম শাসক বিভিন্ন জায়গায় রাজত্বও করেছেন। এর প্রমাণ হিসেবে আদিকালের পুরান মসজিদগুলো সাক্ষ্য বহন করে আসছে। নিচে বরিশাল জেলার ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর পরিচয় তুলে ধরা হলো-

বরিশালের ঐতিহাসিক মসজিদ, কসবা মসজিদ বা আল্লাহর মসজিদ : বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার কসবা নামক গ্রামে অবস্থিত। বাগের হাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের মতো এ মসজিদের বড় বড় ৯টি গম্বুজ রয়েছে। এর প্রতিটি বাহু ১৬.৯৬ মিটার দীর্ঘ এবং দেওয়ালগুলো প্রায় ২.১৮ মিটার চওড়া। মসজিদের আয়তন ১১.৬৮ মিটার। মসজিদের দরজা ও মিহরাবে রয়েছে পোড়ামাটির বুটিদার নকশা, খাঁজকাটা হীরক আকৃতির নকশা, প্যাঁচানো নকশা, শিকল নকশা এবং গোলাপ নকশা। যা কালের সাক্ষী হিসেবে এখনো বিদ্যমান রয়েছে। মসজিদের সামনে একটি ছোট পুকুরও রয়েছে, যা এখন শুকিয়ে গেছে। ধারণা করা হয়, এ পুকুরটি মুসল্লিদের অজু করার জন্য খনন করা হয়েছিল।

এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা বা প্রতিষ্ঠার সন সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। তবে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে কসবা এলাকাকে চাষাবাদের উপযোগী করতে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করার সময় এ মসজিদের সন্ধান পায়। তারপর থেকেই এ মসজিদকে ‘আল্লাহর মসজিদ’ বলা হয়। কোনো কোনো প্রত্নতাত্ত্বিকবিদ বলেন, ‘সাবহি খান নামক এক ব্যক্তি ষোল শতকের প্রথমদিকে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। তবে, নির্মাতার আর কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না।’ কেউ কেউ এ কথাও বলেন যে, মসজিদের গম্বুজগুলো বাগের হাটের খান জাহান আলী প্রতিষ্ঠিত ষাট গম্বুজের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। তাই ধারণা করা যেতে পারে, তিনি বা তার কোনো মুরিদ এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। (সূত্র : সরেজমিন ভ্রমণ ও উইকিপিডিয়া)।

পিরোজপুরের ঐতিহাসিক মসজিদ, কাঠ মসজিদ : পিরোজপুরের উত্তরে গোপালগঞ্জ, দক্ষিণে বরগুনা, পূর্বে ঝালকাঠি ও পশ্চিমে বাগেরহাট জেলা অবস্থিত। বলেশ্বর, সন্ধ্যা আর কচা নদীর জোয়ার-ভাটায় প্রবাহিত পিরোজপুর জেলা। পিরোজপুর রূপ-গুণ ও বৈশিষ্ট্যে বরিশালকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। পিরোজপুর জেলায় ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থাপনা থাকলেও মঠবাড়িয়ার কাঠ মসজিদ অন্যতম ও সুপরিচিত। পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানার বুড়িচর গ্রামে ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এ কাঠ মসজিদ বা মমিন মসজিদ। মসজিদটি নির্মাণ করেন, পিরোজপুর জেলার ধর্মপ্রাণ মুসলিম যুবক মৌলবি মমিন উদ্দীন আকন। তিনি ফরায়েজি আন্দোলনের অগ্রপথিক পীর দুদু মিয়ার ছেলে পীর বাদশাহ মিয়ার অনুসারী ছিলেন। মৌলবি মমিন আকন নিজ এলাকায় একটি কাঠের মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্যে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঠ সংগ্রহ করতেন। ১৯১৩ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৭ বছরে ২২ জন মিস্ত্রি ৪০ টাকা বেতনে মসজিদের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন। মসজিদের ফলকে লেখা আছে মমিন আকন আসাম, ত্রিপুরা ও মিয়ানমার থেকেও কাঠ আমদানি করতেন। ১২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৪ ফুট প্রস্থের এ মসজিদে কোনো লোহা ব্যবহার করা হয়নি। প্রতি ইঞ্চিতে রয়েছে এক অনন্য নকশা ও কারুকাজ। দেশ ও দেশের বাইরে মসজিদটির বেশ সুনাম ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে আছে। ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ৩০টি মসজিদের একটি কাঠ মসজিদ। বাংলাদেশের মসজিদ নিয়ে ইউনিসেফের ৪০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে এ মসজিদের সচিত্র চিত্রায়ন করা হয়েছে। (সূত্র : উইকিপিডিয়া)।

বরগুনার ঐতিহাসিক মসজিদ, বিবিচিন শাহী মসজিদ : বিষখালী নদীর কোল ঘেঁষে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বরগুনা জেলা। এক পাশে ঝালকাঠি আর অপর পাশে বরগুনা। বরগুনা জেলা প্রাচীনকালে দক্ষিণ বঙ্গের মুসলিমদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। দেশ-বিদেশ থেকে মুসলিম সাধকরা ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে নদী পথে বরগুনায় পাড়ি জমাতেন। সম্রাট শাহজাহানের আমলে ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দে পারস্য থেকে শাহ নেয়ামাতুল্লাহ দিল্লিতে আগমন করেন। বঙ্গ দেশ থেকে সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র ও শাহ সুজা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে শাহ সুজার অনুরোধে শাহ নেয়ামাতুল্লাহ বঙ্গ দেশে আগমন করেন এবং বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। যা ঐতিহাসিকদের কাছে বিবিচিন শাহী মসজিদ নামে পরিচিত। কথিত আছে শাহ নেয়ামাতুল্লাহর দুই মেয়ের একজনের নাম বিবিচিনি ও অপরজনের নাম ইছাবিবি। বড় মেয়ের নামানুসারেই এ মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে। মসজিদের উত্তর-পশ্চিমে শাহ নেয়ামাতুল্লাহ ও তার দুই মেয়ের কবর রয়েছে। প্রাচীন এ স্থাপনাটি বরগুনা জেলাকে মুসলমানদের প্রাচীনতম ঘাঁটি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। এক গম্বুজবিশিষ্ট প্রাচীন বিবিচিন শাহী মসজিদ ৩০ ফুট উঁচু টিলায় অবস্থিত। মসজিদের গৃহ প্রায় ২৫ ফুট উঁচু ও দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট, প্রস্থ ৩৩ ফুট। দেওয়ালগুলো প্রায় ৬ ফুট চওড়া আর ইটগুলো মোঘল আমলের ইটের মাপের সমান। উত্তর-দক্ষিণে তিনটি দরজা রয়েছে। বেতাগীর সবুজ অরণ্যে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন এ স্থাপনার সৌন্দর্য নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাই সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক মসজিদটি তালিকাভুক্ত করে এর সংস্কার করা হয়েছে। (সূত্র : উইকিপিডিয়া ও সরেজমিন ভ্রমণ)

ঝালকাঠির ঐতিহাসিক মসজিদ : গালুয়া পাকা মসজিদ : অলি-আউলিয়ার নগরী খ্যাত ঝালকাঠি জেলায় রয়েছে মুসলমানদের অসংখ্য পুরাকীর্তি। বরিশাল জেলার নিকটবর্তী হওয়ায় ঝালকাঠি জেলায় প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মের চাষ হচ্ছে। পীর-দরবেশের দরবার হিসেবে ঝালকাঠি জেলা সুপরিচিত। সে সুবাদে প্রাচীনকাল থেকেই জায়গায় জায়গায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য মাদ্রাসা-মসজিদ। প্রাচীন মসজিদগুলো মধ্য থেকে গালুয়া পাকা মসজিদ অন্যতম। এই মসজিদটি ভান্ডারিয়া-রাজাপুর মহাসড়কের গালুয়া বাজার এলাকা থেকে ১ কিলোমিটার আগে দুর্গাপুর গ্রামে অবস্থিত। মসজিদটি সংস্কারের সময় মসজিদের এক কোণে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১১২২ বঙ্গাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। লোকমুখে প্রচলিত আছে মাহমুদ খান আকন (মামুজী) নামের এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। মসজিদটির খাম্বি অনেক প্রশস্ত ও তার দেওয়াল টালি ইটের তৈরি ছিল। সরকার কর্তৃক সংস্কার করায় যদিও ইটগুলো এখন আর দেখা যায় না। স্থানীয়রা বলেন ‘মসজিদটি যখন সংস্কার করা হয়েছিল, তখন ঝোপঝাড় থেকে বড় বড় বিষধর সাপ বের হয়ে এসেছিল। পরে গালুয়ার মরহুম পীর মাহতাব উদ্দিনের (রহ.) কথামতো মসজিদের একটি অংশ খুলে দিলে সাপগুলো স্থান ত্যাগ করে।’ (উইকিপিডিয়া ও সরেজমিন ভ্রমণ)।

ভোলার ঐতিহাসিক মসজিদ : বরিশাল বিভাগের একটি দ্বীপের নাম ভোলা জেলা। চারদিকের থৈ থৈ পানির মধ্যে এক টুকরো সমতল ভূমিতে এই জেলা অবস্থিত। আদিকালের মুসলিম শাসকরা নদী পথে সর্বপ্রথম ভোলা জেলাতেই নিজেদের ঘাঁটি স্থাপন করতেন।

মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসন আমলে মোঘল সুবেদার ছবি খাঁকে চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলের ফৌজদার নিয়োগ করা হয়। ভোলা চন্দ্রদ্বীপের অধীনে হওয়ায় ছবি খাঁ এই জেলায় অনেক মসজিদ ও মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যদিও কালের পরিক্রমায় ছবি খাঁ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্থাপনাগুলো নদীভাঙনে হারিয়ে গেছে। তবে কালের সাক্ষী হিসেবে ভোলা সদর উপজেলার বাংলাবাজার এলাকার দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নের স্থানীয় মাঝি বাড়ির সুপারী বাগানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ৫০০ বছরের একটি মসজিদ।

তবে কেউ কেউ বলেন, ‘এই মসজিদটি মোঘল আমলের কোনো এক সময়ে নির্মিত হতে পারে। ১৭ শতকের শেষে বা ১৮ শতকের শুরুতে এটি নির্মিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ধারণা করা হয়, পরবর্তী মোঘল আমলে বিশেষ করে নবাব মুরশিদ কুলী খানের আমলে রাজস্বনীতিতে সংস্কারকৃত এই দ্বীপভূমিতে মুসলিম জনবসতি গড়ে ওঠা এবং ইসলাম প্রচারের কারণে এই প্রাচীন মসজিদ গড়ে ওঠে।’

মসজিদে গোলাকৃতির একটি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটির দৈর্ঘ্য সাড়ে ২৪ ফুট এবং প্রস্থ সাড়ে ১৯ ফুট। এর দেওয়ালের পুরুত্ব প্রায় তিন ফুট। মসজিদের সামনের দেওয়ালে মোঘল স্থাপত্য রীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য আয়তাকার প্যানেলিং ফ্রেম এবং আবদ্ধ খিলান নকশায় সজ্জিত। মসজিদটি পাড়াগাঁয়ের জঙ্গলে হওয়ায় দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে অবহেলিত ছিল। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে মসজিদের জঙ্গলের আশপাশে পরিষ্কার করা হয় এবং মসজিদটি আবাদযোগ্য করার চেষ্টা করা হয়। (সূত্র : উইকিপিডিয়া ও জনশ্রুতি)।

পটুয়াখালীর ঐতিহাসিক মসজিদ, মজিদবাড়িয়া শাহী জামে মসজিদ : সাড়ে পাঁচশত বছরের ইতিহাস কাঁধে চেপে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে পটুয়াখালীতে মজিদবাড়িয়া শাহী জামে মসজিদটি। পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলা সদরের ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে মজিদবাড়িয়া গ্রামে মসজিদটি অবস্থিত। দক্ষিণাঞ্চলের মুসলমানদের আধিপত্য ও ধর্মের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে আসছে এই মসজিদ। আদিকালে মজিদবাড়িয়া মসজিদকে ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হত। ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে সুন্দরবন পরিষ্কার করার সময় মসজিদটির সন্ধান পাওয়া যায়। মসজিদের দৈর্ঘ্য ৪৯ ফুট এবং প্রস্থ ৩৫ ফুট। এছাড়া পূর্ব দিকে রয়েছে, সাড়ে ২১ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৮ ফুট প্রস্থ একটি বারান্দা। দেখা যায়, মসজিদটির প্রধান কামরা বর্গাকারে নির্মিত এবং প্রত্যেকটি বাহু সাড়ে ২১ ফুট লম্বা। মসজিদের দেওয়াল গুলি প্রায় সাড়ে ৬ ফুট চওড়া। মসজিদের পূর্ব দিকে ৩টি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে ৪টি করে দরজা। পশ্চিম দিকের দেওয়ালে ৩টি মেহরাব আছে। প্রধান কামরার উপরে আছে আধা গোলাকৃতির একটি সুন্দর বিরাট গম্বুজ। বারান্দার ছাদ চৌচালা ঘরের আকারে নির্মিত। মসজিদটির প্রধান কামরার ৪ কোণায় ৪টি এবং বারান্দার ২ কোণায় ২টি মিনার আছে। মসজিদের পাশেই রয়েছে এক বিশাল দীঘি। মসজিদের পাশে আরো রয়েছে- চারটি কবর ২টি কবরে সমাহিত করা হয়েছে, চব্বিশ পরগনার ইয়াকনি শাহ ও কালাশাহ। আর অন্য দুটি কবর সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি জাদুঘরে সংরক্ষিত মজিদবাড়িয়া মসজিদের শিলালিপির তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীন বাংলার ইলিয়াস শাহীর শাসনামলের শেষের দিকে সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের পুত্র রুকনউদ্দিন বারবক শাহের (১৪৫৯-১৪৭৬ খ্রি.) শাসনামলে খান-ই মোয়াজ্জম উজিয়াল খান ১৪৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। (সূত্র : উইকিপিডিয়া ও সরেজমিন ভ্রমণ)।

লেখক : শিক্ষক