১৪৪৬। একটি নতুন হিজরি বর্ষের সূচনা। শুধু কি সূচনা? না কি তা এসেছে পরিসমাপ্তির পথ বেয়ে? কাজেই এখানে বিবেচনা দু’টো বিষয়ের; অতীতের এবং আগামীর। অতীতের যে সময়টুকু আল্লাহতায়ালার মর্জি মোতাবেক অতিবাহিত হয়েছে তার জন্য শোকরগোযারি আর যা ভুল-ত্রুটি হয়েছে, তা শুধরে নিয়ে আগামীকে আরো ফলপ্রসূ করে তোলার সংকল্প। তবে এটা শুধু বর্ষকেন্দ্রিক নয়, মাস বা সপ্তাহকেন্দ্রিকও নয়। একজন মুসলিম প্রতিদিন তার কর্মের হিসাব গ্রহণ করে এবং গত দিনের চেয়ে আগামী দিনকে অধিক ফলপ্রসূ করার চেষ্টা করে। এক হাদিসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘সব মানুষ প্রত্যুষে উপনীত হয় এবং নিজের সত্তাকে বিক্রি করে- হয় আল্লাহর কাছে বিক্রিত হয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করে, নতুবা শয়তানের কাছে বিক্রিত হয়ে নিজেকে ধ্বংস করে।’ (মুসলিম ৩/১০০)। তাই কালচক্রের অবিরাম যাত্রায় শুধু বছর নয়, মাস বা সপ্তাহও নয়, প্রতিটা দিনই মানুষের হিসাব-নিকাশের উপলক্ষ্য। সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেছেন, ‘যখন তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হও তো প্রত্যুষের অপেক্ষা করো না। আর প্রত্যুষে করো না সন্ধ্যার অপেক্ষা। সুস্থতার সময়ই অসুস্থতার কথা মনে রেখে কাজ কর, আর জীবন থেকেই সংগ্রহ কর মৃত্যুর পাথেয়। হে আল্লাহর দাস, তুমি জান না, আগামীকাল তোমার উপাধী কী হবে (জীবিত না মৃত)। (জামে তিরমিজি ৪/৫৬৮)। তাই মুসলমানের কর্তব্য হলো সচেতনতার ছোট-বড় যেকোনো উপলক্ষ্যকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রেরণায় নতুন মাত্রা যোগ করা।
মহররম ও আশুরা : আরবি হিজরিবর্ষের প্রথম মাস মুহাররম। বাংলায় একে মহররম বলা হয়। এ মাসের দশম তারিখকে বলা হয় আশুরা। পবিত্র কোরআনে ও হাদিস শরিফে এ মাস সম্পর্কে যা এসেছে তা হলো, এটা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ সময়। কোরআনের ভাষায় ‘আরবাআতুন হুরুম’ অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম এই মাস। এ মাসে রোজা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমজানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (মুসলিম : ২/৩৬৮; জামে তিরমিজি : ১/১৫৭)। এর মধ্যে আশুরার রোজার ফজিলত আরো বেশি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ (বোখারি : ১/২১৮)।
হজরত আলি (রা.) কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমজানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহতায়ালা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’ (জামে তিরমিজি : ১/১৫৭)। অন্য হাদিসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহতায়ালা অতীতের ১ বছরের (সগিরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (মুসলিম ১/৩৬৭; জামে তিরমিজি : ১/১৫৮)। আশুরার রোজা সম্পর্কে এক হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোজা রাখ।’ (মুসনাদে আহমদ ১/২৪১)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোজা রাখব।’ (মুসলিম : ১/৩৫৯)।
মহররম ও আশুরাকেন্দ্রিক নানা কুসংস্কার: এ মাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এদিনে আল্লাহতায়ালা তাঁর কুদরত প্রকাশ করেছেন। বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদের নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদের ডুবিয়ে মেরেছেন। (বোখারি : ১/৪৮১)। তবে এ দিনের গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে নানা ভিত্তিহীন কথাও বলে থাকেন। যেমন, এদিন হজরত ইউসুফ (আ.) জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হজরত ইয়াকুব (আ.) চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন। অনেকে বলে, এদিনেই কেয়ামত সংঘটিত হবে। হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হজরত ইদরীস (আ.) কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। (আস আসারুল মারফূআ, আবদুল হাই লাখনেবী ৬৪-১০০; মা ছাবাহা বিসসুন্নাহ ফী আয়্যামিস সানাহ : ২৫৩-২৫৭)। এ মাসের একটি ঘটনা শাহাদাতে হুসাইন (রা.)। বলাবাহুল্য যে, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয়। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ডএরই তো শিক্ষা- ‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয়ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না, যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়।’ অন্য হাদিসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই, যারা মুখ চাপরায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলি যুগের কথাবার্তা বলে।’ অতএব, শাহাদাতে হুসাইন (রা.) কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলি রসমণ্ডরেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। এ মাসে যেসব অনৈসলামিক কাজকর্ম ঘটতে দেখা যায় তার মধ্যে তাজিয়া, শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এসব রসমণ্ডরেওয়াজের কারণে এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করার একটা প্রবণতা অনেক মুসলমানের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। এজন্য অনেকে এ মাসে বিয়েশাদি থেকেও বিরত থাকে। বলাবাহুল্য, এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার।
মোটকথা, এ মাসের করণীয় বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, তওবা-ইস্তেগফার, নফল রোজা এবং অন্যান্য নেক আমল। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়া এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসমণ্ডরেওয়াজ থেকে বেঁচে কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক চলাই মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহতায়ালা আমাদের তৌফিক দান করুন।
লেখক : বিশিষ্ট লেখক ও মুহাদ্দিস (সৌজন্যে,মাসিক আল কাউসার)।