ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হিজরি নববর্ষ

নবোদ্যমে শুরু হোক পথ চলা

মুফতি ইবরাহীম আল খলীল
নবোদ্যমে শুরু হোক পথ চলা

হিজরি নববর্ষ। একটি নতুন বছরের শুরু। একটি দীর্ঘ বছরের সমাপ্তি। শুরু ও সমাপ্তির আবেদন মানবজীবনে অনেক গভীর। একটি শুরু ও সমাপ্তিতে থাকে বহু পাওয়া, না পাওয়ার গল্প। একটি বছর, একটি মাস, একটি সপ্তাহ, একটি দিন এবং মোমেনের প্রতিটি কাজের শুরু ও সমাপ্তির মাঝে থাকে গভীর তাৎপর্য। সবার এই কামনা থাকা উচিত যে, পুরো জীবন কিংবা অন্তত সব শুরু ও সমাপ্তি যেন হয় সুন্দর আর অমলিন। নির্মল এবং পবিত্র। এই শুরু ও সমাপ্তির ক্ষেত্রে ইসলামি চেতনা এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমনটা হাদিসে বর্ণিত সকাল-সন্ধ্যার বিভিন্ন দোয়া ও আমলের প্রতি খেয়াল করলে দেখা যায়। তাছাড়া সব কাজ আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করা এবং কাজ শেষে আল্লাহর শোকর ও ইস্তেগফার করা অতীব জরুরি বিষয়।

জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যেন একটি পথ। প্রতিটি মানুষ এ পথের মুসাফির। মুসাফির পথের একটি মানযিল অতিক্রম করে একটু থামে। পেছন ফিরে দেখে, কতটুকু পথ সে অতিক্রম করেছে আর কতটুকু বাকি। প্রতিটি বছরের শেষ দিন যেন মানুষ একেকটি স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। এখান থেকে আবার নতুন স্টেশনের দিকে যাত্রা শুরু করে। এরমধ্যে জীবনের একটু হিসাব করে, কতটুকু পথ পার হলাম। কতটুকু পথ বাকি। কতটুকু কী করা হলো। আর কতটুকু কী করা দরকার ছিল। আখেরাতের প্রস্তুতি কতটুকু হলো এবং জীবন কতটুকু গোছানো হলো। নতুন বছর একটি নতুন স্টেশন। জীবনের পথ চলতে গিয়ে আমরা এখানে একটু থামি। বুঝতে পারি, জীবন থেকে আরো একটি বছর চলে গেছে! এখানে এসে আমরাও কি একটু হিসাব মেলাব না! একটু কি ভাবব না? এই জীবন সফরে আমাদেরও ভাবা দরকার, কতটুকু পথ পাড়ি দিলাম আর কতটুকু বাকি। লাভের খাতা ভারি নাকি লোকসানের? জীবনে পাপের পরিমাণ কত? এ ভাবনা ও আত্মজিজ্ঞাসা জরুরি।

আজ হতে শুরু হচ্ছে ১৪৪৬ হিজরিবর্ষ। এক বছর আগে ঠিক একইভাবে শুরু হয়েছিল ১৪৪৫ হিজরিবর্ষ। তখন আজকের এই দিনকে মনে হয়েছিল অনেক দূর। যেমন আজ দূর মনে হচ্ছে আগামী বছরকে। আমাদের কৈশোরের স্মৃতিকে মনে হয় মাত্র পার হলো। বার্ধক্যকে মনে হয় সুদূর ভবিষ্যৎ। এই যে মনে হওয়া, এটা অনেক সময়ই গাফলত সৃষ্টি করে। আর জীবন ও জীবনের পরিণতি সম্পর্কে যে ব্যক্তি গাফলতের শিকার হয় তার দুর্ভোগ হয় বড় বেদনাবহ।

নতুন বছর আগমন যেমন খুশি ও আনন্দের। তেমনি জীবন থেকে একটি বছর হারিয়ে যাওয়ার বেদনাও মিশে থাকে তার সঙ্গে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে নিজের পর্যালোচনা করে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয়। আর নির্বোধ ও অক্ষম সেই ব্যক্তি, যে মনোবৃত্তির অনুসরণ করে এবং অলীক কল্পনায় ডুবে থাকে। (জামে তিরমিজি, হাদিস ২৪৫৯)। নতুন বছর মানুষকে ভাবতে শেখায়। নতুন করে মহান রবের আনুগত্যে আহ্বান করে। বছরের প্রথম দিনে মোমেন ব্যক্তি বিগত বছরের আত্মপর্যালোচনা করবে। বিগত বছরের হিসেব নিবে। নতুন বছরের কর্মপরিকল্পনা সাজাবে। আরো নবোদ্যমে কর্মতৎপর হয়ে ওঠবে। কারণ মুসলমানের কাছে প্রতিটি দিন মূল্যবান। প্রত্যেকটি সকাল মানেই নতুন আরেকটি সুযোগ। সেই সুযোগটি হলো নিজের ঈমান-আমলকে সমৃদ্ধ করার। গুনাহকে ছেড়ে দেওয়ার। পাপ কাজ না করার। প্রতিটি মানুষের উচিত কোরআন-হাদিসের পথ অনুসরণ করা। নবীজীবনের আদর্শ মেনে চলা। নতুন বছরে তওবা করে নতুন করে আল্লাহর গোলামির জীবন শুরু করা। নতুন বছরে নিজেকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো। নতুন আত্মপ্রত্যয় গ্রহণ করা। পেছনের সব গুনাহ ক্ষমা করিয়ে নিয়ে নতুন করে জীবনের পথ চলা।

এই নতুন বছরে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক পাপ মুক্ত জীবনের। পাপ-পঙ্কিলতার আঁধার কেটে পুণ্যের সূর্যোদয় হোক মোমেন জীবনে। চলুন আমরা নিজেকে নিয়ে একটু ভাবি এবং দৃঢ় সংকল্প করি। নতুন করে জীবনকে সুন্দর করার প্রত্যয় গ্রহণ করি। ঈমান-আমল ও আখলাক সুন্দর করি। আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। কায়মনোবাক্যে দুনিয়া ও আখেরাতের কামিয়াবি প্রার্থনা করি। স্মরণ করি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী-দুনিয়াতে তুমি পরদেশি কিংবা পথিকের মতো থাক এবং নিজেকে কবরবাসীদের মধ্যে গণ্য কর। (অর্থাৎ তোমাকে যে নিশ্চিত কবরে যেতে হবে, সেটা মনে রাখ।) (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৩৩)। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) কতইনা সুন্দর বলেছেন, তুমি যখন সন্ধ্যায় উপনীত হও, তখন সকালের অপেক্ষা করো না। যখন সকালে উপনীত হও, সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। সুস্থতার সময়ই অসুস্থতাকালের প্রস্তুতি নাও এবং জীবন থাকতেই নাও মৃত্যুর প্রস্তুতি। হে আল্লাহর বান্দা! তুমি তো জানো না আগামীকাল তোমার কী উপাধি হবে (জীবিত না মৃত)! (বোখারি, হাদিস : ৬৪১৬)।

নতুন বছরের সূচনা হোক দোয়ার মাধ্যমে : বছরের শুরুতে কৃত সব গুনাহ থেকে আল্লাহতায়ালার কাছে পানাহ চাওয়া উচিত। গুনাহমুক্ত নতুন জীবনের জন্য নারী-পুরুষ প্রত্যেকের আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করা দরকার। এ সময় কোরআন ও হাদিসের দোয়াগুলো আবেগ ও অনুভূতির সঙ্গে পড়া। শুধু মুখের পড়া নয়, বরং দোয়ার অর্থ ও মর্ম উপলব্ধি করে বিষয়গুলো আল্লাহতায়ালার কাছে চাওয়া। নতুন মাসের চাঁদ দেখে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দোয়া পড়তেন, উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি, ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলাম, রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহ। অর্থ : হে আল্লাহ! এই চাঁদকে আপনি আমাদের জন্য বরকত ও ঈমান এবং শান্তি ও ইসলামের সাথে উদিত করুন। (হে চাঁদ!) আমার ও তোমার রব আল্লাহ। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৫১)। নতুন মাস বা বছর শুরু হলে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এ দোয়াটি গুরুত্বের সঙ্গে পড়তেন, উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা আদখিলহু আলাইনা বিল-আমনি, ওয়াল ইমানি, ওয়াস সালামাতি, ওয়াল ইসলামি, ওয়া ঝাওয়ারিম মিনাশ শায়ত্বানি, ওয়া রিদওয়ানিম মিনার রাহমানি। অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মাঝে এ মাস-বছরের আগমন ঘটান নিরাপত্তা ও ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে এবং শয়তান থেকে সুরক্ষা ও দয়াময় আল্লাহর সন্তুষ্টির সঙ্গে। (মুজামুস সাহাবাহ ৩/৫৪৩)। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে সব ধরনের গাফলত, উদাসীনতা দূর করে পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত সুন্দর জীবন যাপন করার তৌফিক দান করুন। নবোদ্যমে ঈমান-আমলের সঙ্গে নতুন বছর শুরু করার শক্তি ও সামর্থ্য দান করুন- আমিন।

লেখক: শিক্ষক, মাদ্রাসা আশরাফুল মাদারিস, তেজগাঁও, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত