কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনায় শিল্পপ্রযুক্তি
মুফতি দিদার শফিক
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তখন আরবদের প্রধান আয়ের উৎস ছিল পশুপালন ও বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য। এছাড়া অর্থব্যবস্থায় তখন বিশেষ ভূমিকা রেখেছে খেজুর ও পশুজাত নানান পণ্যসামগ্রী। তখন শিল্পপ্রযুক্তি তেমন বিকশিত হয়নি। কিন্তু রাসুল (সা.) যখন নবুয়ত লাভ করলেন। আর তার ওপর অহি অবতীর্ণ হওয়া শুরু হলো। তখন থেকে কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারে কিছু শিল্পপ্রযুক্তির কথা। তাই দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায়,কিছু কিছু শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআন ও রাসুল (সা.)-এর নির্দেশনা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। এ নিবন্ধে এমন কিছু শিল্পপ্রযুক্তির কথা তুলে ধরা হলো, যার বর্ণনা কোরআন ও হাদিসে রয়েছে।
জাহাজ নির্মাণ শিল্প : পবিত্র কোরআনে হজরত নুহ (আ.)-এর জাহাজ নির্মাণ শিল্পের কথা বিধৃত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘অতএব আমার পর্যবেক্ষণের অধীনে আর আমার অহি অনুসারে তুমি নৌকা তৈরি করো, আর যারা বাড়াবাড়ি করেছে, তাদের ব্যাপারে আমার কাছে কোনো আবেদন করো না, তারা অবশ্যই ডুববে। নুহ নৌকা তৈরি করছিল, আর যখনই তার জাতির প্রধান ব্যক্তিরা তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তারা তাকে ঠাট্টা করছিল। সে বলল, ‘তোমরা যদি আমাদের ঠাট্টা করো, তাহলে আমরাও তোমাদের (ভবিষ্যতে) ঠাট্টা করব, যেমনভাবে তোমরা (এখন) ঠাট্টা করছো। (সুরা হুদ : ৩৭-৩৮)। এ আয়াত দুটো দ্বারা মরুবাসী আরবরা নৌকা ও জাহাজ বানানোর জ্ঞান লাভ করে। সামুদ্রিক জাহাজ নির্মাণের প্রযুক্তি অর্জন করে এবং শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করে বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিক সফর ও সমর অভিযান পরিচালনা করার মাধ্যমে স্থলভাগের মতো জলভাগেও কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হন। আর পবিত্র কোরআনের এ আয়াতদ্বয়ের সূত্র ধরেই নুহ নবীর কিশতির অনুসরণে বর্তমানেও কয়েক স্তরবিশিষ্ট বিশাল বিশাল নৌযান নির্মাণের ধারা অব্যাহত আছে। আগে নৌযান তৈরি হত কাঠ দিয়ে আর এখন তৈরি হয় আধুনিক বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে। প্রযুক্তির মধ্যে এতটুকুই ব্যবধান। তবে জাহাজ নির্মাণের মূল ও আসল ধারণা অর্জিত হয় পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা থেকেই।
লোহা ও তামা শিল্প : পৃথিবীতে আগমনকারী প্রথম মানুষ থেকে কেয়ামাত পর্যন্ত আগত সব মানুষের জন্য একটি অনিবার্য খনিজ দ্রব্য হলো লোহা। পবিত্র কোরআনে লোহার বর্ণনা এসেছে, হজরত দাউদ (আ.)-এর হস্তশিল্প সম্পর্কে। লোহা গলিয়ে আসবাব, বর্ম, যুদ্ধাস্ত্র ও দেয়াল তৈরির বর্ণনা আছে পবিত্র কোরআনে। তামা গলিয়ে তৈজসপত্র বানানোর কথাও বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি আমার পক্ষ থেকে দাঊদের প্রতি অনুগ্রহ করেছিলাম। (আমি আদেশ করেছিলাম) হে পর্বতমালা! তোমরা দাঊদের সঙ্গে আমার পবিত্রতা ঘোষণা করো আর পাখীদেরও (এ আদেশ করেছিলাম)। আমি লোহাকে তার জন্য নরম করেছিলাম। (১০) যাতে তুমি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরি করতে পার, কড়াগুলো সঠিকভাবে সংযুক্ত কর আর তোমরা সৎকর্ম করো। তোমরা যা কর আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী। (১১) সুলাইমানের অধীন করেছিলাম বায়ুকে যা প্রভাতে ১ মাসের পথ অতিক্রম করত এবং সন্ধ্যায় ১ মাসের পথ অতিক্রম করত। আমি তার জন্য গলিত তাম্রের এক প্রস্রবন প্রবাহিত করেছিলাম এবং ছিল জিন সম্প্রদায় যারা তাদের রবের অনুমতিক্রমে নিজেদের কতক তার সামনে কাজ করত। তাদের মধ্যে যে আমার নির্দেশ অমান্য করে তাকে আমি জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তি আস্বাদন করাব। (১২) তারা সুলাইমানের ইচ্ছে অনুযায়ী তার জন্য প্রাসাদ, ভাস্কর্য, হাউসের মতো বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশালাকায় ডেগ নির্মাণ করত। (১৩) (সুরা সাবা : ১০-১৩)। এ নির্দেশনা অনুসরণে আরবের মুসলমানরা লোহা ও তামার আসবাব এবং বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করেছিল।
ইট-পাথরের নির্মাণ শিল্প : মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরির প্রযুক্তিও পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। অনেক আগ থেকেই পাথর খুদাই করে গৃহ নির্মাণের প্রচলন থাকলেও গৃহনির্মাণে পোড়ামাটির ব্যবহার কোরআনের নির্দেশনা থেকে প্রাপ্ত। যেমন আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘ফেরাউন বলল- ‘হে পরিষদবর্গ! আমি ছাড়া তোমাদের কোনো ইলাহ আছে বলে আমি জানি না। কাজেই ওহে হামান! তুমি আমার জন্য ইট পোড়াও, অতঃপর আমার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ করো, যাতে আমি মুসার ইলাহকে দেখতে পারি, আমার নিশ্চিত ধারণা যে, সে একজন মিথ্যেবাদী।’ (সুরা কাসাস : ৩৮)। এ আয়াত থেকে প্রাপ্ত শিল্পজ্ঞানের আলোকে আরবে গৃহনির্মাণ প্রযুক্তিতে পোড়ামাটির ব্যবহার শুরু হয়। তবে অবশ্য আরো বহুকাল আগে বায়তুল্লাহ নির্মাণে হজরত ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.) পাথর ব্যবহার করেছিলেন। উঁচু দেয়ালে পাথর তোলার ক্ষেত্রে তিনি লিফটের মতো ব্যবহার করেছিলেন হাজরে আসওয়াদ। এটি সাধারণ্যে ব্যবহার উপযোগী কোনো প্রযুক্তি ছিল না। এর সঙ্গে নবুয়তের সংযোগ ছিল বলে একে নবুয়তি প্রযুক্তি বলা যায়। নির্মাণে পোড়ামাটির পাশাপাশি স্বচ্ছ কাচ ব্যবহার করেছিলেন হজরত সুলায়মান (আ.)। বলা বাহুল্য, এটিও ছিল তার নবুয়তি ক্ষমতার অংশ।
পশু ও চামড়াশিল্প : আরবের লোকেরা বাঁচার তাগিদেই পশুপালন শিল্পে তুলনামূলক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতেন। পশুর জন্ম ও যত্নে তারা বিশেষ গুরুত্ব দিতেন বলেই আরবের ঘোড়া বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ঘোড়া হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। রাসুল (সা.)-এর যুগে চামড়া শোধন ও তা ব্যবহার উপযোগী করার প্রযুক্তি প্রচলিত ছিল। এ ক্ষেত্রেও অবদান ছিল আল্লাহতায়ালার নির্দেশনা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তাতে তোমাদের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করেন এবং তিনি তোমাদের জন্য পাহাড়ে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন এবং তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করেন পরিধেয় বস্ত্রের; ওটা তোমাদের তাপ হতে রক্ষা করে এবং তিনি ব্যবস্থা করেন তোমাদের জন্য বর্মের, ওটা তোমাদের যুদ্ধে রক্ষা করে; এভাবে তিনি তোমাদের প্রতি তার অনুগ্রহ পূর্ণ করেন যাতে তোমরা আত্মসমর্পণ করো। (সুরা নাহল : ৮০)। রাসুলের যুগে চামড়া দিয়ে অনেক ধরনের ব্যবহার সামগ্রী তৈরি করা হত। খাবার খাওয়ার দস্তরখান, পানির মশক (জগ), পোশাক ইত্যাদি।
পোশাক ও অলঙ্কার শিল্প : আরবের লোকেরা তাদের কাপড়ের চাহিদা পূরণ করত আমদানির মাধ্যমে। ইয়েমেন থেকে আমদানি করা হতো পোশাক। তবে সীমিত পরিসরে আরবেও পোশাকশিল্প গড়ে উঠেছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) কে মদিনার জনৈক সাহাবি হাতে তৈরি একটি পোশাক উপহার দিয়েছিলেন। আর পবিত্র কোরআনে রেশমের কথা উল্লেখ আছে। রেশম বিকাশে কোরআনের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা আছে। নারীদের অলঙ্কারের কথাও পবিত্র কোরআনের বর্ণনায় এসেছে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তাদেরই জন্য আছে স্থায়ী জান্নাত যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তাদেরকে স্বর্ণ-কংকনে অলংকৃত করা হবে, তারা পরিধান করবে পাতলা ও মোটা রেশমের সবুজ বস্ত্র ও সমাসীন হবে সুসজ্জিত আসনে; কত সুন্দর পুরস্কার ও উত্তম আশ্রয়স্থল! (সুরা কাহফ : ৩১)। অন্যত্র বলেছেন, যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে, আল্লাহ তাদের দাখিল করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তাদের অলংকৃত করা হবে স্বর্ণ কংকন ও মুক্তা দ্বারা এবং সেখানে তাদের পোশাক পরিচ্ছদ হবে রেশমের।’ (সুরা হজ : ২৩)।
স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্প : আরবে অনেক রকমের নির্মাণশিল্প গড়ে ওঠে। প্রাসাদ তৈরি, পূজার বেদী বা মূর্তি তৈরি ইত্যাদি কাজে অনেক উন্নতি করে তারা। রাসুলুল্লাহ (সা.) পূজা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কার নিষিদ্ধ করে দেন। তার উৎসাহে নির্মাণ শিল্পে তাৎপর্যময় পরিবর্তন সাধিত হয়। নির্মাণ শিল্পীরা নারীদেহ, দেবদেবী এবং অন্যান্য অশোভন বিষয়কে উপজীব্য করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের পথ বর্জন করেন। ফলে সুরুচি ও সৌন্দর্যের নতুন নতুন স্থাপনা গড়ে ওঠে। মসজিদে নববি এ সময়ের নির্মাণ শিল্পের সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। পরবর্তীতে এর অনুসরণেই মসজিদ, মিনার, মসজিদের দরজার নকশার আদলে বহু স্থাপত্যশিল্প গড়ে ওঠেছে।
কুটিরশিল্প : মক্কার দু-এক জায়গায় কুটির শিল্পেরও অস্তিত্ব ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ভৃত্য রাফে বলেন : ‘আমি জমজম কূপের কাছে ঘরে বসে পেয়ালা তৈরি করতাম।’ এমন আরো অনেক রকম ছোট ছোট শিল্পই আরবে ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) এসব শিল্পকে সর্ব্বোতভাবে উৎসাহ দিয়েছেন।
সামরিক অস্ত্র শিল্প: যুদ্ধ আরবের লোকদের মজ্জাগত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। তারা কথায় কথায় যুদ্ধ করত, অহেতুক কারণে সংঘটিত যুদ্ধ যুগের পর যুগ অব্যাহত রাখত। যুদ্ধের এ অনিবার্য উপস্থিতির জন্যই আরবে অস্ত্র শিল্প গড়ে উঠেছিল। তরবারি, তীর, ধনুক, বর্ম, বল্লম, ঢাল, শিরস্ত্রান ইত্যাদি স্থানীয়ভাবে আরবেই তৈরি হতো। সিরিয়া-মিসর-রোম হতে তুলনামূলক উন্নত অস্ত্র আমদানি করা হতো। ভারতীয় তরবারি আরবদের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। বদর ও উহুদ যুদ্ধের আগে আরবের অমুসলিমরা বিপুল পরিমাণে অস্ত্র আমদানি করেছিল। এ সময় যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে প্রধানত তীর, তলোয়ার, ঢাল, বর্শাই প্রধানত ব্যবহৃত হতো। দুর্গ আক্রমণে মানজানিক ও দাব্বাবাহ নামে বিশেষ অস্ত্র ব্যবহার করা হতো। মানজানিক দিয়ে ভারি পাথর ছোঁড়ার এবং দাব্বাবাহ দিয়ে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করার ব্যবস্থা ছিল। মাগাজি তথা যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট হাদিস, ইতিহাস ও সিরাত থেকে এসব প্রমাণ পাওয়া যায়।
কার্পেট ও আসবাব তৈরি শিল্প : ঘর সাজানোর বিভিন্ন উপকরণের কথা কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। যা মূলত জান্নাতি লোকদের আবাসস্থল কেমন হবে তার বর্ণনায় এসব উপকরণের কথা আলোচিত হয়েছে। এ শিল্পের বিকাশে কোরআনে পর্যাপ্ত উপকরণ বিদ্যমান। জান্নাতবাসীদের আরামপ্রদ অবস্থার কথা বর্ণায় এসেছে- ‘তারা পরিধান করবে পাতলা ও মোটা রেশমের সবুজ বস্ত্র ও সমাসীন হবে সুসজ্জিত আসনে।’ (সুরা কাহফ : ৩১)। অন্য আয়াতে আছে, ‘সেখানে থাকবে বহমান ঝর্ণাধারা, উন্নত মানের বিছানা, প্রস্তুত থাকবে পানপাত্র, সারি সারি তাকিয়া এবং বিছানো গালিচা।’ (সুরা গাশিয়া : ১২-১৬)।
লেখক : মুহাদ্দিস ও মিডিয়াকর্মী