সাহিত্য সমাজের দর্পণ। সাধারণত এই দর্পণের কাজ মানুষের মনন ও বোধ জাগিয়ে তোলা। সত্য ও সুন্দরের সন্ধান দেওয়া। সত্য ও সুন্দরের চর্চার এক অন্যতম মাধ্যম ইসলামি সাহিত্যচর্চা। ইসলামে সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার পরিধি দিগন্তবিস্তৃত ও সুবিশাল। ইসলাম সমগ্র সাহিত্যজগৎকে কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীলতার অন্ধকার গলি-ঘুপচির পরিবর্তে আলো ঝলমল ফুলেল পথ দেখিয়েছে। আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ভালো কবিতা ভালো কথার মতো, খারাপ কবিতা খারাপ কথার মতো। সাহাবীরা অনেক ভালো কবিতা বলতেন। রাসুলের একজন কবি ছিলেন হাসসান বিন সাবিত। তিনি রাসুলের পক্ষে কাফিরদের কবিতার প্রত্যুত্তর দিতেন। কবিতা ও কবি দুই প্রকার!
১. যারা অশ্লীল, অসত্য ও কাল্পনিক-অবাস্তব কথা-বার্তা বলে। মানুষের প্রশংসা ও নিন্দা করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ছড়া-কবিতা রচনা করে। আল্লাহ ও শরীয়তবিরোধী লেখালেখি করে সেসব কবি ও কবিতা নিন্দনীয়। পবিত্র কোরআনের সুরা শু’আরায় বর্ণিত হয়েছে- ‘আর বিভ্রান্তরাই কবিদের অনুসরণ করে।’
২. যে সব কবিতায় অসত্য, অশ্লীল ও শরীয়তের বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই এবং ঈমান-আমলের প্রতি উৎসাহ দেয় তা ভালো, প্রশংসনীয়। এরূপ কবি ও কবিতাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) প্রশংসা করেছেন।
সুরা শু’আরায় বর্ণিত হয়েছে, ‘তবে তারা ব্যতীত, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে এবং অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করেছে আর শুধু অত্যাচারিত হওয়ার পর প্রতিশোধ নিয়েছে; আর অত্যাচারীরা শিগগিরই জানবে তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল কোথায়।’ ছড়া-কবিতায় ইসলাম ও সংস্কৃতির চর্চা মূলত বাংলা সাহিত্যচর্চার আদি থেকেই। মুসলিম আমলের আগে বাংলা সাহিত্যের শুধুমাত্র চর্যাপদ ছাড়া অন্য কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না। ড. দীনেশ চন্দ্র স্বীকার করেছেন যে ‘হিন্দু নৃপতিগণ নয়, মুসলমান সুলতানরাই মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চায় উৎসাহ প্রদান করেছেন (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য-পৃষ্ঠা : ৭৩)। ড. ওয়াকিল আহমেদ বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে কথিত ‘অন্ধকার যুগ’ মোটেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের যুগ ছিল না। ধর্ম-শিক্ষা শিল্পচর্চার দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত ছিল, তারা সীমিত আকারে হলেও শিক্ষা সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন।’ (বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত, পৃষ্ঠা : ১০৫)। বিশিষ্ট গবেষক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ‘বাংলার সামাজিক ও সংস্কৃতির ইতিহাস' গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন, ‘যদি বাংলায় মুসলিম বিজয় ত্বরান্বিত না হতো এবং এদেশে আরো কয়েক শতকের জন্য হিন্দু শাসন অব্যাহত থাকতো, তবে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেত এবং অবহেলিত ও বিস্মৃত-প্রায় হয়ে অতীতের গর্ভে নিমজ্জিত হতো।’
বাংলা সাহিত্যে মুসলমান : মোহাম্মদ আব্দুল হাই বলেছেন, সেন আমলে হিন্দু ব্রাহ্মণবাদের পুনর্জাগরণের ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়েছে। বখতিয়ার খিলজি ১২০৩ সালে লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করেন। এ সময় পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। তখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সৌভাগ্যের সূর্য উদিত হয়। দীনেশ চন্দ্র সেন তার 'হিস্টরি অফ বাঙালি ল্যাঙ্গগুয়েজ’ এর মধ্যে লিখেছেন, যে কয়েকটি কারণে বাংলা ভাষা উচ্চতর সাহিত্যের স্তরে উন্নীত হয়েছে। তার মধ্যে নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য মুসলিম বিজয়। দীনেশ চন্দ্র সেন আরো বলেন, মুসলমানরা এইভাবে বাংলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া আমাদের সাহিত্যে এক নতুন যুগ আনায়ন করিলেন। মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক রমণীর মতো দীনহীন বেশে পল্লি কুটিরে বাস করিতেছিল। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, বাংলা সাহিত্যের জন্ম মুসলিম যুগে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন, আমরা কি করে ভুলে যাই চতুর্দশ শতাব্দীর মুসলিম সুলতান রাজপুরুষদের কথা যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যের এক গৌরবময় অধ্যায় রচিত হয়। আব্দুল করিম বলেন, বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে ইলিয়াস শাহের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। এই বংশের শাসন আমলেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শৈশবকাল উত্তীর্ণ হয়। এমনকি চর্যাপদ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন- বাংলা ভাষার উত্তলন এ যুগেই হয়। এরপর মধ্যযুগ ১২০১ থেকে ১৮০০ সাল বাংলা ভাষার সোনালি যুগ ছিল সুলতানি আমলে। সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলিম কবি আব্দুল হাকিম, শাহ মোহাম্মদ সগীর, সৈয়দ হামজা, শেখ ফয়জুল্লাহ, শাহ গরীবুল্লাহ, শেখ চান্দ, সৈয়দ আলাওল, নওয়াজিশ খান, সৈয়দ মোহাম্মদ আকরম, দউলত কাজী, মোহাম্মদ কবীর, দোনা গাজী, মোহাম্মদ খান, হায়াত মাহমুদ সবাই বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। লেখক হুমায়ুন আজাদ বলেন, মুসলমান কবিদের সংবাদ আমরা সব জানি না। কেন না, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার জন্য যখন তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তখন মুসলমান কবিদের কাব্য সংগ্রহ করা হয়নি। তবে কিছু সংবাদ পাওয়া গেছে একজন মহাপুরুষের চেষ্টায় তিনি আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছেন মুসলমান কবিদের পুঁথি। তিনি না জন্মালে হয়তো মুসলিম কবিদের সাধনার কথা জানতে পারতাম না। বশীর আল হেলাল বলেন, ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর চিন্তার ফল হলো বাংলা একাডেমি।
আধুনিক যুগ : আঠারো শতকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ শুরু হয়। ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, নবাব সিরাজের পতন না হলে পুঁথি সাহিত্য হতো আসল সাহিত্য। ড. এনামুল হক বলেছেন, ইংরেজরা আসায় ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হওয়ার পর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণে মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ল। ১৮৫৭ সালের সিবিআই বিপ্লবের পর হতে মুসলমানরা অর্ধশতাব্দি পিছিয়ে গেল। মুসলিম বাংলা সাহিত্য গ্রন্থে ড. মোহাম্মদ এনামুল হক বলেছেন, আমাদের বিশ্বাস হিন্দুদের মতো বাংলার মুসলমানরা যদি যথাসময়ে পাশ্চাত্য শিক্ষা-দিক্ষার গ্রহণ সম্পর্কে সচেতন হতো। তবে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তাহাদের সৃষ্টি হিন্দুদের তুলনায় পরিমাণ ও গুণ কোটাতেই সামান্য কম হইতো না; বরং বেশি হইতো। হয়তো নজরুল ইসলাম ছাড়াও গগনচুম্বি সাহিত্যর আবির্ভাব ঘটতো। বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিদের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অবদান- রোমান্টিক ও অধ্যাত্ম প্রণয়কাহিনী। রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান ধারার পথিকৃৎ হলেন শাহ মুহম্মদ সগীর। ড. এনামুল হকের মতে, শাহ মুহম্মদ সগীর সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রি.) পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ইউসুফ জুলেখা’ কাব্য রচনা করেন। সগীর মূলত কোরআনে বর্ণিত ইউসুফ জুলেখাকে নতুন করে রক্ত-মাংস সংযোগ করে এক মোহনীয় মূর্তি সৃজন করেছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের দেশি ভাষার সাহায্যে মুসলিম ধর্মীয় প্রণয়োপখ্যানে সিক্ত করা এবং বাস্তবতা বর্জিত পুঁথিসাহিত্য থেকে পাঠককে প্রকৃত সাহিত্য রসে ফিরিয়ে আনা।
শাহ মুহম্মদ সগীর রস প্রধান সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা নিয়ে যে যুগের উম্মোচন করলেন পরবর্তীতে তাতে অনেকেই শরিক হলেন। এরমধ্যে কবি জৈনুদ্দিন অন্যতম। তিনি গৌড়ের সুলতান ইউসুফ শাহের (১৪৭৪-১৪৮১ খ্রি.) সভাকবি ছিলেন। কবি ভণিতায় বার বার সুলতানের নাম উল্লেখ করেছেন। জৈনুদ্দিনের কাব্যের নাম ‘রসুল বিজয়’। ১৬ শতকের রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান রচয়িতাদের আরেকজন প্রভাবশালী কবি দৌলত উজির বাহরাম খান। তিনি পারস্যে লোককাহিনি ‘লাইলি মজনু’ শীর্ষক বেদনাবিধুর প্রেম-কাহিনিমূলক কাব্য রচনা করে মুসলিম সমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এ শতকেই কবি দোনাগাজি ‘ছয়ফুলমূলক বদিউজ্জামান’ কাব্য রচনা করেন। কাব্যটির বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘটনার সন্নিবেশে অপূর্ব এবং বর্ণনা কৌশলে অসাধারণ। যদিও অতিপ্রাকৃতের কুহেলিকার আবেষ্টনী থেকে ‘পরিকাহিনি’ নিজেকে আলাদা করতে পারে না তবুও যেন পৃথিবীর কথাই এ কাব্যের মধ্যে প্রতিভাত হয়। ১৭ শতকে কবি দৌলত কাজি আরকানের প্রধান সমর-সচিব আশরাফ খানের নির্দেশে ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’ কাব্য রচনা করেন। দৌলত কাজি মিয়াসাধনের ‘মৈনা কো সত’ কাব্য থেকে তার ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’-এর উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। কবি আলাওল ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে প্রধান অমাত্য সোলায়মানের অনুপ্রেরণায় কাব্যটির অবশিষ্ট অংশ সমাপ্ত করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুরের আশ্রয়ে থেকে মহাকবি আলাওল তার অমর কাব্য ‘পদ্মাবতী’ রচনা করেছিলেন। মাগন ঠাকুর ছিলেন কোরেশ বংশোদ্ভূত মুসলমান; আরকানরাজ প্রদত্ত তার উপাধি ছিল ‘ঠাকুর’। তিনি নিজেও কবি ছিলেন; তার কাব্যের নাম ‘চন্দ্রাবতী’।
সৈয়দ মুহম্মদ চন্দ্র সুধর্মার সমর-সচিব ছিলেন। মহাকবি আলাওল তার আদেশে ‘সপ্তপয়কর’ কাব্য রচনা করেন। ওই সময়ে মজলিস নামক এক ব্যক্তি সুধর্মার রাজসভার ‘নবরাজ’ ছিলেন। তার আদেশে আলাওল ‘সেকান্দার নামা’-এর পদ্যানুবাদ করেন। একই রাজত্বকালে মন্ত্রী সৈয়দ মুসার আদেশে আলাওল ‘সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল’ কাব্য রচনা করেন। হুসেন শাহের পুত্র সুলতান নসরত শাহের (১৫১৯-১৫৩১ খ্রি.) আমলে কবি বিদ্যাপতি ও শেখ কবিরের নাম পাওয়া যায়; যারা বৈষ্ণব পদ রচনা করেছেন। বিদ্যাপতির ভণিতায় সুলতানের রসজ্ঞ মনের পরিচয় পাওয়া যায়। এদের দু’জনকেই সুলতান পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন।
মধ্যযুগে মুসলমান শাসক ও অমাত্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক নবজাগরণের সূচনা হয়। বাঙালি মুসলিম কবি, লেখক, গবেষক ও সাহিত্য চর্চাকারীদের অবদানে আজ বাংলা-সাহিত্য এতটা সমৃদ্ধ আর বিকশিত হয়েছে, তাদের অন্যতম কয়েকজন হচ্ছেন শাহ মুহাম্মদ সগীর, দৌলত উজির, সৈয়দ সুলতান, আলাওল, কায়কোবাদ, শেখ ফয়জুল্লাহ প্রমুখ। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, ফররুখ আহমদ, মীর মশাররফ হোসেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, শেখ আব্দুর রহিম, আল মাহমুদ প্রমুখ বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃতি ও দিগন্তজয়ী ঔজ্জ্বল্যে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
বাংলা ভাষার কাব্যচর্চায় অগ্রসেনানি ত্রয়োদশ শতকের মুসলিম কবি শাহ মুহাম্মাদ সগীর। বলা হয়, তিনিই প্রথম মুসলিম, যিনি বাংলা ভাষায় কাব্যগীতি রচনা করে মুসলিমসমাজে জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন। শুরুর দিকে মুসলিমদের ধর্মকথা শোনানোর উদ্দেশ্যে কাব্য রচনায় প্রয়াসী হলেও ক্রমান্বয়ে তার কাব্য হয়ে ওঠে শিল্পমূল্যেও অনেক সমৃদ্ধ। (চলবে)
লেখক : কবি, লালবাগ, ঢাকা