হিজাব : উন্নত সভ্যতার প্রতীক

হাম্মদ এনায়েতুল্লাহ

প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের গায়ে বস্ত্র রাখা অথবা না-রাখা কোনটি সভ্যতা? প্রশ্নটা এ জন্যই যে, এই আধুনিক যুগে আমাদের মধ্যে ‘সভ্য’ হওয়ার যে চেষ্টা, এর কিছুটা এ দুটি ধারাতেও প্রবাহিত হচ্ছে। যারা হিজাববিরোধী তারা এটিকে ভাবেন সভ্যতার অধঃপতন, আবার যারা কাপড়মুখী তারা এটিকে অনেকটা ‘উত্তরণ’ হিসেবেই গ্রহণ করেন। তারা মনে করেন, গ্রীষ্মের খরতাপদগ্ধ আবহ থেকে তারা ফিরে এসেছেন ছায়ার শীতল আবহে। পোশাক ধরবে না ছাড়বে, কোনটা সভ্যতা? এ প্রশ্নে বস্ত্র বিসর্জনের চর্চা মানবসমাজে কোনকালেই খুব একটা সাড়া পায়নি এবং পাচ্ছে না আজও। শিক্ষার্থীরা যখন স্নাতক হন, শিক্ষার একটি পর্যায়ে উপনীত হন; তখন সেটা উদযাপন করা হয় গায়ে অতিরিক্ত একটি গাউন চাপিয়ে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষার্থীদের গা থেকে কিছু কাপড় কমিয়ে এটিকে উদযাপন করে না।

পৃথিবীর জৌলুশপূর্ণ সাজ-সজ্জার যত উদযাপন-আয়োজন সেখানে কাপড়ের বাহুল্যই চোখে পড়ে কাপড়ের সংকট নয়। এটি পৃথিবীতে টিকে থাকা রাজ-রাজরাদের নানা আয়োজন থেকে নিয়ে সমাজের বিত্তশালী, সম্মানিত, গণ্যমান্য, নেতৃস্থানীয়, সাধারণ সবার ক্ষেত্রেই। আবার পশ্চিমা জীবনে নারীদের ক্ষেত্রে কাপড়ের সংকট বহুল চর্চিত বিষয় হলেও তাদের পুরুষ সম্প্রদায় ব্যাপকভাবে নিজেদের এ সংকট থেকে রেখেছে মুক্ত। নগ্ন অর্ধনগ্নের এই অবাধ চর্চা যখন প্রধানত নারী জাতিকে লক্ষ্য করে চলছে তখন এটিকে নারী জাতির জন্য অবমাননা এবং তাদের জন্য এই আধুনিক যুগের অভিশপ্ত জীবন ব্যতীত আর কী বলা যায়? কিন্তু কথা থেকে যায় কাপড়ের বাহুল্য নিয়ে। বাহুল্যও কখনো কখনো জীবনকে বিষিয়ে তুলে। জীবনের স্বাছন্দ্যকে সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ করে। মানুষের প্রবণতা হলো, তারা বরাবরই বাড়াবাড়িতে কিংবা ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত হয়ে জীবনকে বিষময়, বিষাক্ত করে ফেলে। এমনকি আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামের সৌম্য সুন্দর মধ্যপন্থি জীবনব্যবস্থা সামনে থাকার পরও। এক সময় আমাদের এই জনপদে শিক্ষাদীক্ষার বিস্তার ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে কম। কিছু কেচ্ছা-কাহিনী, কিছু জনশ্রুতি, হাতে গোনা জনাকয়েক জ্ঞানীর কদাচিৎ আগমন কোন জনপদে ঘটলে তাদের আলোচনা; এ-ই ছিল সেসময়ে সাধারণের জন্য ধর্মীয় জ্ঞান হাসিলের গড়পড়তা উপায়। ফলে এদেশের ব্যাপক অংশ মুসলমান হওয়ার পরও প্রায়ই জড়িয়ে যেত সমাজের নানা প্রথা ও সংস্কারে। বোরকা কিংবা হিজাবকে কেন্দ্র করে সমাজে মানুষ সৃষ্ট যে নানা কুসংস্কার, তার উৎপত্তি এখান থেকেই।

পোশাক আমরা কেন পরি? শোভন, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য। নারীর নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা তুলনামূলক যে বেশি এটি সর্বযুগে সবাই স্বীকার করেন। আবার চলতে-ফিরতে শরীরের কিয়দংশ অনাবৃতও রাখা প্রয়োজন। এই দুই প্রয়োজনের মধ্যে চমৎকার সাযুজ্য ঘটিয়ে ইসলাম নারী জাতিকে হিজাব-নিকাবের বিধান দিয়েছে। আবার ইসলাম, সর্বোচ্চ গুরুত্বের বিধান নামাজ থেকে নিয়ে সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজনের বেলায় প্রয়োজন অনুপাতে ছাড়ও দিয়েছে। তাইতো আজ হিজাব সকল অপপ্রচার পাশ কাটিয়ে পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্র ক্রমশ হয়ে উঠছে নারীর জন্য সম্মান, মর্যদা ও নিরাপত্তার অনন্য প্রতীক।

সর্বশেষ যে বিষয়টি থাকে সেটি মানুষের ইচ্ছাধিকার। মূলত আমরা জীবনের খুব কম কাজই নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছায় করি। আমাদের ইচ্ছাগুলো সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রথা, প্রয়োজন, কাম-ক্রোধ-লোভ-ক্ষোভ এমন নানা কিছু দিয়েই প্রভাবিত থাকে। নানা সময় নানা ক্ষতিকর উদ্ভট চিন্তাও আমাদের মনে উদ্রেক হয়। সুতারাং মানুষ যেহেতু সমাজবদ্ধ জীব তাই ব্যক্তি ও সমাজের সর্বময় কল্যাণ যে-বিষয়টি দিয়ে নিশ্চিত হয়, সেটিই আমরা মেনে চলি এবং তা-ই আমাদের করা উচিত। মানুষ ও সমাজের কল্যাণে, সভ্য-উন্নত একটি জাতিরূপে নিজেদের গড়ে তোলার স্বার্থে, আমরা যখন আমাদের ইচ্ছাকে নানাবিধ নিয়মের শিকলে বেঁধে নিই, তখন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বময় কল্যাণ নিশ্চিতে স্রষ্টার বিধান সানন্দে বরণে কেন আমরা প্রস্তুত হবো না, যে বিধান আমাদের দিবে মননে শুদ্ধতা, চিত্তে প্রশান্তি আর সমাজে সম্মান ও নিরাপত্তা!

স্বভাববিরুদ্ধ কিছু করা মানুষের জন্য অস্বস্তিকর, কষ্টকর এবং ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতিকর। আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সা.) আমাদের জানিয়েছেন ইসলাম মানুষের স্বভাবধর্ম। যেমন সুরা রূমের ৩০নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন- ‘আপনি নিজেকে একনিষ্টরূপে এই দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন। এটিই মানবজাতির সেই স্বভাবধর্ম, যার উপর তিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।’ হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘ প্রতিটি শিশুই স্বভাব ধর্ম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এরপর হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) বলেন- এর ব্যাখ্যায় তোমরা ইচ্ছা করলে সুরা রূমের (পূর্বে উক্ত) আয়াতটি পড়ে নিতে পার। (বোখারি ও মুসলিম)। ইসলামের অন্য সব বিধানের ন্যায় হিজাবও নারী জাতির জন্য এমনই একটি সহজাত সুন্দর বিধান। আর এতেই রয়েছে তাঁদের জন্য শান্তি, স্বস্তি, সম্মান ও নিরাপত্তা। এমন সম্মান ও স্বস্তির জীবন চাইলে এই হিজাবই হতে পারে তাদের পরম আশ্রয়। হিজাবই শালীন সভ্যতার প্রতীক। নারীর প্রকৃত মর্যাদার ভূষণ।

লেখক : মুহাদ্দিস ও গবেষক, মুহাম্মদপুর, ঢাকা