ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

খুলাফায়ে রাশিদীনের শাসনামলের শিল্পপ্রযুক্তি

ড. মো. ইব্রাহীম খলিল
খুলাফায়ে রাশিদীনের শাসনামলের শিল্পপ্রযুক্তি

খুলাফায়ে রাশিদীনের শাসনামলে যন্ত্রনির্ভর শিল্পের পরিবর্তে কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ ঘটে। আরবের লোকেরা তাদের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুসারে বিভিন্ন বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে তোলে। মুসলিম জাহানের বিভিন্ন এলাকার প্রকৃতি ও কাঁচামালের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন শিল্প গড়ে ওঠে। পশুপালন ও পোলট্রি শিল্পে নতুন প্রযুক্তি সংযুক্ত হয়। মধুকে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব খাতের অন্তর্ভুক্ত করে মৌমাছি পালন ও মধু আহরণকে শিল্পের মর্যাদায় উন্নীত করা হয়। এ সময় লোকেরা আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছির চাষ শুরু করেননি সত্য তবে বিষয়টিকে তারা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন এবং এর উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা চালু করা হয়। একইভাবে রেশমি পোশাক বুননের ধারা রেশম চাষ ও সংগ্রহকে শিল্পের মর্যাদায় উন্নীত করে। আধুনিক মাছ চাষের ধারা শুরু হয় হযরত দাউদ (আ.)-এর সময় থেকেই। তখনই একদল লোক নদীর তীরে গর্ত খুঁড়ে আলাদাভাবে মাছ ধরার পদ্ধতি চালু করে। খুলাফায়ে রাশিদীনের আমলে সামুদ্রিক মাছ জাতীয় রাজস্বভুক্ত হয়। এ থেকেই অনুমান করা যায় যে, এ সময় মৎস্য সম্পদের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। বিশেষত ইরাক, ইরান, সিরিয়া ও মিসরে এ খাতে সরকারি সহযোগিতা দেয়া হয়েছিল। হযরত উসমান (রা.)-এর সময় থেকে মুসলিমরা প্রথম পূর্ণাঙ্গ নৌবহর গড়ে তোলেন। নৌবাহিনী গড়ে তোলার স্বার্থে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাহাজ নির্মাণ শিল্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ জন্য মিসর ও সিরিয়ার প্রকৌশলীদের ব্যবহার করা হয়। কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় মিসরে। চামড়া, মৃৎ, পোশাক ও অলঙ্কার, অস্ত্র, কুটির, কার্পেট, আসবাব ও নির্মাণ শিল্প কিছু উন্নতি লাভ করলেও নতুন কোনো প্রযুক্তির সংযোজন খুলাফায়ে রাশিদীনের সময়কালেও সম্ভব হয়নি।

খুলাফায়ে রাশিদীনের শাসনামলের কৃষি প্রযুক্তি : শিল্পের মতো কৃষিক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য কোনো প্রযুক্তি সংযোজিত হয়নি। তবে বনভূমির উন্নয়ন, পতিত জমি বন্দোবস্তকরণ, সরকারি চারণভূমি গড়ে তোলা, অনাবাদী জমি আবাদিকরণ, জমিচাষে বাধ্যবাধকতা আরোপের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। কৃষির উন্নয়নের জন্য খুলাফায়ে রাশিদীন অসংখ্য খাল ও কূপ খনন করেন। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বাঁধ নির্মাণ করে বন্যা প্রতিরোধের উদ্যাগ নেয়া হয়। ওমর (রা.) দজলা থেকে ‘মা’কিল’ নামে একটি খাল খনন করেন। ওমর (রা.)-এর প্রাদেশিক শাসক আল যুজ বিন মুআবিয়া একটি খাল খনন করেন। বন্যা প্রতিরোধের জন্য দজলা ও ফোরাতের তীরে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ইরাকের নহরে মাকিল, পারস্যে নহরে সাদ, মদীনায় বনাতনা ইলাহ খাল ইত্যাদি সেচ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন সাধন করে। কৃষির উন্নয়নের জন্য পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করা হয়। মিসর ও আরবের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের জন্য আমর বিন আস ‘আমীরুল মুমিনিন’ নামে একটি খাল খনন করেন। এ খালের মাধ্যমে নীলনদকে লোহিত সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এর ফলে মিসর থেকে আরবের সমুদ্রবন্দর ইয়েমেন পর্যন্ত যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের ব্যাপক সুযোগ তৈরি হয়। ফোরাত থেকে 'নহরে আবি মূসা' নামে ৯ মাইল দীর্ঘ একটি খাল খনন করে বসরার সঙ্গে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

খুলাফায়ে রাশিদীনের শাসনামলের নৌপ্রযুক্তি : প্রয়োজন না হওয়ায় এবং মরুচারী আরব মুসলমানগণ নৌ-পথে অভ্যস্ত না হওয়ায় মুসলিম নৌবাহিনী সংগঠনের কাজ কিছুটা বিলম্বে সম্পন্ন হয়। হযরত ওমর (রা.)-এর সময় লোহিত সাগর ও ভারতের পথে পারস্য উপসাগরে দুটি নৌ অভিযান সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হলে এ জাতীয় অভিযান বন্ধ করে দেয়া হয়। এ কারণেই সিরিয়ার শাসক মুআবিয়া (রা.) রোমানদের বিরুদ্ধে নৌ-অভিযান পরিচালনার আবেদন করেও খলিফা ওমরের অনুমোদন লাভ করতে ব্যর্থ হন। তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.)-এর সময় মুআবিয়া (রা.) নৌবাহিনী গঠনের অনুমতি লাভ করেন। প্রথম পর্যায়ে তাকে স্বেচ্ছাসেবক দ্বারা নৌবাহিনী গঠনের অনুমতি দেয়া হয় এবং কাউকে নৌবাহিনীতে যোগদানে বাধ্য করতে নিষেধ করা হয়। হযরত মুআবিয়া (রা.) আবু কায়িসের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম নৌবাহিনী গঠন করেন। তিনি নৌপথে প্রায় ৫০টি অভিযান প্রেরণ করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, এসব অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল সাইপ্রাস বিজয়। মুআবিয়া (রা.)-এর ক্রমাগত উদ্যোগ ও সহযোগিতায় ৩০ হিজরিতে মুসলিম নৌবহর এতই শক্তিশালী হয় যে, তা রোড সদ্বীপ দখল করে। মুসলিম নৌবাহিনীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব হচ্ছে ৩৪ হি./ ৬৫৪-৫৫ খ্রিষ্টাব্দে বাইজানটাইন নৌবাহিনীকে পরাজিত করা। এ অভিযানে নৌ সেনাপতি ইবনে আবু সারাহ ২০০ আরব রণতরীর সাহায্যে প্রায় ৬০০ রণতরীর বিশাল বাইযানটাইন বাহিনীকে পরাজিত করেন। পরবর্তীতে উমাইয়া বংশের শাসনামলে হযরত মুআবিয়া (রা.)-এর সময় আরব নৌবহর ভূমধ্যসাগরে গ্রিক প্রাধান্য ধ্বংস করে

আরব প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। আরব নৌবাহিনীতে মাঝি-মাল্লারা ছিল গ্রিক ও মিসরীয়। অভিযানগুলো প্রায়ই প্রেরিত হতো মিসর, আনাতোলিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন উপকূলবর্তী এলাকা হতে। নৌ-সেনারা বেতন ও ভাতা পেতো। নাবিকরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত না।

খুলাফায়ে রাশিদীনের শাসনামলের সামরিক প্রযুক্তি : খুলাফায়ে রাশিদীনের শাসনামলে তরবারি, বর্শা, তীর, ধনুক, পাথর ও আগুন ছুড়ে মারার বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র, ফিঙ্গা ইত্যাদি যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আত্মরক্ষার জন্য ঢাল এবং জেরা ও শিরস্ত্রাণ ব্যবহৃত হতো। জেরার মূল্য খুব বেশি ছিল। এ কারণে জেরা বা বর্শাধারী সৈন্যের সংখ্যা খুব কম ছিল। আরবদের তরবার ছিল দ্বিধারী। তাদের তীরের আকার ছিল ছোট এবং তীক্ষè। এ কারণে পারসিকরা একে আলপিন বলিত। প্রাচীরঘেরা দুর্গ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত নিক্ষেপকে ক্ষেপণাস্ত্র এবং দাব্বাবাহ ব্যবহৃত হতো। বাহরাসির অবরোধের সময় মুসলমানরা প্রায় ২০টি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেন। তায়েফ অভিযানের সময় লোহার পাত মণ্ডিত দাব্বাবাহ ব্যবহার করা হয়। দুর্গ প্রাচীরের বাইরের কৃত্রিম ঝিল বা পরিখা অতিক্রম করার জন্য বাতাস দ্বারা ফোলানো চামড়া ব্যবহার করা হতো। গম্বুজে দড়ি আটকিয়ে দড়ি বেয়ে প্রাচীর টপকে দুর্গে প্রবেশ করে কমান্ডো সেনারা দুর্গের ফটক খুলে দেয়ার কাজ করত। এরপর অপেক্ষমাণ সেনারা সহজেই দুর্গে ঢুকে এর দখল গ্রহণ করত।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত