ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়ানো ধর্ম ও মানবতার দাবি

মুফতি ইবরাহীম আল খলীল
বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়ানো ধর্ম ও মানবতার দাবি

বিপদে বন্ধুর পাশে থাকা, প্রতিবেশীর খবর নেয়া, আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসা এগুলো মানবিক গুণ। মানব জাতির এসব গুণের পরিশীলিত বিকাশকে বলা হয় সভ্য সমাজ বা সুস্থ সভ্যতা। এমন সভ্যতা নির্মাণে ইসলাম উৎসাহ প্রদান করে। সবার জানা আছে দেশের চলমান পরিস্থিতি। ভারি বর্ষণ ও ভারতের বাঁধ খুলে দেয়া পানিতে তলিয়ে গেছে দেশের কয়েকটি জেলার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল। খবর পাওয়া যাচ্ছে, বৃহত্তর ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লার কিছু অংশ, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় পানি বাড়ছে। ফেনীর মুহুরি নদীসহ ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন নদীর বাঁধগুলো ভারতের পক্ষ থেকে একতরফাভাবে, না জানিয়ে খুলে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মানবেতর একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা এবং তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত অগ্রসর হওয়া দরকার। এরই মধ্যে অন্তর্র্বর্তী সরকারের কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনী এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের সংস্থাগুলো দ্রুত এগিয়ে এসে বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে দুর্যোগকালীন পুরো সময়ে। এটাই মানবতা। এটাই সুস্থ সভ্যতা। দেশ ও মানব প্রেম। ধর্ম প্রতিপালন।

আমরা দেখেছি, কয়েকটি জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। টানা মুষলধারে ভারি বৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে হাজার হাজার মানুষ আজ পানিবন্দি। বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে অসহায় মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে, ব্রিজ তলিয়ে গেছে। দোকানপাট বন্ধ। বাজার সদাইয়ের ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ। সুপেয় পানিরও মারাত্মক সংকট। শিশু ও বৃদ্ধদের দুর্ভোগ চরমে। এমতাবস্থায় সমাজের বিত্তবান ও মানবিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের দায়িত্ব হচ্ছে, বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানো। বন্যাকবলিত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত বানভাসি মানুষের পাশে যার যা কিছু আছে, তা নিয়েই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসা ইমানি দায়িত্ব ও নববি আদর্শ। অসহায় মানুষকে খাদ্য-বস্ত্র দিয়ে সাহায্যের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে।

অসহায় মানুষ ও সৃষ্টির সেবা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। এটি স্বতন্ত্র একটি ইবাদতও বটে। এ বিষয়ে ত্রুটি হলে কেয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। প্রশ্ন করা হবে বস্ত্রহীনদের বস্ত্রদান ও ক্ষুধার্তদের খাদ্যদান সম্পর্কে। ইসলাম মানবীয় গুণাবলির ক্ষেত্রে পরোপকার ও জনকল্যাণমূলক কাজকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ আখ্যা দিয়ে এর প্রতি উৎসাহ দেয়। কোরআনে করিমের মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা মানুষের প্রতি তেমন অনুগ্রহ করো (সদকা বা যেকোনো উপায়ে) যেমন আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। (সুরা কাসাস, আয়াত ৭৭)।

বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো ঈমানের দাবি : বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। মানবেতর লোকদের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয় ইসলাম। ক্ষুধার্ত-অনাহার লোকদের আহার্যের ব্যবস্থা করার সবক ইসলামেরই দেয়া। কোরআন ও হাদিসে এর প্রতি অনেক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানুষের কল্যাণের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১১০)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মানুষের কল্যাণ সংশ্লিষ্ট যত কাজ আছে তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম হচ্ছে দরিদ্র ও ক্ষুধার্তদের খাবার দান করা। (সহি বোখারি, হাদিস : ১৩)। অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম তুমি আমাকে দেখতে আসোনি। সে বলবে, হে প্রভু! কীভাবে আমি আপনাকে দেখতে যাব? আপনি তো সারা জাহানের পালনকর্তা। তিনি বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল। তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে তাহলে অবশ্যই তুমি আমাকে তার কাছে পেতে। হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম। তুমি আমাকে খাবার দাওনি। সে বলবে, হে প্রভু! আমি আপনাকে কীভাবে খাবার দেব? আপনি তো সারা জাহানের প্রভু। আল্লাহ বলবেন, তোমার কি জানা ছিল যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল। কিন্তু তাকে তুমি খাবার দাওনি। তোমার কি জানা ছিল না যে, যদি তাকে খাবার দিতে তাহলে অবশ্যই তা আমার কাছে পেতে। হে আদম সন্তান! তোমার কাছে আমি পানি পান করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে পান করাওনি। বান্দা বলবে, হে প্রভু! আপনাকে কীরূপে পানি পান করাব? আপনি তো সমগ্র জগতের প্রভু। তিনি বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল। তুমি তাকে পান করাওনি। তুমি কি জানতে না যে, যদি তাকে পান করাতে তাহলে তা অবশ্যই আমার কাছে পেতে। (মুসলিম, হাদীস : ৬৭২১)।

বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়ানো ইসলামের শিক্ষা : সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও যারা বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না, তাদের জন্য আল্লাহর দয়া সংকুচিত হয়ে আসবে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না, তার প্রতিও দয়া করা হয় না। (জামে তিরমিযি : ৪/৩২৩) পক্ষান্তরে যারা তাদের এই দুঃখের দিনে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করে, তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করবে, আল্লাহতায়ালা তাদের মহান পুরস্কারে ভূষিত করবেন। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, জমিনে যারা আছে, তাদের প্রতি দয়া করো, আকাশে যিনি আছেন, তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। (জামে তিরমিযি : ৪/৩২৩) বন্যার্তদের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করলে আল্লাহ তাদের জান্নাতে রিজিক দিয়ে সম্মানিত করবেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি কোনো বস্ত্রহীনকে কাপড় পরাবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের সবুজ রেশমি কাপড় পরাবেন। যে ব্যক্তি কোনো ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে আহার করাবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। যে ব্যক্তি কোনো তৃষ্ণার্তকে পানি পান করাবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের পবিত্র প্রতীকধারী শরাব পান করাবেন। (আবু দাউদ : ২/১৩০) অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের পার্থিব সংকট বা বিপদ দূর করবে আল্লাহতায়ালা তার কেয়ামতের কঠিন বিপদ দূর করে দেবেন। (সহি মুসলিম)।

আসুন আমরা বন্যাদুর্গত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। সারা দেশের সার্মথ্যবান মানুষেরা যদি আজ এগিয়ে আসে তাহলে এই দুর্যোগকে কাটিয়ে উঠা কঠিন বা অসম্ভব নয়। আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসে এসব দুর্গত মানুষরা অচিরেই তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে, একথা আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি। বন্যাকবলিত এলাকায় এ দুঃসময়ে সমাজের বিত্তবানদের জন্য দুস্থ মানবতার সেবায় এগিয়ে আসা একান্ত আবশ্যক। নিজ প্রতিবেশী থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে সমাজের সর্বস্তরের দুস্থ মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া ঈমানের একান্ত দাবি। তাই আসুন বন্যাদুর্গত মানুষের কাছে পৌঁছে দিই প্রয়োজনীয় খাবার, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধ। দল-মত নির্বিশেষে সহযোগিতা করতে হবে। সমবেদনা জানাতে হবে। দুস্থ মানুষের জন্য যতটুকু সম্ভব বিলিয়ে দিতে হবে। মানবসেবায় এগিয়ে না আসা অমানুষের স্বভাব। মানুষ মানুষের জন্য। সৃষ্টির সেবা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণ। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে প্রত্যেকটি দুর্যোগের সময় নিজ নিজ উদ্যোগে দুস্থ ও অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করে সমাজে অবদান রাখার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : শিক্ষক, মাদ্রাসা আশরাফুল মাদারিস, তেজগাঁও, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত