ছোটদের বদনজরের কোরআনি চিকিৎসা
শরিফ আহমাদ
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বদনজর বা কুদৃষ্টি বিষাক্ত তীরের মতো। হিংসুকের প্রতিটি ঈর্ষাকাতর চাহনি এবং অতিমাত্রার মুগ্ধতা বদনজরের উৎস। যুগে যুগে বদনজরের সমস্যা ও তার সমাধান ছিল। বর্তমানে আধুনিকতার দোহাই দিয়ে এটাকে অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। কেননা, কোরআনের সুরা ইউসুফের ৬৭ নং আয়াত ও সুরা কালামের ৫১ নং আয়াতে বদনজর প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে অনেক হাদিস আছে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা বদনজর থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও। কেননা, বদনজর সত্য। (ইবনে মাজাহ : ৩৫০৮) বদনজর দ্রুত প্রভাব বিস্তার করে ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে।? এ জন্য নির্ধারিত নিয়মে নির্ধারিত কিছু বাক্যের মাধ্যমে রুকইয়া করা হলে সুস্থতার নেয়ামত লাভ করা যায়। নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করা সহজ হয়। তাই অভিভাবকদের সচেতন হওয়া একান্ত জরুরি।
বদনজর লাগে কেন? : দুষ্ট জীনের আছর এবং মানুষের লাগামহীন কথার প্রভাবে ছোটরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। দেখা দেয় আরো অনেক সমস্যা। আজকাল ফেসবুকে ছোটদের ছবি আপলোড করার কারণে বদনজরের প্রভাব বেশি দেখা যায়।? কিছু কিছু মানুষ মুখের উপর ছোটদের প্রশংসা বয়ান করে। মাশাআল্লাহ, সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ না বলে এমন কথা বলে যার মাধ্যমে ছোটদের বদনজর লাগে। বদনজর শুধু হিংসুক নয়, মুমিন ব্যক্তির কথার দ্বারাও লাগতে পারে। সাহল ইবনে হুনাইফ (রা.) কোথাও গোসলের জন্য জামা খুলেছিলেন। তিনি অত্যন্ত সুশ্রী এবং ফর্সা অবয়বের অধিকারী ছিলেন। বদরী সাহাবী আমির ইবনে রবিয়া (রা.) তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, এত সুন্দর কাউকে আমি জীবনে দেখিনি। এমনকি কুমারীর চামড়াও তো এর সঙ্গে তুলনীয় নয়। তিনি কথাটা বলার পর পরে সাহল সেখানে বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন। তার গায়ে জ্বর চলে এলো এবং তিনি জ্বরের প্রচণ্ড ছটফট করতে লাগলেন। অন্য সাহাবীরা রাসুল (সা.) কে অবস্থা জানালেন।
বদনজরের লক্ষণ : বদনজরে আক্রান্ত ছোট বাচ্চাদের মধ্যে বেশ কিছু লক্ষণ ফুটে ওঠে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- শিশুরা মায়ের বুকের দুধ বা খাবার খেতে না চাওয়া, অনর্থক ভয় পাওয়া, অস্বাভাবিক কান্নাকাটি ?করা ইত্যাদি। আক্রান্ত সন্তানদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবায় সুস্থ করা না গেলে রুকইয়া করাতে হয়। দেরি করা মোটেও ঠিক নয়। উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) তার ঘরে এক বালিকাকে দেখলেন, যার চেহারায় জীনের বদনজরের চিহ্ন ছিল। রাসুল (সা.) বললেন, এই মেয়ের জন্য রুকইয়ার (ঝাড়ফুঁক) করো। কারণ তার বদনজর লেগেছে। (বোখারি : ৫৪০৭, মুসলিম : ৪০৭৪)।
বদনজরের কোরআনি চিকিৎসা : ছোটদের বদনজরের রুকইয়া বা কোরআনি চিকিৎসা প্রধানত দুই পদ্ধতিতে করা যায়।
এক. কোরআনের আয়াত বা হাদিসে বর্ণিত দোয়া লিখে গলায় ঝুলিয়ে দেয়া। আমর ইবনে শুআইব তার পিতা ও তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যখন ঘুম অবস্থায় ঘাবড়িয়ে উঠে, সে যেন আউযু বিকালিমা-তিল্লাহিত্তাম্মাতি মিং গদাবিহি ওয়া শাররি ইবাদিহি ওয়া মিন হামাঝাতিশ শায়াতিনি ওয়া আই ইয়াহদুরুন দোয়াটি পাঠ করে। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর তার উপযুক্ত সন্তানদের তা শিক্ষা দিতেন এবং ছোটদের গলায় তা লিখে লটকিয়ে দিতেন। (আবু দাউদ : ৩৮৯৫)।
দুই. বিশেষ দোয়া বা সুরা পাঠ করে ঝাড়ফুঁক করা। এগুলো নিজে পাঠ করে ছোটদের ঝাড়ফুঁক করতে হয়। এ সম্পর্কে সহজ ও সংক্ষিপ্ত চারটি আমল এরকম-
এক. উসমান ইবনে আফফান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি সকাল সন্ধ্যায় তিনবার এই দোয়া পাঠ করবে কিছুই তার কোনরূপ ক্ষতি করতে পারবে না । দোয়াটি- বিসমিল্লা হিল্লাজি লা-ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইউং ফিল আরদি ওয়ালা ফিসসামাই ওয়াহুয়াস সামিউল আলীম। (আবু দাউদ : ৫০৮৮, তিরমিজি : ৩৩৮৮)।
দুই. সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা তিনবার করে এই দোয়া পাঠ করবে সে প্রতিটি মাখলুকের অনুষ্ঠিত থেকে রক্ষা পাবে । বিশেষ করে সাপ বিচ্ছুর অনিষ্ট থেকে রেহাই পাবে । দোয়াটি হলো– আউযু বিকালিমা-তিল্লাহিত্তাম্মাতি মিং শাররি মা খলাক ।( মুসলিম: ৬৬৩২, তিরমিজি:৩৬০৪)
তিন. ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) হাসান এবং হুসাইন কে এই দোয়া পড়ে ঝাড়ফুঁক করতেন আর বলতেন তোমাদের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) এই দোয়ার মাধ্যমে ( ইসমাইল ও ইসহাক ) কে ঝাড়ফুঁক করতেন। আউযু বিকালিমা-তিল্লাহিত্তাম্মাতি মিং কুল্লি শাইতানিন ওয়াহাম্মাহ ওয়ামিং কুল্লি আইনিন লাম্মাহ। (বোখারি : ৩১৩২)।
চার. আব্দুল্লাহ ইবনে খুবাইব (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, সকাল-সন্ধ্যায় তিনবার সুরা ইখলাস, ফালাক এবং নাস পাঠ করবে। সবকিছুর ক্ষেত্রে তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। (তিরমিজি : ৩৫৭৫)। একবার সুরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি ও সুরা জীনের প্রথম পাঁচটি আয়াত পড়ে ঝাড়ফুঁক করলেও যথেষ্ট উপকার পাওয়া যায়।
প্রচলিত কুসংস্কার : ছোটদের বদনজর থেকে হেফাজতের উদ্দেশ্যে সমাজের কোথাও কোথাও সন্তানের শিথানের পাশে ছোট ছুরি বা লোহার টুকরো রাখা হয়। বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে পুরাতন জালের কাঠি ও ঘরের দেয়ালে গরুর হাড্ডি ঝুলিয়ে রাখা হয়। এগুলো প্রচলিত কুসংস্কার।? এর মাধ্যমে সন্তানের হেফাজত হয় না। আবার কোথাও কোথাও বদনজর থেকে বাঁচানোর জন্য ছোটদের চোখে কাজল এবং কপালে টিপ দেয়া হয়। এগুলো পুরোপুরি কুসংস্কার। কেউ যদি এই ধারণা করে যে কাজলের মধ্যে বদনজর প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে তাহলে তা শিরক হিসেবে গণ্য হবে। তবে যদি কেউ সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে ছোট বাচ্চাদের চোখে বা ভ্রুতে কাজল ব্যবহার করে তাহলে তার অবকাশ আছে। আর কোনো মুসলিমের জন্য কপালে টিপ দেয়া সঙ্গত নয়। সে ছোট হোক কিংবা বড়। কেননা, এটা মুসলিম সভ্যতা সংস্কৃতি নয়। কপালে টিপ পরা হিন্দুধর্মের তিলক সিঁদুরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। কাজেই এর থেকে প্রত্যেক মুসলমানের বেঁচে থাকা আবশ্যক।
লেখক : কবি ও শিক্ষক