ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইসলামে খেলাফত ও খলিফা

মুফতি ইবরাহীম আল খলিল
ইসলামে খেলাফত ও খলিফা

খেলাফত হলো ইসলামি সরকারব্যবস্থা। যেখানে থাকবে পূর্ণ কোরআন-সুন্নাহর আইন। তা বাস্তবায়ন হবে সবার মাঝে। হবে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রাধান্যতা। আল্লাহর কালিমা থাকবে সুউচ্চ। এই মর্মের ধারক শাসনব্যবস্থা যে নামেই চালু থাকুক না কেন, তা খেলাফতের আওতাভুক্ত। শর্তসাপেক্ষে নসবুল ইমাম (খলিফ নিয়োগ) ওয়াজিব। সিফাত (গুণ) বিশিষ্ট আমির তালাশ করা ওয়াজিব। এর মর্ম হলো ইসলামি হুকুমত গঠন করা। এটা ওয়াজিব আলাল কেফায়া। এই ওয়াজিব নামাজের মত স্বল্প সময়ের সঙ্গে বাধা নয়। যত লম্বা সময় লাগুক, শর্ত মোতাবেক ক্ষমতায় আসীন এবং ক্ষমতার বাইরের সবাই এই ওয়াজিবের আওতাভুক্ত। ইসলামের সম্মিলিত বিধানাবলীর মধ্যে খেলাফত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বেশি কল্যাণকর।

বিশ্বমানবতার সুখ-সমৃদ্ধি ও নিরাপদ জীবনের জন্য ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অত্যধিক। খেলাফত ও খলিফা শব্দগুলো সরাসরি কোরআনে কারীমে আছে। মহান আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারীমে খেলাফত প্রদানের কথা আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যকার ওই সব লোক যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে, তাদের প্রতি আল্লাহ পাক ওয়াদা করেছেন এই মর্মে যে, তাদের তিনি অবশ্যই পৃথিবীতে খেলাফত দান করবেন। যেমন তিনি পূর্ববর্তীদের দান করেছিলেন। তিনি অবশ্যই তাদের দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা দান করবেন, যার উপরে তিনি রাজি হয়েছেন মুমিনদের জন্য এবং তিনি অবশ্যই তাদের ভীতির পরিবর্তে শান্তি দান করবেন। তারা যেন আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে অন্য কিছুকে শরিক না করে। যারা এর পরে কুফরি করবে (অর্থাৎ খেলাফত প্রাপ্তির ওই নেয়ামতের না-শোকরি করবে), তারা ফাসেক। তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত আদায় করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হতে পার। (সুরা নূর, আয়াত ৫৫-৫৬)।

খেলাফত শব্দের অর্থ : খেলাফত আরবি শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রতিনিধিত্ব বা প্রতিনিধির পদ। অন্য অর্থে, ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলনীতি ও ইসলামি শাসনসংস্থা। খেলাফত থেকেই খলিফা শব্দটির উদ্ভব, যার অর্থ খেলাফত সংগঠনের সর্বোচ্চ পদাধিকারী, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, জাতির ইহলৌকিক ও পারলৌকিক বিষয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত নেতা বা আমিরুল মুমিনি।

ইসলামি পরিভাষায় খলিফা হলেন, এমন ব্যক্তি যিনি যাবতীয় বিষয়ে শরিয়ত অনুযায়ী সমস্ত উম্মতকে পরিচালিত করেন। ইসলামি রাষ্ট্রে খলিফা সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে গভর্নর, শাসক, নেতা, কাজী নিযুক্ত করেন।

খেলাফতের সূচনা : খেলাফতের সূচনা হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর, হজরত আবু বকর (রা.) খলিফা হওয়ার মধ্য দিয়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খোলাফায়ে রাশেদীন এবং পরবর্তী খলিফারা এই খেলাফত ও শরিয়ার মাধ্যমে দুনিয়া থেকে সকল অন্যায়-অবিচার দূর করে মানবজাতিকে এক শান্তিময় পৃথিবী উপহার দিয়েছিলেন। তাদের ন্যায়-ইনসাফের ফলে দুনিয়া থেকে যাবতীয় অন্যায় ও বৈষম্য বিদায় নিয়েছিল। মানুষে মানুষে হানাহানি, মারামারি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অন্যায় অপরাধ কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। সবার মনে আল্লাহর ভয় জাগ্রত ছিল। প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এক সোনালি যুগের। ফিরে এসেছিল সোনালি সকাল।

জাকাতভিত্তিক অর্থব্যাবস্থার ফলে সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিদায় নিয়েছিল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, লোকেরা যাকাত দেয়ার জন্য গরিব খুঁজতো, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানায় গরিব খুঁজে পাওয়া ছিল অনেক কষ্টসাধ্য। সেসময় ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত এত বেশি মজবুত ছিল যে, কাফেররা মুসলিমদের উপর হামলা করা তো দূরের কথা চোখ তুলে তাকানোর সাহসও পেতো না। মুসলিমদের সাহসিকতা ও বীরত্ব দেখে তারা সর্বদা ভীত সন্ত্রস্থ থাকত। চারদিকে ইসলামী রাষ্ট্রের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, কাফের দেশের নাগরিকরা তাদের রাজাদের জুলুম থেকে মুক্তির জন্য মুসলিম বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানাত। কিন্তু পরবর্তীতে আমাদের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার ফলে যখন খিলাফতের পতন হলো এর স্থলে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র নামক জুলুমতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন জালিমরা তাদের জুলুমকে স্থায়ী করার জন্য ইসলামী খেলাফত ও শরিয়াহর ব্যাপারে মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা চালাতে শুরু করল। শরিয়াহ শাসন ও ইসলামী দণ্ডবিধিকে তারা মানুষের সামনে বাঘ ভাল্লুকের চেয়েও ভয়ংকর বস্তু হিসেবে তুলে ধরল। যেন মানুষ ভুলেও ইসলামী শরীয়া ফিরিয়ে আনার চিন্তা না করে। এখন হয়েছেও তাই, মানুষ কয়েক বছর পর পর নতুন জালিম নির্বাচন করে। তাদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে গেলে আবার নতুন কাউকে নির্বাচন করে। এভাবেই জুলুমের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে উম্মাহ। কিন্তু খেলাফত ও শরিয়াহ ফিরিয়ে আনার ফিকির কারো মাথায় আসছে না।

খেলাফতের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর দাসত্বের মহিমা : আমরা হলাম দুনিয়াতে আল্লাহতায়ালার খলিফা বা প্রতিনিধি। প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের কাজ হল জমিনে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা এবং নিজেরা মেনে চলা। মানবজাতির ইহকাল ও পরকালের যাবতীয় কল্যাণ এই খেলাফত ও শরিয়াহর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। বর্তমানে দুনিয়াতে যে এত অন্যায়-অপরাধ, চারদিকে মারামারি-হানাহানি ও বিশৃঙ্খলা, এর সমাধান একমাত্র পরিপূর্ণ খেলাফত ও শরিয়াহর মধ্যেই রয়েছে। শরিয়াহ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে এই অশান্ত পৃথিবীকে পুরাপুরিভাবে শান্ত করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের সৃষ্টি করেছেন আল্লাহতায়ালা। আর স্রষ্টাই ভালো জানেন, কীভাবে চললে তার সৃষ্টি ভালো থাকবে। কোন ধরনের আইন প্রতিষ্ঠিত হলে দুনিয়াতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকবে। তিনিই ভালো জানেন কোন উপায়ে তার সৃষ্টিকে অন্যায়-অপরাধ থেকে বিরত রাখা সম্ভব। কোন উপায়ে ধনী-গরিবের বৈষম্যদূর করে সম্পদের সুষম বণ্টন করা সম্ভব। তাই তিনি সেই অনুপাতেই আমাদের জন্য বিধি বিধান দিয়েছেন। এই খেলাফতেই রয়েছে আল্লাহর দাসত্বের মহিমা। ইবাদতের পূর্ণ স্বাদ তার মাঝেই পাওয়া যায়।

ইসলামে খিলাফত প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব : মুসলিমদের সামগ্রিক জীবনে ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির জন্য ইসলামি খেলাফত বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। নির্ভেজাল তাওহিদ বা শিরকমুক্ত ঈমান বজায় রাখা, ইসলামের প্রকাশ্য ঘোষিত গুরুত্বপূর্ণ বিধানাবলী ও ইবাদতের পূর্ণ বাস্তবায়ন, আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান জারি করা, মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্য জমিনে দৃশ্যমান হওয়া, জিনা-ধর্ষণ বন্ধ, হত্যারোধ, হারাম বর্জন, হালাল উপার্জনের নিশ্চয়তা, বৈষম্যমুক্ত অর্থনীতি প্রচলনসহ ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইনের বাস্তবায়নে ইসলামী খেলাফত বিকল্পহীন একটি ব্যবস্থা। তাই এটিই ইসলামের একটি বড় ও জরুরি ফরজ। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ ও ঘোষণা হচ্ছে, নিশ্চয়ই পৃথিবীতে আমি খলিফা (প্রতিনিধি শাসক) পাঠাব। (সুরা বাকারা, আয়াত ৩০) অপর এক আয়াতে তিনি বলেন, হে রাসূল, আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, আপনি তা দিয়ে বিচার-ফায়সালা-শাসন করুন। আপনার কাছে যে সত্য এসেছে, সে ব্যাপারে ওদের মনগড়া কথা-বার্তার অনুসরণ করবেন না। (সুরা মায়িদা, আয়াত ৪৯)।

খেলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং যোগ্য খলিফা নির্বাচন করা ফরজ হওয়ার ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ইজমা (ঐক্যমত) রয়েছে। সকল আকিদার কিতাবে ‘নসবুল ইমাম’ (শাসক নিয়োগ) এর মাসআলা খুব গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং নসবুল ইমামের প্রচেষ্টা থেকেই ইসলামী সিয়াসতের সূচনা। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, একজন খলিফা নির্বাচন করা মুসলমানদের উপর ওয়াজিব। এ ব্যাপারে ইমামদের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটা ওয়াজিব হওয়া শুধু যুক্তির নিরিখে নয় বরং শরিয়তের দৃষ্টিতেও। (শরহে নববী, ১২/২০৫) হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন, খলিফা নির্বাচন করা ওয়াজিব। এ বিষয়ে সকল ইমাম একমত এবং শরিয়তের দলিলের আলোকে ওয়াজিব, শুধু যুক্তির আলোকে নয়। (ফাতহুল বারী ১৩/২০৮)।

হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহ.) বলেনন, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও গুণাবলীসম্পন্ন একজন খলিফা নির্বাচন করা মুসলমানদের ওপর ফরযে কেফায়া। এ ফরয কেয়ামত পর্যন্ত বাকি থাকবে। এ বিষয়ে শরিয়তের দলিলগুলো নিম্নরূপ: এক. সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাফনকার্য সম্পন্ন করার আগেই খলিফা নির্বাচনের প্রতি মনোনিবেশ করেন। খলিফা নির্বাচন ফরজ হওয়ার ব্যাপারে শরিয়তের কোন দলিল না থাকলে তারা খলিফা নির্বাচনকে নবীজির দাফন কার্যের ন্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর প্রাধান্য দিতেন না।

দুই. হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করল, অথচ তার গলদেশে বাইআতের রজ্জু শোভা পায়নি, সে জাহেলি মৃত্যু বরণ করল। ( সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৮৪৮)।

জিহাদ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, দ্বীনি ইলম জিন্দা রাখা, আরকানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা, ইসলামী সাম্রাজ্যের হেফাজত ইত্যাদিকে আল্লাহতায়ালা ফরজ করেছেন। আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী আমির ছাড়া এ কাজগুলো আঞ্জাম পেতে পারে না। শরিয়তের স্বীকৃত মূলনীতি হলো, মুকাদ্দিমাতুল ওয়াজিব ওয়াজিব অর্থাৎ ফরজ আদায় যার উপর নির্ভর থাকে, তাও ফরজ। (ইযালাতুল খাফা বাইনাল খেলাফতে ওয়াল খোলাফা, পৃষ্ঠা ১৭)।

খেলাফতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরত করে প্রথমে মদিনা কেন্দ্রিক ইসলামী খেলাফত বা রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেন। মদিনায় বসবাসরত মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সব গোত্রের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক সম্পাদিত ৪৭ ধারাসম্বলিত সংবিধানটিই পৃথিবীর ইতিহাসে ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত।

তাই আসুন আমরা সবাই মিলে মানুষের সামনে ইসলামী শাসনের সৌন্দর্য তুলে ধরি। মসজিদের মিম্বার এবং বয়ানের স্টেজগুলোতে অন্যান্য দ্বীনি বিষয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি এই সব ব্যাপারেও বয়ান করি। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: শিক্ষক, মাদ্রাসা আশরাফুল মাদারিস, তেজগাঁও, ঢাকা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত