সুফি-সাধক শাহজালাল ও পুণ্যভূমি সিলেট
শাহাদাত হোসাইন
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে সুফি-সাধকদের অবদান সূর্যালোকের মত দেদীপ্যমান। আলোর মশালবাহী এই সাধকেরা আলোর ফেরী করেছেন জগৎময়। ঐশী আলোয় দিশা দিয়েছেন পথচ্যুত জাতিকে। মানবহিতৈষী এসব সাধকের অনেকেই মাতৃভূমি ছেড়ে এদেশে এসেছিলেন ঈমান ও ইসলামের অমীয় বাণী প্রচার করতে।
আল্লাহর একত্ববাদের পয়গাম পৌঁছাতে। শাহ জালাল মুজাররদ ইয়ামেনি (রহ.) সেই সমস্ত সুফিদের অন্যতম। বাংলাদেশ, বিশেষত সিলেট অংশে ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারে যার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি শাহ জালাল ইয়ামেনি। ইসলামে চলার পথে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে আমাদের জন্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
জন্ম ও পরিচয় : তাঁর জন্ম ও জন্মস্থান সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মতানৈক্য রয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ হলো, তিনি ১২৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মে ইয়ামেনে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের ৩ মাস পরে মাকে হারান। এবং ৫ বছর বয়সে পিতা মাহমুদ জিহাদে শাহাদাত বরণ করেন। পিতামাতার ছায়াহীন শাহ জালালের দায়িত্ব নেন মামা সৈয়দ আহমাদ কবির সোহরাওয়ার্দী। তিনি তাকে কোরআন হাদিস শিক্ষার সাথে সাথে তরিকতের জাহেরি-বাতেনি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন।
সুফিবাদের দীক্ষা : শাহ জালাল (রহ.) জন্মগতভাবেই সুফি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার ইসলাম প্রীতি ও উৎসর্গতা, তাকে ইসলামের বাণী প্রচারে উৎসাহিত করে। কালিমার প্রচার কচি হৃদয়ের সুপ্ত বাসনায় পরিণত হয় বাল্যকালেই। মায়ের দিক থেকে তিনি প্রখ্যাত দরবেশ সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারির দৌহিত্র ছিলেন।
সর্বোপরি মামা সৈয়দ আহমাদ কবির সোহরাওয়ার্দীর সুফিয়ানা লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষা সুফিবাদের প্রতি উৎসাহ ও প্রেরণা জোগায়। যার কারণে তিনি সুফিবাদকে জীবনের অরাধনা হিসাবে গ্রহণ করেন এবং ইসলাম প্রচারে নিবিষ্ট হন (ইসলাম ইন সাউথ এশিয়া)।
ইসলাম প্রচারে হিজরত : শাহ জালাল (রহ.) ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের স্বপ্ন দেখলে, স্বীয় মামা ও শায়খ সৈয়দ আহমাদ কবিরকে তা অবহিত করেন। তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা সাপেক্ষে তাকে ভারতবর্ষে গমনের আদেশ দেন। যাত্রাকালে আহমাদ কবির তার হাতে একখণ্ড মাটি দিয়ে বলেন, যে স্থানের মাটির সাথে এই মাটির স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণ মিলে যাবে, সেখানে আস্তানা প্রতিষ্ঠা করে ইসলাম প্রচারে ব্রতী হবে (বাংলাদেশে সুফী-সাধক)।
নিজামুদ্দীন আউলিয়া ও জালালি কবুতর : সুদূর আরব থেকে সফর করে তিনি ভারতের দিল্লিতে এসে উপস্থিত হন। বিখ্যাত সুফি-সাধক নিজামুদ্দীন আউলিয়ার দরবারে গমন করেন। নিজামুদ্দীন আউলিয়া শাহ জালালের আধ্যাতিক শক্তি আঁচ করতে পেরে তাকে সাদর আমন্ত্রণ জানান। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে, প্রস্থানের ইচ্ছা করলে নিজামুদ্দীন আউলিয়া তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানান এবং তাকে কিছু কবুতর উপহার দেন। বলা হয়, বর্তমান তার মাজারে যে কবুতর দেখা যায় এগুলো সেই কবুতরেরই প্রজনন প্রজন্ম। যা জালালি কবুতর নামে প্রসিদ্ধ।
সিলেটে আগমন : দিল্লি থেকে প্রস্থান করে বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে তিনি বাংলাদেশের সিলেটে উপস্থিত হন। তৎকালে সিলেটে গৌড় নামে একটি রাজ্য ছিল। যার রাজা ছিলেন হিন্দুরাজা গৌরগোবিন্দ। প্রজারা তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন। কোরবানি করার অপরাধে বোরহানুদ্দিন নামক একজন মুসলমানের হাত কেটে দেয়। অত্যাচারে জর্জরিত বোরহানুদ্দিন পাশের বাদশাহ ফিরোজ শাহের কাছে এর প্রতিকার প্রার্থনা করলে, তিনি স্বীয় ভাগিনা সিকান্দার গাজীকে সৈন্য বাহিনীর প্রধান করে প্রেরণ করেন। তারা তিনবার গৌরগোবিন্দের হাতে পরাস্ত হয়। এর পরে তাদের সাক্ষাৎ হয় শাহ জালালের সাথে। তাকে পেয়ে তারা উজ্জীবিত হয় এবং তারা বিজয় লাভ করে। (আমাদের সুফি-সাধক)।
জায়নামাজে নদী অতিক্রম : বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়, শাহ জালাল (রহ.) তার সঙ্গীদের নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদী পার হওয়ার ইচ্ছা করলে, পূর্ব থেকেই তার অলৌকিক বিষয়ে অতিষ্ঠ গৌরগোবিন্দের সৈন্যরা অগ্নিবানের মাধ্যমে তাদের প্রতিহত করে। কিন্তু তা দ্বারা শাহ জালাল বাহিনীর কোনো ক্ষতি করতে সক্ষম না হওয়ায়, গৌরগোবিন্দ উপায়ান্তর না দেখে বারাক নদীর নৌকা চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেন। শাহ জালাল (রহ.) ও তার সঙ্গীরা আল্লাহর ওপর ভরসা করে নিজেদের জায়নামাজকে নৌকা বানিয়ে বারাক নদী অতিক্রম করেন (হযরত শাহ জালাল একটি মহাকাব্য)।
গৌরগোবিন্দের পতন : হিন্দু রাজার সকল কলা-কৌশল ব্যর্থ হলে, সে যাদু-মন্ত্রের আশ্রয় নেয়। তাতেও সে বিফল হয়। শাহ জালাল বাহিনীর তাকবির সম্বলিত আক্রমণে গৌরগোবিন্দ রাজ্য ছেড়ে পালায়ন করে। সিলেট মুসলমানদের দ্বারা বিজিত হয়। সেখানকার হিন্দুধর্মী অনেক নরী-পুরুষ এই মহাতাপস ও তার শিষ্যদের মনকাড়া ব্যবহার ও ইসলামের সাম্যবাদে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।
আজানে ধন্য সিলেট ভূমি : নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের প্রভুত্ব একমাত্র আল্লাহর। সেখানে তাঁর নাম উচ্চারিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যুগে যুগে শয়তানের ধোঁকায় মানুষ স্বীয় স্রষ্টাকে ভুলে, শয়তানের পূজারি হয়েছে। পুজো করেছেন ৩৩ কোটি দেব-দেবীর। শাহ জালালের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সিলেটে গৌরগোবিন্দের পতনের সাথে সাথে ইসলামে জয়গান সূচিত হয়। দলে দলে মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হন। শাহ জালাল (রহ.) সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিনকে আজান দেয়ার আদেশ করেন। তিনি আজান দেন-আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। সিলেটি গ্রাম্য ছড়ায় বলতে হয়- হিন্দু আছে লাখো লাখো, নাইরে মুসলমান। সিলেটের কাছে আসি কে দিল আজান?
ইবনে বাতুতার বর্ণনায় শাহ জালাল : বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বাতুতা বলেন, শাহ জালাল (রহ.) তার সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ অলি ছিলেন। তিনি সারা রাত আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। দিনে রোজা রাখতেন। তিনি ৪০ বছর ধরে রোজা রেখেছিলেন। ১০ দিন পরপর গাভির দুধে ইফতার করতেন। নানা অঞ্চলের হিন্দু, বৌদ্ধ, সূর্যপূজারি ও মুসলিম জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই উপঢৌকন সমেত উপস্থিত হত তার সাক্ষাতে। কিন্তু তিনি সেগুলো নিজের জন্য রাখতেন না বরং সেগুলো দ্বারা ফফির-মিসকিনদের খাবারের ব্যবস্থা করা হত (বাংলাদেশে সুফী-সাধক)।
শাহ জালালের কারামত : পরিব্রাজক ইবনে বাতুতা বলেন, তিনদিন আতিথ্য গ্রহণ করে প্রত্যাবর্তনকালে তপঃসিদ্ধ এই মহাপুরুষ তার পরিহিত জুব্বাটি খুলে আমাকে পরালেন। মাথার টুপি আমার মাথায় রাখলেন। এই জুব্বা ও টুপ এক অমূল্য সম্পদ। আমি তার অনুচরদের থেকে জানতে পারলাম। আমি সেখানে উপস্থিত হওয়ার দিন তিনি বলেছিলেন, মরক্কোর মুসাফির আমার জুব্বাটি নেবেন। কিন্তু এক বিধর্মী রাজা তার কাছ থেকে সেটা ছিনিয়ে নেবেন। সবশেষে সেই বিধর্মী রাজাই জুব্বাটি শীর্ঘজের ভাই বোরহানুদ্দীনকে প্রদান করবেন। ইবনে বাতুতা লেখেন, দু’বছর পর আমি চীনে গেলে সেখানকার রাজ-দরবারে আমাকে উপস্থিত করা হয়। কথা-বার্তার এক পর্যায়ে রাজা আমার জুব্বা দেখে বলেন, বাহ! পোশাকটি তো দারুণ! এরপর তিনি সেটা নিয়ে নেন। বিনিময়ে ১০টি পোশাক, একটি ঘোড়া, কিছু সরাঞ্জাম এবং কিছু নগদ অর্থ দেন। এর ১ বছর পরে চীনের রাজধানী গেলে দরবেশ বোরহানুদ্দীন শীর্ঘজের সাথে দেখা হয়। তার গায়ে সেই জুব্বা দেখে আমি বিস্মিত হয়ে পরখ করতে গেলে তিনি বলেন, এটাই সেই জুব্বা যা শাহ জালাল তোমাকে দিয়েছিল। ভাই শাহ জালাল প্রকৃতপক্ষে এক আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী (বাংলাদেশে সুফী-সাধক)।
শুদ্ধতার ঝান্ডাবাহী বীর সেনানী : শাহ জালাল (রহ.) ছিলেন সত্য ও হকের ঝান্ডাবাহী বীর সেনানী। ইসলামের শুদ্ধতার পতাকাকে উড্ডীনকারী। যিনি ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণে স্বীয় জীবন যৌবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। প্রচার করেছেন শুদ্ধ ও সঠিক ইসলাম। ইসলামের শুদ্ধ বিশ্বাসের সুবাসে সুবাসিত করেছেন সিলেটসহ গোটা দেশকে। যিনি কোনো বিদয়াতে পাবন্দ ছিলেন না। বিদয়াতের প্রচারও করেননি। এই মহামানষীর ইন্তেকালের বহুবছর পর, আজ তার কবরকে কেন্দ্র করে বিদয়াতের যে রমরমা আসর জমেছে, তার দায়িত্ব নিশ্চয়ই তার নয় এবং এর দায়ভারও তিনি নেবেন না। নবীজি বলেছেন, প্রত্যেক বিদয়াত ভ্রষ্টতা, আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতা জাহান্নামে যাবে (আবু দাউদ : ৪৬০৭)। এই মহা-সাধকের মাজার কেন্দ্রিক যারা বিদয়াতে লিপ্ত আছেন, তাদের সাবধান হওয়া উচিত।
ইবাদত শুধুই আল্লাহর জন্য : ইবাদতের যোগ্য একমাত্র আল্লাহতায়ালা। বান্দাকে কোনো কিছু দেয়ার একমাত্র ক্ষমতাবান আল্লাহতায়ালা। কোনো কিছু মান্নত করলে তার নামেই করতে হবে। শাহ জালাল (রহ.) সারা জীবন মানুষদের এটাই বুঝিয়েছেন। এ দাওয়াতই দিয়েছেন। তার ইন্তেকালের পরে আমরা তাকেই এক-প্রকার আল্লাহর স্থানে বসিয়েছি (নাউজুবিল্লাহ)। তার নামে মান্নত করি। তার কাছে প্রার্থনা করি। যা সম্পূর্ণ অনৈসলামিক কর্ম ও বিশ্বাস। এমন কাজ ও কর্মে ঈমান হারানোরও সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তাই, আমাদের এই সমস্ত বিদয়াত ও শিরক থেকে মুক্ত থাকা উচিত।
লেখক : মাদ্রাসা-শিক্ষক ও খতিব