ঢাকা ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মুসলিম স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন

নওগাঁর কুসুম্বা শাহী মসজিদ

মুফতি ইবরাহীম আল খলীল
নওগাঁর কুসুম্বা শাহী মসজিদ

পাঁচ টাকার নোটে মুদ্রিত ধূসর বর্ণের পাথরের তৈরি একটি মসজিদ দেখা যায়। এটি বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার কুসুম্বা গ্রামের একটি প্রাচীন মসজিদ। কুসুম্বা দীঘির পশ্চিম পাড়ে, পাথরের তৈরি ধূসর বর্ণের এই মসজিদটি অবস্থিত। মুসলিম স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন নওগাঁর ঐতিহাসিক এই কুসুম্বা শাহী মসজিদ। প্রায় ৪৬৫ বছরের এই পুরাকীর্তি পুরোটাই পাথরে মোড়ানো। দেয়াল, মিনার এবং গম্বুজে নকশা খোদাই করা। অপরূপ সৌন্দর্যের এই মসজিদটি মুসল্লিদের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত আকৃষ্ট করছে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের। পাঁচ টাকার কাগজের নোটে মুদ্রিত এ মসজিদটিকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যার মাধ্যমে মুসলিম স্থাপত্যের সাথে পরিচয় ঘটবে অসংখ্য মানুষের।

মসজিদের নির্মাণ : মসজিদের বাইরের একটি শিলালিপি অনুসারে মসজিদটির নির্মাণকাজ ৯১০ হিজরি মোতাবেক ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয় এবং ১৫৫৯ খ্রিষ্টাব্দে শেষ হয়। আফগানদের শূর বংশের শেষ দিকের শাসক গিয়াস উদ্দীন বাহাদুর শাহ এর শাসনামলে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এর মূল গাঁথুনি ইটের তৈরি হলেও সম্পূর্ণ দেয়াল কালো পাথরে মোড়ানো। মসজিদের প্রকৃত নির্মাণ সুলাইমান নামে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে ছিল। যদিও মসজিদটি সিউরি শাসনের অধীনে নির্মিত হয়েছিল, তবে স্থাপত্যের ধরনটি উত্তর ভারতের পূর্বের সিউরি স্থাপত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। পরিবর্তে, মসজিদটি অন্যান্য বাংলাদেশি মসজিদের শৈলীতে নির্মিত হয়েছিল। কুসুম্বা মসজিদটি বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের অন্যান্য মসজিদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে মান্দা উপজেলায় অবস্থিত এই কুসুম্বা শাহী মসজিদ।

মসজিদের আয়তন : ইতিহাসবিদদের মতে কুসুম্বা মসজিদ মুসলিম স্থাপত্যকলার এক অনুপম নিদর্শন। প্রাচীর বেষ্টিত মসজিদটির সম্মুখে গ্রামবাসী ও মুসল্লিদের পানির চাহিদা পূরণের জন্য ৭৭ বিঘা জমির উপর প্রায় ১২০০ ফুট লম্বা ৯০০ ফুট আয়তনের একটি বিশাল ঘাট বাঁধানো কুসুম্বা দীঘি আছে। যেটি এখন কুসুম্বা দিঘী নামেই পরিচিত। কথিত আছে এ দীঘির তলদেশে পারদ মিশ্রিত থাকায় পানিতে কচুরিপানা বা অন্য কোনো আগাছা জন্মে না। দীঘিতে নামার জন্য দুটি দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি রয়েছে। যেখানকার শাণ বাঁধানো ঘাটে অজু করেন মুসল্লিরা। দীঘির হৃদয় শীতল করা পানিতে দর্শনার্থীরা হাত-মুখ ধুয়ে ক্লান্তি দূর করেন। স্থানীয় বাসিন্দারা এই দীঘিতে নেমে গোসলও করেন। গ্রামবাসী ও মুসল্লিদের খাবার পানি, গোসল ও অজুর প্রয়োজন মেটানোর জন্য এ দিঘিটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এর পাড়েই তৈরি করা হয়েছে কুসুম্বা মসজিদ। কুসুম্বা মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৫৮ ফুট লম্বা, চওড়া ৪২ ফুট। মসজিদের সামনের দিকে রয়েছে তিনটি দরজা। চারদিকের দেয়ালের ওপর বাইরের অংশ পাথর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে।

মসজিদের ভেতরের দৃশ্য : মসজিদটি চার কোণাবিশিষ্ট। কালো ও ধূসর রঙের পাথর আর পোড়ামাটির ইটে গড়া এই মসজিদ। ব্যবহার করা হয়েছে মাটির টালি। মসজিদের গায়ে জ্যামিতিক নকশার আদলে পোড়ামাটির সুদৃশ্য কারুকাজ। মিহরাবে বিচিত্র ফুল, লতাপাতা, ঝুলন্ত শিকল ও মনোরম শিল্পকর্ম। ইটের তৈরি মসজিদের দেয়ালের বাইরে ও ভেতরের দিক পাথরে আবৃত। মসজিদের চার কোণায় চারটি আট কোণাকৃতির বুরুজ আছে। এর ভেতরে দুটি প্রশস্ত স্তম্ভ আছে। এ দুই স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের ওপর ছয়টি গম্বুজ আছে। মসজিদের গায়ে পাথরের খোদাইকৃত সূক্ষ্ম কারুকার্য রয়েছে। এর পূর্বপ্রান্তে তিনটি প্রবেশপথ আছে। মোট মিহরাব আছে ৩টি, যার সবগুলো কালো পাথরের তৈরি।

মসজিদের কেন্দ্রীয় মিহরাবটি মেঝের সমান্তরাল গায়ে খোদাইকৃত পাথরের সূক্ষ্ম নকশা রয়েছে।মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণের ‘বে‘তে অবস্থিত মিহরাবটি একটি উচু প্লাটফর্মের মধ্যে স্থাপিত। একটি সিঁড়ি দিয়ে এ প্লাটফর্মে উঠা যায়। ধারণা করা হয়, এই আসনে বসেই তৎকালীন কাজি এলাকার বিচার কার্য পরিচালনা করতেন।

মসজিদের বর্তমান অবস্থা : ১৮৯৭ সালে একটি ভূমিকম্পে কুসুম্বা মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ভূমিকম্পে মসজিদের চারপাশের বাইরের প্রাচীর এবং মসজিদের অনেক অংশ, বিশেষ করে মসজিদের ওপরের গম্বুজগুলো প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।

ভূমিকম্পে মারাত্মক ক্ষতি হলেও কুসুম্বা মসজিদের মূল কাঠামো বেঁচে যায়। ভূমিকম্পে মসজিদের তিনটি গম্বুজ নষ্ট হয়েছিল। পরে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু বহিরাগত গম্বুজ বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মেরামত করেছে। মসজিদটি এখন সরকারিভাবে বিভাগ দ্বারা সুরক্ষিত। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে মসজিদের চতুর্দিকে এবং পূর্বপার্শ্বে অবস্থিত দীঘির পাড়ে ফুলের বাগান নির্মাণ, আলোকসজ্জার কাজ করা হয়।

দেশের প্রাচীন এই নিদর্শনগুলো উপযুক্ত সংষ্কারের অভাবে ভুগছে। উপযুক্ত সংষ্কার সম্ভব হলে এগুলো হতে পারত দেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার চেয়ে বড় কথা ইসলামের প্রাচীনতার শেকড় স্পষ্ট হত আধুনিক বিশ্বের বাহ্যিক চোখে। কেননা, এগুলো হলো মহান আল্লাহতায়ালার নির্শন ও মুসলিম স্থাপত্যশিল্প। যার মাধ্যমে অমুসলিমরা ইসলামের ?দিকে আকৃষ্ট হবে আর মুসলিমদের ঈমানে আরো দৃঢ়তা আসবে।

কীভাবে কুসুম্বা মসজিদে যাওয়া যায় : কুসুম্বা গ্রাম নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের পাশে উপজেলা সদর থেকে তিন মাইল দক্ষিণ-পূর্বে। নওগাঁ শহর থেকে বাস বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় এই মসজিদে যাওয়া যায়।

আর রাজধানী ঢাকা থেকে যেতে চাইলে, ঢাকা থেকে প্রথমে রাজশাহী যেতে হবে।

রাজশাহীর ওপর দিয়ে ছাড়া এখানে যাওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ঢাকা-রাজশাহীর বাস যোগে যেতে হবে। এরপর রাজশাহী মহানগরের গোরহাঙ্গা রেলগেট বাসস্টপেজ থেকে নওগাঁর বাসে উঠে মান্দার ফেরিঘাটের আগে কুসুম্বা মোড়ে নামতে হবে। এখানে নেমে হেঁটে ১ মিনিটের পথ কুসুম্বা মসজিদ।

লেখক : শিক্ষক, মাদ্রাসা, আশরাফুল মাদারিস, তেজগাঁও ঢাকা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত