ইসলামে গণপিটুনির বিধান

উবাইদুল্লাহ তারানগরী

প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

তোফাজ্জল। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের চরদুয়ানী গ্রামের আবদুর রহমানের ছেলে। বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে। বাবা মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়। কিছু দিন পর মা মারা যান ক্যান্সারে। তারও কিছুদিন পর একমাত্র ভাই পুলিশের এসআই সেও ক্যান্সারে মারা যান। বড় একা হয়ে যায় তোফাজ্জল। চাকরি-বাকরি না পেয়ে ও পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে বিষণ্ণতা থেকে একসময় মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যায়। হাতপেতে এ-ওর কাছ থেকে খায়। পৃথিবীতে খোলা আকাশের নিচে আল্লাহ ছাড়া তার কেউ নেই। তীব্র পিপাসা ও প্রচণ্ড ক্ষুধার জ্বালায় সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে কীভাবে যেন তোফাজ্জল আসে। এই আসাটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে সে কি কখনো ভেবেছিল? কখনো ভেবেছিল এই খাবারই হবে তার জীবনের শেষ খাবার? কথিত মোবাইল চুরির অভিযোগে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে প্রকাশ্যে মেধাবী নামের সোনার ছেলেরা এভাবে নির্মমভাবে নির্যাতন করে মেরে ফেলা তাও আবার জালিমমুক্ত স্বাধীন দেশে! যা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়। এটা তো ছিল লীগ ও হেলমেট বাহিনীর কুসংস্কৃতি। সভ্য সমাজে এমন অসুস্থ মানসিকতার প্রতিযোগিতা কখনই কাম্য নয়। ভিডিওতে দেখা যায় হত্যাকারীরা নির্যাতনের পর তোফাজ্জলকে খাবার খেতে দেয়। অতঃপর বলে খাবার কেমন হয়ছে? তোফাজ্জল বলে, ভালো। সঙ্গে সঙ্গেই টেনে হেঁচড়ে নিয়ে অকথ্য নির্যাতনে নিষ্ঠুর গণপিটুনিতে তাকে রক্তাক্ত করে। একপর্যায়ে তোফাজ্জল মারা যায়। ঘটনাটি সারা দেশে শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি করে। সবার হৃদয়েই রক্তক্ষরণ হয়। কিছু দিন পরপরই দেশবাসী এমন ঘটনায় মর্মাহত হয়। এর শেষ কোথায়? এর আগে ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনিতেও অনেক নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছিল। মানুষের মধ্যে দিন দিন ন্যায় অন্যায়বোধ, অপরাধবোধ, ক্ষমা সহিষ্ণুতা লোপ পাচ্ছে। ক্ষমতা ও শক্তির অপব্যবহার করে হিংস্রতার চাষবাসে প্রতিযোগিতা করছে। অপরাধ ছিল,আছে থাকবে, শরিয়তে কিংবা সংবিধানে সেই অপরাধের শাস্তিও রয়েছে। তবে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে গণপিটুনি ও বিচারবহির্ভূত হত্যা মহাঅপরাধ। গণপিটুনিতে যে যেভাবেই অংশগ্রহণ করুক সবাই সমান অপরাধী। তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের মর্মন্তুদ শাস্তি।

আল্লাহতায়ালা বলেন; ‘যারা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মোমিনকে হত্যা করবে, তার প্রতিদান হচ্ছে জাহান্নাম, সেখানে সে চিরস্থায়ী হবে। আর আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত হবেন, তাকে লানত (অভিশাপ) করবেন। আর তার জন্য কঠিন আজাব প্রস্তুত করে রাখবেন।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৯৩)। হজরত আবু সাইদ খুদরি ও হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আসমান-জমিনের মধ্যে বসবাসকারী সবাই মিলিত হয়ে যদি একজন মোমিনকে মেরে ফেলার কাজে শরিক হয়, তাহলে আল্লাহতায়ালা তাদের সবাইকে উপুর করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (তিরমিজি)।

হজরত ওমর (রা.)-এর আমল : হজরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যেব (রহ.)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, হজরত ওমর (রা.) আনহু ৭ জন ব্যক্তিকে হত্যা করেছেন। তাদের ওপর কেসাস প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই ৭ ব্যক্তি একজন নিরাপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল। সে সময় মানুষ হজরত ওমর (রা.)-এর ব্যাপারে অভিযোগ করেছিল যে, এ ৭ জনের কেউ হয়ত হাত কেটেছে, কেউ পা কেটেছে কিংবা কেউ সামান্য যখম করেছে। তাহলে কেন তাদের ৭ জনকে হত্যা করা হবে? (এ ৭ জনের বাড়ি ছিল ইয়েমেনের সানাআ) ওমর (রা.) মানুষের এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে বলেছিলেন, ‘যদি (ইয়েমেনের রাজধানী) ‘সানাআ’র সব মানুষ মিলে হত্যা করত তবে আমি সানাআ’র সব মানুষের ওপর কেসাসের হুকুম বাস্তবায়ন করতাম। অর্থাৎ সানাআ’র সব অধিবাসীকে হত্যা করতাম।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, মুয়াত্তা মালেক)।

তাই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া সরকারের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে গতানুগতিক শুধু আইন, মামলা, গ্রেফতার ও শাস্তিই যথেষ্ট নয়। সরকারকে বিচারবহির্ভূত হত্যা রোধে জনগণের মধ্যে পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সঠিক চেতনাবোধ তৈরি করতে হবে। তাহলেই নানা দুর্ঘটনা ও গণপিটুনির মতো জঘন্য অপরাধ থেকে জাতি মুক্তি পাবে বলে আশা করা যায়।

লেখক : শিক্ষক