ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কথা বলার আদব

মুফতি ইবরাহীম আল খলীল
কথা বলার আদব

কথা। দুই অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ। তবে কথার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক দীর্ঘ। প্রতিটা মুহূর্ত যেন তাকে ছাড়া চলেই না। মনের ভাব আমরা কথার মাধ্যমে প্রকাশ করি। এর জন্য তা একটি শক্তিশালী মাধ্যম। কথা বলতে পারা মহান আল্লাহতায়ালার অনে বড় একটি নেয়ামত। কেননা, জীবনে চলার পথে বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষের সাথে কথাবার্তা বলতে হয়। শুনতে হয় অন্যের কথা। মানুষের পক্ষে সমাজে মুখ বা কান বন্ধ করে বসবাস করা সম্ভব নয়। নিজের প্রয়োজন যেমন তাকে অন্যের কাছে ব্যক্ত করতে হয়, তেমনি অন্যের প্রয়োজনে তাকে এগিয়ে আসতে হয়। এক্ষেত্রে কথা বলার কোনো বিকল্প নেই।

কথা বলার অনেক আদব-কায়দা রয়েছে। মনে কোন কথা উদিত হলেই তা না বলা, বরং চিন্তা ভাবনা করে বলা উচিত। শুধু সঠিক কথাটাই বলা। বিন প্রয়োজনে যেমন কথা বলা উচিত নয়, তেমনি প্রয়োজনের সময় কথা না বলে নিশ্চুপ থাকাও উচিত নয়। ইসলামের নির্দেশ মেনে কথাবার্তা বলতে হবে। আমরা জানি, আমাদের প্রতিটি কথা নোট করার জন্য তৎপর প্রহরী আপনার কাছেই উপস্থিত রয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, যে কথাই মানুষ উচ্চারণ করে (তা সংরক্ষণের জন্য) তার কাছে একজন সদা তৎপর প্রহরী আছে। (সুরা কাফ : ১৮)।

একজন মোমেন তার জীবনে অন্যান্য বিষয়ের মতো কথা-বার্তার ক্ষেত্রেও কিছু আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার মেনে চলতে হয়। তাই আলোচ্য নিবন্ধে কথাবার্তা বলার কিছু আদব বা শিষ্টাচার উল্লেখ করা হলো-

১. সত্য কথা বলায় পিছপা না হওয়া : সদা সত্য কথা বলা এবং সত্যবাদিতায় অবিচল থাকা একজন মোমেনের কর্তব্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও। (সুরা তওবা : ১১৯)।

২. উত্তম কথা বলা : ভালো এবং উত্তম কথা বলাও একটি দাওয়াত। ভালো কথার দ্বারা শক্রও বন্ধুতে পরিণত হয়। এ ব্যাপারে আল কোরআনে নির্দেশনা এসেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। উৎকৃষ্ট (ভালো কথার) দ্বারা মন্দ প্রতিহত কর; তাহলে যাদের সঙ্গে তোমার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। (সুরা হামীম আস-সাজদাহ : ৩৪)।

৩. সুন্দর ও উত্তমরূপে কথা বলা : আল্লাহতায়ালা বলেন, আর তোমরা লোকের সাথে উত্তমভাবে কথা বলবে। (সুরা বাকারা : ৮৩)।

৪. কর্কশ স্বরে কথা না বলা: আল্লাহতায়ালা বলেন, আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর। তোমার আওয়াজ নিচু কর; নিশ্চয় সবচেয়ে নিকৃষ্ট আওয়াজ হলো গাধার আওয়াজ। (সুরা লোকমান : ১৯)।

৫. ব্যঙ্গবিদ্রূপ পরিহার করা : কাউকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে কথা বলা কোন মোমেনের ভাষা হতে পারে না। এ ব্যাপারে এরশাদ হয়েছে, হে বিশ্বাসীগণ! কোন পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে, কেননা যাকে উপহাস করা হয়, সে উপহাসকারীর চেয়ে ভালো হতে পারে। আর কোন নারীও অপর নারীকে যেন উপহাস না করে। কেননা, যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণীর চেয়ে ভালো হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না। আর তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাকে মন্দ নামে ডাকা খারাপ কাজ। যারা এ ধরনের আচরণ থেকে বিরত হয় না, তারা তো সীমালঙ্ঘনকারী। (সুরা হুজুরাত : ১১)।

৬. শালীন কথা বলা : রাসুল (সা.) বলেন, বিশ্বাসী ব্যক্তি কারও প্রতি ভর্ৎসনা ও অভিসম্পাত করে না এবং অশ্লীল ও অশালীন কথা বলে না। (জামে তিরমিজি: ১৯৭৭)।

৭. মুর্খ ও অজ্ঞদের সাথে অযথা তর্ক এড়িয়ে চলা : আল্লাহতায়ালা বলেন- ‘আর রাহমান-এর বান্দা তারাই, যারা জমিনে অত্যন্ত বিনম্রভাবে চলাফেরা করে এবং যখন জাহেল ব্যক্তিরা তাদের (অশালীন ভাষায়) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, সালাম।’ (সুরা ফুরকান : ৬৩)।

৮. কথার সাথে কাজের মিল থাকা : আল্লাহতায়ালা বলেন, হে মোমেনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল, যা তোমরা করো না। (সুরা সফ : ২)।

৯. শোনা কথা যাচাই না করে বলা অনুচিত : কারো কাছ থেকে শোনা কথার সত্যাসত্য যাচাই না করে বলা উচিত নয়। কেননা, এতে পাপী ও মিথ্যাবাদী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। নবী করীম (সা.) বলেন, কোনো ব্যক্তির পাপী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে কোনো কথা শোনামাত্রই (যাচাই না করে) বলে বেড়ায়। (সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৯২)।

১০. গিবত ও চোগলখুরী পরিহার করা : কথাবার্তায় গিবত ও চোগলখুরী বর্জন করা জরুরি। আল্লাহ বলেন, আর তোমরা ছিদ্রান্বেষণ করো না এবং একে অপরের পেছনে গিবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পসন্দ করে? ব্স্তুত তোমরা সেটি অপছন্দ করে থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বাধিক তওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু। (সুরা হুজুরাত : ১২)।

১১. গোনাহ ও হারাম কথা থেকে জিহবাকে সংযত রাখা : কথাবার্তায় জিহবাকে সংযত ও নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। কেননা, কোনো গুনাহের কথা বা হারাম কথা বললে তার জন্য পরকালে শাস্তি পেতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, কোনো বান্দার ঈমান ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক হবে না, যতক্ষণ না তার অন্তর সঠিক হবে। আর অন্তর ঠিক হবে না, যতক্ষণ না তার জিহবা ঠিক হবে। (মুসনাদে আহমাদ : ১৩০৪৮)।

১২. মানুষের বোধগম্য ভাষায় কথা বলা : কথা বলার ক্ষেত্রে মানুষের বোধগম্য ভাষায় কথা বলা উচিত। দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলা সমীচীন নয়। কারণ এতে মানুষ কথা বুঝতে না পেরে কষ্ট পায়। হযরত আলী (রা.) বলেন, মানুষের নিকট সেই ধরনের কথা বল, যা তারা বুঝতে পারে। তোমরা কি পসন্দ কর যে, আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি মিথ্যা আরোপ করা হোক। (বোখারি : ১২৭)।

১৩. তিনজন থাকলে দুজনে কানে কানে কথা না বলা : কোথাও তিনজন লোক থাকলে একজনকে বাদ দিয়ে দুজনে কানে কানে কথা বলা যাবে না। কারণ এতে তৃতীয় ব্যক্তি মনে কষ্ট পায়। রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা তিনজন একত্র হলে একজনকে বাদ দিয়ে যেন দুজনে কানে কানে কথা না বলে। কেননা, তাতে সে চিন্তিত হতে পারে। (বোখারি : হাদিস ৬২৯০)।

লেখক : শিক্ষক, মাদ্রাসা আশরাফুল মাদারিস, তেজগাঁও, ঢাকা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত