‘বায়তুল হিকমাহ’ ছিলো আব্বাসীয় শাসনামলে ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক। ইসলামের স্বর্ণযুগে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মুক্তচর্চা কেন্দ্র হিসেবে গণ্য করা হতো বায়তুল হিকমাকে। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে আব্বাসীয়রা উমাইয়াদের হটিয়ে মুসলিম বিশ্বে শাসন শুরু করে। ৭৬২-তে আব্বাসীয় প্রথম খলিফা আল-মনসুর তার রাজধানী হিসেবে বাগদাদ নগরী গড়ে তোলেন। তিনি এ অঞ্চলে ইসলামি শক্তি সাসানিদদের প্রতিস্থাপন করে। সাসানিদ অভিজাতেরা বই জমা রাখার জন্য ঘর বানাতো, যার নাম ‘মধহর’, আরবিতে এর প্রতিশব্দ ‘খিজানাহ’। আল-মনসুর বাগদাদে তেমন কিছু করতে চাইলেন। তার ইচ্ছে বাগদাদে এমন একটি সংগ্রহ গড়ে তোলা যার নাম হবে “খিজানাত আল-হিকমাহ”। কিন্তু ৭৭৫ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। পরবর্তীতে তার স্বপ্ন সত্যি করেন খলিফা হারুন আল-রশিদ। প্রাথমিক পর্যায়ে খলিফার পূর্বপুরুষদের সংগ্রহে থাকা শিল্পসাহিত্য আর বিজ্ঞানবিষয়ক বইয়ের ঠাঁই হয় লাইব্রেরিতে। পারস্যের উপকথা, সাসানিয়ান জ্যোতির্বিদদের লেখনি ইত্যাদি আরবিতে অনুবাদ করা হয়। এ-পর্যায়ে প্রাচীন পারস্যভাষার গ্রন্থই কেবল আরবিতে অনুবাদ হয়েছিল।
বায়তুল হিকমাহর উৎকর্ষ : হারুন আল-রশিদের পুত্র পরবর্তী খলিফা আল-মামুনের সময় এই পাঠাগার চূড়ান্ত উৎকর্ষ অর্জন করে। খলিফা মামুনের সময়ই সারা বিশ্বে বায়তুল হিকমার খ্যাতি অগ্নিদীপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সারা বিশ্বের বিদ্বান ব্যক্তিদের তীর্থক্ষেত্র হিসেবে এটি পরিচিতি লাভ করে। নারী-পুরুষনির্বিশেষে বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন জাতির পণ্ডিতদের সম্মেলন ঘটেছিল এই প্রতিষ্ঠানে। তিনি মূল ভবনকে পরিবর্ধিত করে একটি অ্যাকাডেমি স্থাপন করেন, এর নামই হয় ‘বায়তুল হিকমাহ’। ৮২৯ সালে আল-মামুন এখানে একটি ‘মানমন্দির’ ও বানিয়ে দেন।
এ সংগ্রহশালা বাড়াতেও তিনি নানা পদক্ষেপ নেন। কিংবদন্তী আছে- সিসিলির রাজকীয় লাইব্রেরির পুরোটাই নিয়ে এসেছিলেন তিনি। তৎকালীন বিশ্বে বিজ্ঞান আর গণিতের উঁচুমানের কিছু পাণ্ডুলিপি ছিল সেখানে। যার সমস্ত বই নিয়ে আসতে ৪০০ উট লেগেছিল।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান : জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় তৎকালীন সময়ে এ লাইব্রেরির অবদান অনস্বীকার্য। কথিত আছে, প্রথম দিকে দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা হলেও কালক্রমে বিজ্ঞান, চিকিৎসা, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, ভূগোল, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্য ও জ্যোতির্বিদ্যার মতো বিষয় নিয়ে গবেষণা করা হতো। এখানে গবেষণায় নিয়োজিতদের মধ্যে অন্যতম মুসা আল-খাওয়ারিজমি। তিনি একাধারে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে পারদর্শী এবং তাকে বীজগণিতের জনক বলে অভিহিত করা হয়। ৮২০ সালে তাকে লাইব্রেরির প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের নানা শাখায় যাদের পদচারণা ছিলো তন্মাধ্যে মুহাম্মদ, আহমাদ এবং হাসান উল্লেখযোগ্য। যন্ত্র-প্রকৌশলের (মেকানিক্স) বিকাশে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। লিঙ্গ, ধর্মবিশ্বাস, গায়ের রঙ, জাতপাত, ভাষা যা-ই হোক, কারো জন্যই বন্ধ ছিল না লাইব্রেরির দরজা। হুনায়ন ইবন ইশহাকের কথাই ধরা যাক। পেশায় চিকিৎসক হুনায়ন ছিলেন খ্রিষ্টান, কিন্তু সেজন্য লাইব্রেরির দরজা বন্ধ হয়ে যায়নি তার সামনে, বরং মেধাকে আরো বিকশিত করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।
অনুবাদের ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা : ‘বায়তুল হিকমাহ’র অন্যতম একটি কাজ ছিল বিজ্ঞানের বই গ্রীক, সংস্কৃত, ল্যাটিন ইত্যাদি ভাষা থেকে আরবিতে অনুবাদ করা। খলিফা ঘোষণা করেন, ‘অনূদিত বইয়ের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণ দেয়া হবে অনুবাদককে।’
তৎকালীন প্রসিদ্ধ অনুবাদকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আল-বাতরিক, হাজ্জাজ ইবন-মাতের, আল-বুলবাকি, ছাবিত ইবন-কুরাহ এবং আরো অনেকে। হুনায়ন বিন-ইশহাক যিনি পেশায় চিকিৎসক ছিলেন তার ধর্ম ছিলো খ্রিষ্টান, কিন্তু সেজন্য তার সামনে লাইব্রেরির দরজা বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং মেধাকে আরো বিকশিত করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। পৃথিবীর ইতিহাস, যুক্তিবিদ্যা এসব নিয়েও কাজ আছে তার। গ্রীক ওল্ড টেস্টামেন্ট আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন তিনি, দুঃখজনকভাবে সেটা হারিয়ে যায়।
বায়তুল হিকমাহ ধ্বংস : আল-মামুনের মৃত্যুর পর থেকেই মূলত ধীরে ধীরে ‘বায়তুল হিকমাহ’র অবক্ষয় শুরু হয়। পরবর্তী খলিফা আল-মুতাসিমের সময় আব্বাসীয়রা দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে ‘সামারা’য় প্রশাসনিক অনেক কিছু সরিয়ে নেয়। ১২৫৮ সালে হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমণের সময় দীর্ঘ ১২ দিন অবরোধের পর খলিফা মুতাসিম বাধ্য হয়ে মোঙ্গলদের কাছে নতি স্বীকার করেন। অতঃপর মোঙ্গলরা বাগদাদে প্রবেশ করে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়। পুরো শহর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত হয়। মোঙ্গলদের হাতে আব্বাসীয় আমলের দীর্ঘ ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে জ্ঞানবিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা ‘বায়তুল হিকমাহ’ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
কথিত রয়েছে, ‘হত্যাকাণ্ড চলার সময় যদিও পারস্য মনীষী নাসিরুদ্দিন তুসি ৪০ হাজার গ্রন্থ অনত্র সরিয়ে নেন, তবু এত বিপুল পরিমাণ বই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় যে বইয়ের কালিতে আব্বাসীয় প্রাসাদসংলগ্ন টাইগ্রিস নদীর পানি কালো হয়ে যায়!’
বায়তুল হিকমার গবেষণাকর্মকে কেন্দ্র করেই মুসলিম সভ্যতার জ্ঞানচর্চার অনুশীলন এবং পরে ইউরোপীয় রেনেসার সূচনা ঘটে। শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়; বরং পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে ‘বায়তুল হিকমাহ’ই ছিল প্রথম ও সর্ববৃহৎ জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র, যা ছিলো মুসলিম সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন।
লেখিকা : শিক্ষার্থী, ৪র্থ বর্ষ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়