মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

মুহাম্মাদ আবু আখতার

প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলাম মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। কোরআন-হাদিসে মানুষের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে অনেক দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে তার ইবাদতের নির্দেশ দানের পর বিভিন্ন মানুষের সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তার সাথে কোন কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার করো মাতা-পিতার সাথে, নিকট আত্মীয়ের সাথে, এতিম, মিসকীন, নিকট আত্মীয়- প্রতিবেশী, অনাত্মীয়- প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী-সঙ্গী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদের যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।’ (সুরা নিসা : ৩৬)।

মানুষের মধ্যে পিতা-মাতার অধিকার সবচেয়ে বেশি। তাই আল্লাহতায়ালা তার ইবাদতের নির্দেশের পরপরই পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। পিতা-মাতার ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না’ এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদের ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। আর তাদের উভয়ের জন্য দয়াপরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, ‘হে আমার রব, তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন’। (সুরা আল-ইসরা : ২৩-২৪)।

আমাদের জীবনে মাতাপিতার অবদান অপরিসীম। তারা আমাদের ছোটকাল হতে অত্যন্ত কষ্ট করে লালন-পালন করেছেন। তাই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের কর্তব্য। আল্লাহতায়ালার অসংখ্য নেয়ামতের জন্য শুকরিয়া আদায়ের পাশাপাশি পিতা-মাতা কষ্ট করে আমাদের লালন-পালনের জন্য তাদের প্রতি শুকরিয়া আদায়ের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আমি মানুষকে তার মাতাপিতার ব্যাপারে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় করো। প্রত্যাবর্তন তো আমার কাছেই।’ (সুরা লুকমান : ৩৮)।

পিতা-মাতার পর আত্মীয়-স্বজনের অধিকার রক্ষার প্রতি ইসলামে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা আত্মীয়-স্বজনদের তাদের হক বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘অতএব, আত্মীয়-স্বজনকে তাদের হক দিয়ে দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও। এটি উত্তম তাদের জন্য, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি চায় এবং তারাই সফলকাম।’ (সুরা আর-রোম :৩৮)। ইসলামে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার গুরুত্ব অপরিসীম। যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে হাদিসে তাদের ব্যাপারে কঠিন সতর্কবাণী উল্লেখ করা হয়েছে। হজরত যুবায়র ইবনু মুত’ইম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’

(বোখারি : ৫৯৮৪)। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা এমন জঘণ্য অপরাধ যার শাস্তি আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতেও দিবেন আখেরাতেও দেবেন। এ ব্যাপারে হজরত আবু বাকরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, (ন্যায়পরায়ণ শাসকের বিরুদ্ধে) বিদ্রোহ ও রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার মতো মারাত্মক আর কোনো পাপ নেই, আল্লাহতায়ালা যার শাস্তি অতি দ্রুত পৃথিবীতেও প্রদান করেন এবং আখেরাতের জন্যও অবশিষ্ট রাখেন। (তিরমিজি : ২৫১১, আবু দাউদ : ৪৯০২)।

এতিমণ্ডমিসকীনদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারেও ইসলামে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কোরআন-হাদিসের অসংখ্য জায়গায় এতিমণ্ডমিসকীনদের অধিকার আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা আত্মীয়-স্বজনদের হক আদায়ের পাশাপাশি মিসকিনদের হক আদায়ের নির্দেশ প্রদান করে বলেন, ‘আর আত্মীয়কে তার হক দিয়ে দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও। আর কোনোভাবেই অপব্যয় করো না।’ (সুরা আল-ইসরা : ২৬)।

জাহান্নামীদের যখন তাদের অপরাধের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে, তখন তারা তাদের অপরাধগুলো বর্ণনা করবে। মিসকিনদের খাদ্য না দেয়া জাহান্নামীদের অন্যতম অপরাধ বলে তারা স্বীকার করবে। এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কিসে তোমাদের জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করাল? তারা বলবে, ‘আমরা সালাত আদায়কারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। আর আমরা মিসকিনদের খাদ্য দান করতাম না’। (সুরা আল-মুদ্দাসসির : ৪২-৪৪)।

আল্লাহতায়ালা এতিমদের তাদের প্রাপ্য ধন-সম্পদ দিয়ে দেয়ার ব্যাপারে বলেন, ‘আর তোমরা এতিমদের তাদের ধন-সম্পদ দিয়ে দাও এবং তোমরা অপবিত্র বস্তুকে পবিত্র বস্তু দ্বারা পরিবর্তন করো না এবং তাদের ধন-সম্পদকে তোমাদের ধন-সম্পদের সাথে খেয়ো না। নিশ্চয় তা বড় পাপ।’ (সুরা আন-নিসা : ২)।

প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এতিমদের ধনসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করার ব্যাপারে দিকনির্দেশনা প্রদান করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা ইয়াতীমদের পরীক্ষা করো, যতক্ষণ না তারা বিবাহের বয়সে পৌঁছে। সুতরাং যদি তোমরা তাদের মধ্যে বিবেকের পরিপক্বতা দেখতে পাও, তবে তাদের ধন-সম্পদ তাদের দিয়ে দাও। আর তোমরা তাদের সম্পদ খেয়ো না অপচয় করে এবং তারা বড় হওয়ার আগে তাড়াহুড়া করে। আর যে ধনী সে যেন সংযত থাকে, আর যে দরিদ্র সে যেন ন্যায়সঙ্গতভাবে খায়। অতঃপর যখন তোমরা তাদের ধন-সম্পদ তাদের কাছে সোপর্দ করবে, তখন তাদের উপর তোমরা সাক্ষী রাখবে। আর হিসাব গ্রহণকারী হিসেবে আল্লাহ যথেষ্ট।’ (সুরা আন-নিসা : ৬)।

এতিমদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা সতর্ক করে বলেছেন, ‘নিশ্চয় যারা এতিমদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে তারা তো তাদের পেটে আগুন খাচ্ছে; আর অচিরেই তারা প্রজ্জ্বলিত আগুনে প্রবেশ করবে।’ (সুরা আন-নিসা : ১০)।

ইসলামে প্রতিবেশীদের হক আদায়ের ব্যাপারেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়া ঈমানের দাবি। এ ব্যাপারে হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ্? (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ও আখেরাতের উপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।’ (মুসলিম : ৭৮)। প্রতিবেশীকে কষ্টদানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এ সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ্? (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ না থাকে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম : ৭৬)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) দাস-দাসীদের অধিকারের ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। হজরত ইয়াযিদ ইবনু জারিয়াহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হাজ্জের দিন বলেছেন, তোমাদের দাস-দাসীদের ব্যাপারে সাবধান থেকো। তোমরা তোমাদের দাস-দাসীদের ব্যাপারে সাবধান থেকো, তোমরা তোমাদের দাস-দাসীদের ব্যাপারে সাবধান থেকো। (অর্থাৎ, তাদের অধিকার আদায় করো, তাদের প্রতি অত্যাচার কর না এবং আল্লাহকে ভয় কর) তোমরা যা খাও তাদেরও তা খাওয়াও, তোমরা যা পর তাদেরও তা পরাও। যদি তারা কোন অপরাধ করে যা তোমরা ক্ষমা করতে ইচ্ছা কর না। তবে আল্লাহর বান্দাদের বিক্রয় করবে। তাদের কষ্ট দিবে না। (আস-সহীহাহ : ৭৪০)।

হজরত মা’রূর (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একবার রাবাযা নামক স্থানে আবু যর (রা.)-এর সঙ্গে দেখা করলাম।

তখন তার পরনে ছিল এক জোড়া কাপড় (লুঙ্গি ও চাদর) আর তার ভৃত্যের পরনেও ছিল ঠিক একই ধরনের এক জোড়া কাপড়। আমি তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, একবার আমি জনৈক ব্যক্তিকে গালি দিয়েছিলাম এবং আমি তাকে তার মা সম্পর্কে লজ্জা দিয়েছিলাম। তখন আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন, আবূ যার! তুমি তাকে তার মা সম্পর্কে লজ্জা দিয়েছ? তুমি তো এমন ব্যক্তি, তোমার মধ্যে এখনো অন্ধকার যুগের স্বভাব বিদ্যমান। জেনে রেখো, তোমাদের দাস-দাসী তোমাদেরই ভাই। আল্লাহতায়ালা তাদের তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। তাই যার ভাই তার অধীনে থাকবে, সে যেন নিজে যা খায়, তাকে তা-ই খাওয়ায় এবং নিজে যা পরিধান করে, তাকেও তা-ই পরায়। তাদের উপর এমন কাজ চাপিয়ে দিও না, যা তাদের জন্য অধিক কষ্টদায়ক। যদি এমন কষ্টকর কাজ করতে দাও, তাহলে তোমরাও তাদের সে কাজে সহযোগিতা করবে। (সহিহ বুখারি : ৩০)। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.)-এর অন্তিম কথা ছিল : নামাজ! নামাজ! তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় করো। (আদাবুল মুফরাদ : ১৫৭)।

লেখক : প্রভাষক (আরবি), রাজার ভিটা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, চিলমারী, কুড়িগ্রাম।