কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতার গুরুত্ব

মাহবুবুর রহমান

প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলামে কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। একজন মুসলিম কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতার উচ্চ মান বজায় রাখতে ও সৎভাবে কাজ করতে বাধ্য। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি কাজেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা থাকা উচিত। কোরআন ও হাদিসে কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতার বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হয়েছে, যা একটি সফল ও উন্নত সমাজ গঠনে সহায়ক।

১. সত্যবাদিতা ও সততা : ইসলামে সত্যবাদিতা ও সততার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে সৎ হওয়া, মিথ্যা না বলা এবং প্রতারণা না করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।’ (সুরা আত-তাওবা : ১১৯)। এছাড়াও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘সত্যবাদিতা নেক কাজের দিকে নিয়ে যায়, আর নেক কাজ জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়।’ (বোখারি)। সুতরাং কর্মক্ষেত্রে সততা ও সত্যবাদিতা একজন মুসলিমের আদর্শ হওয়া উচিত।

২. অঙ্গীকার পূরণ : কর্মক্ষেত্রে দেয়া অঙ্গীকার ও দায়িত্ব পূরণ করা ইসলামি নৈতিকতার অপরিহার্য অংশ। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘এবং অঙ্গীকার পূরণ করো; নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সুরা আল-ইসরা : ৩৪)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘যার মধ্যে আমানতদারি নেই, তার মধ্যে ঈমান নেই।’ (মুসলিম)।

৩. ন্যায়বিচার ও ইনসাফ : ইসলামে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার মেনে কাজ করা আল্লাহর নির্দেশ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়বিচার এবং সদাচারণের আদেশ দেন...’ (সুরা আন-নাহল :৯০)। এছাড়াও, কর্মক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব ও অবিচার করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

৪. কঠোর পরিশ্রম ও আন্তরিকতা : ইসলামে কাজকে ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়, যদি তা সৎ উদ্দেশ্যে ও আন্তরিকতার সাথে করা হয়। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন: ‘আর মানুষ তার চেষ্টা-প্রচেষ্টার উপরেই নির্ভরশীল...’ (সুরা আন-নাজম : ৩৯)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বলেছেন : ‘আল্লাহতায়ালা এমন কর্মীকে ভালোবাসেন, যে কাজ করে তা যথাযথভাবে সম্পন্ন করে।’ (মুসলিম)।

৫. ধৈর্য ও সংযম : কর্মক্ষেত্রে ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শন করাও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি নৈতিক নির্দেশনা। ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ধৈর্যধারণ করো এবং ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সুরা বাকারা : ১৫৩)। ধৈর্য ও সংযম কর্মক্ষেত্রে উত্তেজনা ও ভুলের আশঙ্কা কমায় এবং সবার মাঝে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করে।

৬. অন্যায় থেকে বিরত থাকা : কোনো প্রকার অসততা, অন্যায় বা অনৈতিক কাজে লিপ্ত হওয়া ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (মুসলিম)। এটি কর্মক্ষেত্রে প্রতারণার চরম বিরোধিতা করে এবং একজন মুসলিমকে সততা বজায় রাখতে উৎসাহিত করে।

৭. সহানুভূতি ও সহযোগিতা : কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং একে অপরকে সাহায্য করা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশনা। মুসলিমদের আল্লাহ একে অপরের ভাই হিসেবে বিবেচনা করতে বলেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা পরস্পরে সাহায্য করো ন্যায় ও তাকওয়ার কাজে।’ (সুরা মায়েদা : ২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন: ‘মুসলিম মুসলিমের ভাই, সে তার প্রতি অত্যাচার করবে না এবং তাকে বিপদে ফেলে দিবে না।’ (বোখারি) কর্মক্ষেত্রে এই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করলে পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ আরও উন্নত ও সৌহার্দ্যময় হয়।

৮. সময়ানুবর্তিতা : ইসলামে সময়ের প্রতি যত্নবান হওয়ার উপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সময়ানুবর্তিতা কর্মক্ষেত্রে একজন কর্মীর পেশাগত জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ বলেন : ‘আমি দিন ও রাতকে করেছি আলামতস্বরূপ; অতঃপর আমরা রাত্রির আলামতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছি এবং দিনের আলামতকে করেছি আলোকিত...’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) সময়ের যথাযথ ব্যবহারকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন এবং বলতেন : ‘কেয়ামতের দিন মানুষকে পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে : তার জীবন কীভাবে কাটিয়েছে, তার যৌবন কীভাবে ব্যয় করেছে, তার সম্পদ কোথা থেকে উপার্জন করেছে ও কীভাবে ব্যয় করেছে এবং তার জ্ঞান দিয়ে কী কাজ করেছে।’ (তিরমিজি)। এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, কর্মক্ষেত্রে সময়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া ইসলামের মৌলিক একটি শিক্ষার অংশ।

৯. আমানতদারি ও দায়িত্ববোধ : কর্মক্ষেত্রে আমানতদারি এবং নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমানতদারি ইসলামে বিশ্বাসের একটি অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়। আল্লাহ বলেন : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করেছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তাদের উপযুক্তদের নিকট ফিরিয়ে দিবে...’ (সুরা নিসা : ৫৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘প্রত্যেক তোমাদের দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকের কাছে তার অধীনদের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হবে।’ (বোখারি)। এ থেকে বোঝা যায়, কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ববোধ এবং আমানতদারি থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজের কাজের প্রতি দায়িত্বশীল থাকা, আমানতের মর্যাদা রক্ষা করা এবং অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকা ইসলামের মূল শিক্ষা।

১০. ধনী-গরিব বৈষম্য না করা : ইসলাম সকল মানুষের মধ্যে সাম্যের উপর গুরুত্ব দেয় এবং শ্রেণি বা সম্পদের ভিত্তিতে পার্থক্য করতে নিষেধ করে। কর্মক্ষেত্রেও ইসলাম সব ধরনের বৈষম্য পরিহারের শিক্ষা দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের এক পুরুষ এবং এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো।...’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)। অন্যদিকে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘আল্লাহর কাছে সব থেকে মর্যাদাশীল হলো সে, যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে।’ (বোখারি)। সুতরাং, কর্মক্ষেত্রে মর্যাদা ও দায়িত্ব প্রদানে কোনো ব্যক্তির আর্থিক অবস্থা বা জাতি-গোত্রের ভিত্তিতে বৈষম্য না করে কাজ করতে হবে।

১১. ব্যক্তিগত এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনে ভারসাম্য : ইসলামে কর্মক্ষেত্রের সাথে পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক কর্তব্যও সমানভাবে গুরুত্ব বহন করে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের আপনজনদের আগুন থেকে রক্ষা করো...’ (সুরা তাহরিম :৬)। এ ছাড়াও রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘তোমাদের প্রত্যেককে তার পরিবার ও অধীনদের দায়িত্ব নিতে হবে।’ (বোখারি)। এই শিক্ষাগুলো একজন মুসলিমকে কর্মক্ষেত্রে যেমন তার দায়িত্ব পালন করতে উৎসাহিত করে, তেমনি পরিবার এবং সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। ইসলাম কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতার উপর ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেছে, কারণ এটি শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের উন্নতি ঘটায় না বরং সমাজের শান্তি, সম্প্রীতি এবং প্রগতি নিশ্চিত করে। একজন মুসলিমের উচিত কর্মক্ষেত্রে কোরআন ও হাদিসের শিক্ষাগুলোর অনুসরণ করে নৈতিকতা রক্ষা করা।

লেখক : প্রভাষক : রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ