ইসলামে নারী অধিকার

ইবনুল ইহসান

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

নারী মানবজাতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। ইসলাম নারীর অধিকার নিশ্চিত করেছে। ইসলাম আবির্ভাবের আগে পৃথিবীর কোথাও নারীদের ন্যায্যাধিকার ছিল না। ইসলাম তাদের অধিকার দিয়েছে। মর্যাদা দিয়েছে। করেছে সম্মানিত। মা, মেয়ে, স্ত্রী হিসেবে সমাসীন করেছে সম্মানের শীর্ষ আসনে। আল্লাহতায়ালা বলেন, তারা তোমাদের পরিচ্ছদ, তোমরা তাদের পরিচ্ছদ (সুরাবাকারা : ১৮৭)। এ আয়াত নারী-পুরুষের অধিকারে ন্যায্যতার জানান দেয়। বিদায় হজে রাসুল (সা.) উম্মতকে সতর্ক করে বলেন, শোন! নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে চলবে (আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া : ৫ : ৩৩১)। এ বক্তব্য নারীর অধিকার ও প্রাপ্য সম্মানের প্রতিনিধিত্ব করে।

জাহেলি যুগে নারী : ইসলামণ্ডপূর্ব সমাজে নারী ভোগের পণ্য বৈ কিছু ছিল না। অন্যান্য পণ্যের মতো হাটে-বাজারে নারী কেনাবেচা হত। পিতার মৃত্যুর পর অন্যান্য সম্পদের সাথে তার একাধিক স্ত্রীকেও সন্তানরা উত্তরাধিকারসূত্রে ভাগ করে নিত। সে সমাজ মেয়েসন্তানকে লজ্জার কারণ মনে করত। তাই, পিতা আপন মেয়েকে জীবন্ত কবর দিতে কুণ্ঠিত হত না। ইসলাম এই বর্বরতা ও অমানবিকতার লাগাম টেনে ধরে। ঘোষণা করে, এই বর্বরতার জবাব কেয়ামতে দিতে হবে। কোরআনে এসেছে, স্মরণ করুন, যখন জীবন্ত কবর দেয়া কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কোনো অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল (সুরা তাকভীর : ৮-৯)। এ আয়াতে জাহেলি যুগে নারীর প্রতি জুলুমের চিত্র প্রকাশ পেয়েছে এবং এ জুলুমের জবাবদিহি অবশ্যম্ভাবী তা সুনিশ্চিত করা হয়েছে।

ইসলাম ধর্মে নারীর অধিকার : ইসলাম নারীর অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করেছে। তাদেরকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। কখনো মা, মেয়ে হিসাবে। কখনো বোন, বিবি হিসেবে। ইসলাম তাদেরকে সর্বাবস্থায় গর্বের আসন দ্বারা গৌরবান্বিত করেছে। নারী যখন মা তখন তিনি দুনিয়ার সর্বাধিক সম্মানের অধিকারী। সন্তানের উত্তম আচরণের হকদার। সাহাবী হাকিম ইবনে হিযাম (রা.) বলেন, আমি নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার উত্তম আচরণের সর্বাধিক হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। আমি বললাম, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। আমি বললাম, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। আমি আবার বললাম, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার বাবা (তিরমিজি : ১৮৯৭)। আল্লাহ এবং রাসুলের পরেই মায়ের স্থান।

ইসলাম মেয়েদের আইয়্যামে জাহেলিয়ার লাঞ্ছনা ও অপদস্ততার আস্তাকুঁড় থেকে সম্মানের সুউচ্চ সিংহাসনে আরোহণ করিয়েছে। নবীজি বলেছেন, যে ব্যক্তি দুটি মেয়ে সন্তানকে লালন-পালন করবে, আমি এবং সে পাশাপাশি এভাবে (দু-আঙুল দ্বারা ইশারা করে) জান্নাতে প্রবেশ করব। (তিরমিজি:১৯১৪)। অন্য হাদিসে এসেছে, নবীজি বলেন, কন্যা পিতার জাহান্নামের প্রতিবন্ধক হবে (তিরমিজি : ১৯১৩)। ইমাম শাফি (রহ.) বলেন, সন্তান আল্লাহর নেয়ামত। আর মেয়ে সন্তান পুণ্য। মহান আল্লাহ নেয়ামতের হিসাব নেবেন আর পুণ্যের প্রতিদান দেবেন। জাহেলি যুগের যে লোকেরা মেয়ে লালন-পালন করাকে নিজেদের জন্য অপমান ও লজ্জার মনে করত, নবীজির এই বাণী শুনে সে লোকেরা ইসলামি যুগে মেয়েদেরকে গর্বের সাথে লালন-পালন করতে থাকেন। নারী যখন বোন, তখন সে হবে ভাইয়ের আদরের পাত্রী। কিন্তু জাহেলিয়্যাত ভাইকে ভুলে দিয়েছিল বোনের সম্মান ও গুরুত্বের কথা। অধিকার ও ক্ষমতার কথা। ইসলাম বোনের অধিকার ও সম্মান সুনিশ্চিত করেছে। বোনের অধিকারকে সমুন্নত করতে নবীজি বলেছেন, যার তিনটি বোন আছে, আর সে তাদের সাথে স্নেহপূর্ণ আচরণ করে তাহলে সে জান্নাতে যাবে (তিরমিজি : ১৯১২)। আধুনিকতা আমাদেরকে আবারো জাহেলিয়্যাতের দিকে ফিরিয়ে নিচ্ছে। যার কারণে এ যুগের ভাইয়েরাও বোনেদের ততটা খেয়াল রাখেন না। বাপের রেখে যাওয়া সম্পত্তিসহ অন্যান্য বিষয়ে তাদের প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দিতে আন্তরিক নয়। এটা হাদিসের ভাষ্যমতে ভাইদের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনকে কলঙ্কিত করে। ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বৈবাহিক ক্ষেত্রে ইসলাম নারীদের জন্য ইনসাফ ও অধিকার নিশ্চিত করেছে। নারীরা ভোগের পণ্য, জাহেলিয়াতের এই ঘৃণিত প্রথার মূলোৎপাটন করেছে, আল্লাহ ঘোষণা করেন, তোমাদের যদি আশঙ্কা হয় যে, তোমরা তাদের ওপর ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে (স্ত্রী হিসেবে) একজনকে গ্রহণ কর (সুরা নিসা : ৩)। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর, কেননা তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত ও প্রতিশ্রুতির সাথে গ্রহণ করেছ (মুসলিম : ১২১৮)। এক সাহাবী নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের ওপর স্ত্রীদের কী অধিকার আছে? নবীজি বললেন, তুমি যখন খাবে তখন তাকেও খাওয়াবে। তুমি পরিধান করলে তাকেও পরিধান করাবে। আর মুখে প্রহার করবেনা এবং কোন প্রকার গালমন্দ ও অসদাচরণ করবে না (আবু দাউদ : ২১৪২)। একজন স্ত্রীর ওপর স্বামীর যেমন অধিকার আছে। তেমনি একজন স্ত্রীরও স্বামীর ওপর অধিকার রয়েছে। আল্লাহ বলেন, স্ত্রীদেরও পুরুষদের ওপর ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে (সুরা বাকারা : ২২৮)।

ইসলাম নারীদেরকে সম্পত্তিতে অধিকার দিয়েছে। মৃত স্বামীর কোনো সন্তান না থাকলে স্ত্রী সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ পাবে। আর যদি সন্তান ইত্যাদি থাকে, তাহলে এক-অষ্টমাংশ মিরাস পাবে (সিরাজী : ২১)। মৃত ব্যক্তির একজন মেয়ে হলে সম্পত্তির অর্ধাংশ পাবে। আর দুই বা ততোধিক মেয়ে হলে সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে। আর যদি মেয়ের সাথে ছেলে সন্তানও থাকে, তাহলে মেয়ে ছেলের অর্ধেক পাবে (সিরাজী : ২২)। মৃতের সন্তান ইত্যাদি থাকলে মা এক-ষষ্ঠাংশ পাবে। আর না থাকলে, এক-তৃতীয়াংশ পাবে (সিরাজী : ৩৩)। অবস্থাভেদে বোনও মৃত ভাইয়ের সম্পত্তি থেকে পাঁচভাবে উত্তারাধিকারী হয়ে থাকে। ইসলাম নারীদের সম্পত্তিতে যে অধিকার দিয়েছে, আমাদের সমাজের পুরুষরা তা দিতে হৃদয়বান নন। যা কোনোভাবেই শরিয়তসিদ্ধ নয়। উপরোক্ত বিষয়গুলো নারীদের হক। কেউ তাদের এই হক আদায়ে গড়িমসি করলে কেয়ামতে আল্লাহর কাছে তার জবাবদিহি করতে হবে এবং এই নারীরা মাফ না করলে আল্লাহতায়ালাও তাদের মাফ করবেন না। ইসলাম সর্বকালীন ধর্ম। ইসলাম ইনসাফের ধর্ম। সমাজে ও রাষ্ট্রে যথাযথভাবে ইসলাম মেনে চললে, আন্দোলন করে নারীকে তার অধিকার আদায় করতে হবে না। নিজ ঘরে বসেই সম্মানের সাথে তার প্রাপ্য অধিকার পাবে।