যুগে যুগে ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাস

আবদুল্লাহ আশরাফ

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বায়তুল মুকাদ্দাস আর জেরুজালেম একই শহর। বহুবছরের সমৃদ্ধ শহর। এই শহরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো- হজরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের নামের সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনটি ধর্মের আছে সংবেদনশীলতা। ফলে তিনটি ধর্মেরই কাছে গুরুত্বপূর্ণ এ নগরী। ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম। এই তিনটি ধর্মের মধ্যে স্বতন্ত্র ইসলাম। এ ব্যাপারে কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতের বেলায় নিয়ে গেছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত,যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি- যাতে তাঁকে আমার (কুদরতের) নিছু নিদর্শন দেখাই। নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। (বনি ইসরাইল : ১)।’

মুসলিম উম্মাহর কাছে এ নগরী পবিত্রতার আরো কারণ হলো- এটি আমাদের প্রথম কেবলা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায় ১৬ মাস এ দিকে ফিরে পাঁচওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। এ ছাড়া মেরাজের প্রথম মনজিল এটি।

প্রাচীনতম ঐতিহাসিক বিভিন্ন নিদর্শনের আলোকে ধারণা করা হয়, এ অঞ্চল আদিকালে মিশরীয়দের শাসনাধীন ছিল। পরবর্তীতে হজরত ইয়াকুব (আ.) এখানে ইবাদতখানা তৈরি করেন। খ্রিষ্টপূর্ব একহাজার বছর পূর্বে হজরত দাউদ (আ.) এ শহর অধিকার করেন। তার ছেলে সুলায়মান (আ.) এ মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস পুননির্মাণ করেন।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্যাবলিন (বাবেল)-এর সম্রাট বুখতে নাসার জেরুজালেমের এই শহরটি জয় করে ধ্বংস্তূপে পরিণত করেন। পরবর্তীকালে ফিলিস্তিন নামে এ অঞ্চলটি ইরানি ও গ্রীক সম্রাটদের অধীনে শাসিত হতে থাকে।

মাহাবীর হেরোদ, যার রাজত্বকাল খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭ থেকে ৪০ পর্যন্ত। সে সময় এ শহর ও মসজিদটি আবাদ হয়। এখানে হজরত ঈসা (আ.) তাঁর দ্বীন প্রচার করেন। রোমান সম্রাট টাইটাস-এর সময় ৭০ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে আরো একবার দুর্যোগ নামে এ শহরে। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। পরবর্তীকালে রোমান সম্রাট হ্যড্রিয়ান (১১-৩৮) এর রাজত্বের শুরুতে জেরুজালেমের শান্তিপূর্ণ জীবন শুরু হয়।

১৩২ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট ইহুদিদের প্রতি ‘খতনাপ্রথা’ বন্ধ করার আদেশ জারি করেন। বিদ্রোহ দেখা দিলে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দমন করা হয়। বিধ্বস্ত জেরুজালেমকে তিনি একটি নির্ভেজাল পৌত্তলিক শহররূপে গড়ে তুলেন।

যুগ যুগ ধরে ইহুদি নির্যাতনের শিকার হয়। রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন দ্য গ্রেট (৩০৬-৩৩৭) তিনশ সাইত্রিশ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। খ্রিষ্টানরা দলে দলে জড়ো হয় এখানে। সম্রাট বহু আধুনিক ও প্রাচুর্যময় গীর্জা নির্মাণ করেন। ওই সময় ইহুদিরাও প্রবেশ করে এই শহরে। দিন দিন আরো সুযোগ পায় ইহুদিরা। ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে ইরানিরা জেরুজালেমে ধ্বংসের তাণ্ডব চালায়। আবার অশান্তি শুরু হয়। ইরানিরা খ্রিষ্টানদের ওপর আক্রোশ থাকায় বেশি করে হত্যা করে তাদের। ইহুদিরা এ সুযোগে ইরানিদের সঙ্গে মিলে খ্রিষ্টান্দের ওপর প্রতিশোধ হিসেবে হত্যায় মেতে ওঠে। কিছুকাল পর পুনরায় সম্রাট হেরাক্লিয়াসের বিজয় অভিযানের মাধ্যমে শান্তি ফিরে আসে জেরুজালেমে।

ইতোমধ্যে আরব বসন্ত শুরু হয়। ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। মদিনার হিজরতের মাধ্যমে একটি পূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম আরব সীমান্ত অতিক্রম করে।

৬৩৪ সনে জুলাই মাসে ফিলিস্তিনের নিকটবর্তী অঞ্চল আজনাদাইনে মুসলিম বাহিনীর নিকট রোমান বাহিনী পরাজিত হয়। ৬৩৬ ক্রিষ্টাব্দে ইয়ারমুকের যুদ্ধ ছিল ভাগ্যনির্ধারণী যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের সুরক্ষিত দুর্গগুলো মুসলমানের হাতে চলে আসে। ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে হজরত উমর (রা.) আগমনের মাধ্যমে খুব সুন্দরভাবে জেরুজালেম মুসলামনদের হাতে আসে। কোনো হত্যাযজ্ঞ হয়নি সেদিন। কিছু সন্ধিচুক্তি যুক্ত করেন মাত্র। তা আজও স্বর্ণাক্ষরে লিখিত।

ওই সময় হজরত উমর (রা.) সাখরাহ বা প্রস্তরটিলা ও বোরাক বাঁধার স্থানটির নিকটে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে খলীফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান ওই স্থানে গম্বুজ নির্মাণ করেন। যা কুব্বাতুসসাখরাহ বা ডোম অব রক নামে প্রসিদ্ধ। ওই সময় বায়তুল মুকাদ্দাস শান্তি ও নিপরাত্তার শহর বলে খ্যাতি লাভ করে। ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণ কেন্দ্র স্বীকৃতি পায়। খলিফা আব্বাস, মানসুর ও হারুন রাশীদও ক্রমেই এই শহর ও মসজিদে আকসার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন।

ইহুদি ও খ্রিষ্টান ছাড়া কেউ মুসলমানের এই অবদানের কথা অস্বীকার করেনি। অথচ মুসলিম শাসন আমলে তারাই সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করে। ক্রমেই বিভিন্ন সময় শাসনভার খলিফাদের হাত বদল হতে থাকে। এত শান্তি আর নিরাপদ থাকা সত্ত্বেও ইহুদি-খ্রিষ্টানরা ওই সময়ও গোলযোগ সৃষ্টি করত। তবুও মুসলিম শাসকরা তাদের ধর্মী অধিকারে হস্তক্ষেপ করেননি।

ইহুদি-খ্রিষ্টানরা কখনো বসা ছিল না। সময়ের পালাবদলে মুসলিম শাসকদের মধ্যে দুর্বল নেতৃত্ব চলে আসে। ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে পড়ে। ওই সময় খ্রিষ্টানরা গোপনে ক্রুসেডের প্রস্তুতি নেয়। ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ সর্বপ্রথম চরম ইসলামবিদ্বেষী পোপ দ্বিতীয় আরবান (৪৮০/১০৮৮-৪৯২-১০৯৯) এর অন্তরে ও চিন্তা উদিত হয়। পোপেরা মানুষের কাছে কাল্পনিক মিথ্যা কথা ছড়াতো। বলে বেড়াতো ‘যারা ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে গমন করবে তারা স্বর্গীয় ক্ষমা লাভ করবে।’ এ ঘোষণায় প্রভাবিত হয়ে ১৫ জুলাই-১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বিজয় বেশে বাইতুল মুকাদ্দিসে তারা প্রবেশ করে। ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। যা বর্ণনাতীত। তারা নব্বই বছর শাসন করে ফিলিস্তিন। ১১৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ক্রুসেডের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন, ইরাকের নুরুদ্দীন জঙ্গি। তাঁর শিষ্য সালাহুদ্দীন আইয়ূবি। সে শিষ্যের হাত ধরে কোনো রক্তপাত ছাড়া পুনরায় বায়তুল মুক্কাদ্দিস মুসলমানদের হাতে আসে।অথচ ইহুদি-খ্রিষ্টানরা এ শহর যতোবারই দখল করেছে, রক্তের বন্যা বয়ে দিয়েছে। শান্তির শহর হিসেবে পুনরায় খ্যাতি পায় ফিলিস্তিন।

১৯৪০ সালে জার্মান থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করে হিটলার। তখন লাখ লাখ ইহুদি মারা যায়। ফলে তারা দেশত্যাগ করে। কেউ তাদের কোনো আশ্রয় দেয়নি। যাযাবরময় জীবন ছিল তাদের। সাগরে সাগরে ঘুরে বেড়াতো। শরীরে বস্ত্র ছিল না। মুখে অন্ন ছিল না। ফিলিস্তিনের সাগর উপকূলে তারা নোঙর ফেলে। ফিলিস্তিনিরা তাদের বস্ত্র দেয়। অন্ন দেয়। এতকিছু পেয়েও ওরা সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন না করে- দিন দিন ভয়ংকর হয়ে ওঠে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করে। হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে অন্নবস্ত্র ও জমিজামা ছিনিয়ে নেয়। পৃথিবীজুড়ে ভয়ংকর সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত পায়। ক্রমেই তারা বিশাল বটবৃক্ষে পরিণত হয়।