আদর্শ জাতি গঠনে ওলামায়ে কেরামের অবদান অনস্বীকার্য। নিজেরা সাধারণ জীবনযাপন করে হলেও জাতিকে ঈমান ও আমলের ওপর ঠিক রাখার জন্য নিরলস মেহনত করে যান তারা। দুনিয়ার জীবনের আরামণ্ডআয়েশ ত্যাগ করেই ভারত উপমহাদেশে আলেমগণ জাতিকে নীতি নৈতিকতার পাঠ দেওয়ার মিশনে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন। আজও এ ধারা অব্যাহত আছে। আমরা জানি, আলেমরা দুনিয়াতে নবীদের প্রতিনিধিত্ব করেন। নবীদের অবর্তমানে তাদের সকল কাজ আঞ্জাম দেন। নবী (সা.) বলেছেন, আলেমরা নবীদের ওয়ারিস (আবু দাউদ : ৩৬৪১)। তারা নবীদের ওয়ারিস জ্ঞানে, গুণে। আদবে, আখলাকে। ভদ্রতায়, শিষ্টাচারে। আচার, আচরণে। ন্যায়, ইনসাফে। মোদ্দাকথা, নবীরা ধর্মীয়, সমাজিক, রাষ্ট্রীয়, বৈশ্বিক ক্ষেত্রে যত ধরনের কাজ করেছেন সকল ক্ষেত্রে-ই আলেমরা নবীদের ওয়ারিস। নবীরা যত ধরনের কাজ করেছেন, তাদের অনুপস্থিতিতে আলেমরা সবগুলো পরিচালনা করবেন। সভ্য সমাজ বিনির্মাণে নবীরা যে সকল ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। আলেমরাও সেই সকল ক্ষেত্রে অবদান রাখবেন। সভ্য সমাজ বিনির্মাণে আলেমদের ত্যাগ ও অবদান তুলে ধরা হলো।
আদর্শ জাতি গঠন : পরিশুদ্ধ, নৈতিকতাস¤পন্ন আদর্শ জাতি গঠনে আলেমদের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের নৈতিকতা ও শুদ্ধতার শিক্ষা, আদর্শ জাতিগঠন ও সমাজ বিনির্মাণে মূল চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করে। আল্লাহ বলেন, তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ, তাদের পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কেতাব ও হেকমত (সুরা জুমআ:২)। নবীজির অনুপস্থিতিতে এই কাজটি আলেমরা করে থাকেন। মসজিদের মিম্বারে, ওয়াজের ময়দানে, দরবারে, খানকায়,সেমিনার ও সেম্পজিয়ামে জনসাধারণের জন্য নসিহতমূলক বক্তৃতায় এবং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে তাদের সঞ্জীবনী আলোচনা ছাত্রদের নৈতিকতাসম্পন্ন আদর্শ ব্যক্তি হতে আত্নার খোরাক হিসাবে কাজ করে।
কল্যাণের পথে আহ্বান : ভালো কাজে আদেশ এবং খারাপ কাজে নিষেধ করা সকল মানুষের নৈতিক এবং ঈমানী দায়িত্ব হলেও এই কাজ পূর্ণাঙ্গ নিষ্ঠার সাথে আলেমরাই পালন করেন। আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে (সুরা আলে ইমরান: ১০৪)। আর করবেন-ই না বা কেন? তাদের প্রতি মহান আল্লাহর হুকুম রয়েছে যে, আলেমরাই জাতিকে সর্তক করবেন। তাদেরকে ভালো-মন্দ বোঝাবেন। সঠিক পথ দেখাবেন। আল্লাহ বলেন, প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে তারা দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সর্তক করবে স্ব-জাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে আসবে, যেন তারা বাঁচতে পারে (সুরা তাওবা: ১২২)।
পাঠদান : মুসলিম জাতিকে শিক্ষিত করতে যুগযুগ ধরে আলেমরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। আমরা যদি দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে তাকাই তাহলে দ্বিধাহীন চিত্তে এই কথা স্বীকার করব যে, গোটা দেশে বিশেষত গরিব-অসহায় ও প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যবস্থা আলেমদের দ্বারাই সাধিত হচ্ছে। তারা তাদের ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। নবী (সা.) এর বিদায় হজের সেই আদেশকে কার্যকর করছেন। তিনি বলেছিলেন, আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও অন্যের কাছে পৌঁছে দেও (বোখারি: ৩৪৬১)। নবীজির বাণীকে পৌঁছানোর মাধ্যমে তারা সমাজের মানুষকে শিক্ষিত করার প্রয়াস পাচ্ছেন।
সেবামূলক বহুমাত্রিক কাজ : প্রত্যেক আলেম তার গোটা জীবনকে কোন না কোন জনসেবামূলক কাজে উৎসর্গ করেন। কিন্তু তারা সেই সেবাকে মানুষের কাছে প্রকাশ করেন না বা করতে চান না। কারণ তারা জনসেবা করেন ইবাদত হিসেবে। আর মানুষ দেখানো ইবাদত আল্লাহ কবুল করেন না। রাসুল (সা.) বলেছেন, দুনিয়াবাসীর ওপর অনুগ্রহ করো, তাহলে আসমানের অধিপতি তোমার ওপর অনুগ্রহ করবেন (আবু দাউদ : ৪৯৪১)। জনসেবায় তারা রাসুলের এই কথাকে মূলনীতি মেনে চলেন। সেবার দ্বারা মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করেন; কিন্তু সেটাকে প্রকাশ করেন না।
শুদ্ধবিমল মানুষ গড়া : ধর্মই মানুষকে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। আর ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী আলেমরা সেই শিক্ষাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের নৈতিকতার ভিত মজবুত করেন। আলেমরা সমাজকে শিক্ষা দেন, সদা সত্য কথা বলতে এবং মিথ্যা পরিহার করতে। নবীজি বলেছেন, সত্য আত্মার জন্য শান্তিদায়ক আর মিথ্যা অশান্তকারক (তিরমিজি:২৫১৭)। সতর্ক করেন মানুষকে নীতিনৈতিকতার পতন ও সামাজিক অবক্ষয় থেকে যেন তারা বেঁচে থাকতে পারেন।
সুদ, ঘুস ও সকল ধরনের ধোঁকা প্রতারণা থেকে বিরত থাকতে নসিহত পেশ করেন। উৎসাহিত করেন অন্যকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, কে সেই ব্যক্তি যে, আল্লাহকে (গরীব, অসহায়দের) উত্তম ঋণ দেবে, এরপর তিনি তার জন্যে তা বহুগুনে বৃদ্ধি করবেন (সুরা হাদিদ: ১১)।
দেশ রক্ষার শপথ : আলেমগণ দেশ রক্ষার প্রশ্নে আপসহীন। জীবনবাজি রেখে তারা দেশের স্বার্থে সদা সামনের কাতারে থাকেন। রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়ে তারা ইতিহাসে মলিন বা বিলীন হন। কিন্তু তাদের দেশপ্রেম নজিরবিহীন। নবীজি বলেছেন, দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ (সাখাবি: ৯০২)। তাই আলেমদের হৃদয় সদা-সর্বদা দেশ প্রেমে মজে থাকে। প্রকৃত আলেম কখনো দেশ বিরোধী কাজে জড়াতে পারেন না, বরং তারা দেশ রক্ষায় জীবন দিতে প্রস্তুত থাকেন। যেমন তারা জীবন দিয়েছেন সাতচল্লিশের ইংরেজ খেদাও অন্দোলনে। একাত্তরে জীবন দিয়েছেন স্ব-জাতির জালেমদের বিরুদ্ধে। জাতিকে মুক্ত করেছেন পরাধীনতার শৃংখল থেকে। চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানেও আলেমগণ শহিদ হয়েছেন। আলেমরা সর্বদা জাতির নিরাপত্তার জন্য সজাগ থাকেন। সজাগ থাকেন জাতির জীবন ও ঈমান রক্ষার জন্য।
অপতৎপরতা রোধ : সমাজকে অপরাধ মুক্ত করতে। অপরাধী ও কুচক্রি যারা সর্বদা সমাজে ফাসাদ সৃষ্টির সুযোগ সন্ধানে থাকে কিন্তু নিজেদের নিরাপরাধ ও শান্তিকামী বলে প্রকাশ করে। আল্লাহর ভাষায়- যখন তাদের বলা হয়, দুনিয়াতে ফাসাদ সৃষ্টি কর না। তারা বলে, আমরাই মিমাংসাকারী (সুরা বাকারা: ১১)। আলেমরা এমন কুচক্রীদের ব্যাপারে সমাজকে সচেতন করেন। অসৎ লোকদের অপতৎপরতা থেকে সমাজকে রক্ষা করতে আলেমরা সর্বক্ষণ অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেন। মসজিদের মিম্বারে মিম্বারে জোড়ালো আওয়াজ তুলে অপতৎপরতা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশের জনসাধারণকে সতর্ক করেন।
রাজনীতিতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা : রাজনীতি আমাদের সমাজ জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নোংড়া লোকেদের আনাগোনায় রাজনীতির মাঠ কলুষিত হয়। রাজনীতিকে নববী আদর্শে ফিরে নিতে এদেশের কিছু আলেম নিরলসভাবে কাজ করছেন। চেষ্টা করেছেন স্বচ্ছ রাজনীতি করতে এবং দেশের মানুষকে ন্যায় ইনসাফের সুফল পাওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে। মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর, শায়খুল হাদিস আজিজুল হক, মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রহ.), মুফতি আমিনী (রহ.) প্রমুখ বাংলার রাজনীতির মাঠে ইনসাফ কায়েমের চেষ্টা করেছেন আমরণ।
অন্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা : ইসলাম মুসলমানদের অধিকারের পাশাপাশি অন্যান্য সকল ধর্মের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে। আর ইসলামের এই বিধান প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন আলেমরা। কোথাও কোন বিধর্মী লাঞ্ছিত বা অপদস্ত হলে আলেমরা তার বিরোধিতা করেন। ইসলাম কারো প্রতি অন্যায়, অবিচার করে না এবং জুলুমণ্ডঅত্যাচারকে সাপোর্টও করে না। নবী (সা.) বলেছেন, জুলুম কেয়ামতে অন্ধকারে থাকবে (মুসলিম : ২৫৭৮)। তাই যখন কোথাও কোন জুলুমণ্ডঅত্যাচার হয় আলেমরা সেটার ব্যাপারে সোচ্চার হন। মানুষকে সতর্ক করেন, জুলুম, অন্যায় ও অবিচার থেকে বিরত থাকার জন্য।
কিতাব ও হেকমতের শিক্ষাদান : আলেমরা সমাজকে ঐশী শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। নবী (সা.) এর উপর যে শিক্ষার দায়িত্ব এসেছিল, তার ইন্তেকালের পর আলেমরা সেই গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছেন। জাতিকে আসমানি শিক্ষায় শিক্ষিত করছেন। আল্লাহ বলেন, তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কেতাব ও হেকমত (সুরা জুমুআ : ২)। আর যে জাতি আসমানি শিক্ষায় শিক্ষিত তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠজাতি। তাই, বলা যায় আলেমরা আমাদের স্রেষ্ট জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।