ইতিহাসের পাতায় যেসব খ্যাতিমান ব্যক্তি, ক্ষণজন্মা মনীষীদের জীবনেতিহাস লিপিবদ্ধ আছে, যাদের আলোচনা-পর্যালোচনা মানুষের মুখে মুখে যুগ যুগ ধরে উচ্চারিত হয়ে আসছে, যাদের সুদূরপ্রসারী চিন্তাচেতনায় পরবর্তী প্রজন্ম অমূল্য কিছু সম্পদ পেয়ে থাকে, যাদের কথা ও কাজে সুন্নাতি আমেজের সুঘ্রাণ ঝরে, ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া হিসেবে যাদের মানুষ শ্রদ্ধা করে, তাাদের অন্যতম হলেন কুতবুল আলম শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হুসাইন আহমাদ মাদানি (রহ.)-এর খলিফা মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা আবদুল হক শায়খে গাজিনগরী মদফুনে মক্কি (রহ.)।
১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিল ১৩৪৭ হিজরির ২০ সফর মঙ্গলবার সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের গাজিনগর গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কেরামত আলী মুন্সি আর মায়ের হানিফা খাতুন।
শিশুকালেই তিনি মাতৃহারা হয়ে যান। কালক্রমে যিনি হবেন হক ও হক্কানিয়তের এক জীবন্ত নমুনা; শৈশবেই ফুটে উঠল তার মধ্যে সুন্নতে নববির সূত্রপাত। দুধপানের মেয়াদ সমাপ্ত হতে না হতেই সম্মানিতা মাতাকে হারান তিনি। কথিত আছে, দুগ্ধপোষ্য শিশু আবদুল হক হামাগুড়ি দিয়ে দুধপানের জন্য মৃত মায়ের লাশের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছিলেন। এ করুণ দৃশ্য দেখে উপস্থিত সকলেরই নিজের অজান্তে চোখের জলে বুক ভাসছিল। মা-হারা শিশু শরিফপুর গ্রামে নানা সোনা মিয়ার বাড়িতে কিছুদিন লালিত-পালিত হতে লাগলেন। আবদুল হক শায়খে গাজিনগরী শৈশবে তার মামার বাড়ি দিরাই উপজেলার শরিফপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার সূচনা করেন। এখানে তিনি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।
শরিফপুরে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় একবার এক জঠিল রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশয়ী হয়ে পড়েন। তাকে সুস্থ করার জন্য অনেক ওষুধ-পথ্যের ব্যবস্থা করার পরও যখন সুস্থ হলেন না, তখন যুগশ্রেষ্ঠ ওলি, শাহ সুফি সিকন্দর আলি (রহ.); যিনি সুফিসাহেব নামে খ্যাত, সে মনীষীর দোয়ার বরকতে পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলে তিনি তাকে দ্বীনি শিক্ষার জন্য মাদ্রাসায় পাঠানোর জন্য পরামর্শ দেন।
কঠিন এই রোগ থেকে সুস্থ হওয়ার পর সুফি সাহেব-প্রতিষ্ঠিত দরগাহপুর মক্তব-মাদরাসায় ভর্তি হন। দরগাহপুর মক্তব-মাদরাসায় সুফি সাহেব, মাওলানা আবদুল মুছাব্বির পারকুলি, মাওলানা ছানা উল্লাহ (রহ.) প্রমুখ উস্তাদের কাছ থেকে তিনি প্রাথমিক কিতাবাদি অধ্যয়ন করেন। আর এখানেই লেখাপড়ার প্রতি তার আগ্রহ ও তীক্ষè মেধাশক্তির বিকাশ ঘটে।
জ্ঞানতাপস মহান এ সাধক ইলমে দ্বীন অর্জনের জন্যে দরগাহপুর থেকে হবিগঞ্জ জেলায় বানিয়াচং আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে নাহবেমির জামাত পর্যন্ত প্রায় ৪ বছর অধ্যয়ন করেন। উল্লেখ্য, বানিয়াচং আলিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়ার সময় ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে একবার শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানি (রহ.)-এর বানিয়াচং আগমন ঘটে। তার আগমন নিয়ে এলাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনার অবতারণা হলে মাদানি (রহ.)-এর প্রতি তার অগাধ ভক্তি-ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে। ফলে শায়খে গাজিনগরীকে হবিগঞ্জ কারাগারে দীর্ঘ একমাস কারাবরণ করতে হয়।
বানিয়াচংয়ে ৪ বছর অধ্যয়নের পর ১৯৪৮ সালে চলে আসেন সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায়। এখানে কিছুদিন পড়ার পর মাদ্রাসার ছাত্রদের চাল-চলন, আচার-আচরণ তার ভালো লাগেনি বলে সিলেট থেকে চলে যান জামিয়া ইউনুসিয়া বি-বাড়িয়ায়। জামিয়া ইউনুসিয়ায় অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে সানাবিয়া ৩য় বর্ষ অর্থাৎ মুখতাসারুল মাআনি জামাত পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। সেখানে তার উল্লেখযোগ্য উস্তাদ হলেন, মুনাজিরে জামান ফখরে বাঙাল আল্লামা তাজুল ইসলাম, শায়খুল হাদিস সিরাজুল ইসলাম (রহ.)। আর সহপাঠীদের অন্যতম হলেন, শায়খুল হাদিস মুফতি নুরুল্লাহ, শায়খুল হাদিস মুনিরুজ্জামান, মাওলানা আবদুল মালিক গাজিনগরী ছদর সাব হুজুর প্রমুখ।
শায়খে গাজিনগরী শৈশব থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। জামিয়া ইউনুসিয়ায় থাকার সময়ে একবার তার এক উস্তাদ তাকে বললেন, ‘আবদুল হক, হেদায়াতুন্নাহু মুখস্থ করে আমাকে শোনাতে হবে, শিক্ষকতা জীবনে-এর প্রয়োজন অনেক।’ উস্তাদের আদেশ বিধায় অল্প কদিনের মধ্যেই তিনি হেদায়াতুন্নাহু কিতাবখানা পূর্ণ মুখস্থ শুনিয়ে দিলেন তাকে। এতে ওই উস্তাদ খুব আনন্দিত হন।
শায়খে গাজিনগরী জামিয়া ইউনুসিয়ায় তিন বছর পড়ালেখার পর উচ্চ শিক্ষা অর্জন এবং আকাবির আলিমদের ফয়েজ ও সুহবতলাভের আশায় ১৩৭০ হিজরিতে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ গমন করেন। সেখানে অত্যন্ত সুনামণ্ডসুখ্যাতির সঙ্গে দীর্ঘ ৪ বছর লেখাপড়া করেন। দাওরায়ে হাদিসের জামাতে হাদিসের কালজয়ী গ্রন্থ বোখারি শরিফ এবং তিরমিজি শরিফ শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হুসাইন আহমাদ মাদানি (রহ.)-এর নিকট থেকে দারসলাভে ধন্য হন। এ ছাড়া আল্লামা এজাজ আলি, মুফতিয়ে আজম মুফতি শফি (রহ.) প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসের থেকে সিহাহ-সিত্তার অন্যান্য কিতাব অধ্যয়ন করেন।
শায়খ আবদুল হক গাজিনগরী (রহ.) দারুল উলুম দেওবন্দে দাওরায়ে হাদিস সমাপনের পর মাদানি (রহ.)-এর খিদমতে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন এবং আরো দুই বছর সেখানে অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি আপন মুর্শিদের খিদমতের পাশাপাশি খিলাফত লাভে ধন্য হন এবং নিজ মুর্শিদের নির্দেশে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
১৩৭৭ হিজরিতে দেওবন্দ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মাদানি (রহ.)-এর অনুমতিক্রমে ফখরে বাঙাল আল্লামা তাজুল ইসলাম (রহ.) তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে জামেয়া ইউনুসিয়া বি-বাড়িয়ায় শিক্ষকতায় নিযুক্ত করেন। সেখানে একবছর দায়িত্ব পালনের পর আপন মুর্শিদ পত্রের মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দিলেন, ‘মাকান যা কর মদরসা কায়িম করো।’ তখন তিনি ফখরে বাঙাল (রহ.)-এর ইজাজত নিয়ে বাড়িতে চলে আসেন এবং দরগাহপুরে ১৩৬৪ বাংলায় প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম দরগাহপুর। দীর্ঘ ৫১ বছরে দারুল উলুম দরগাহপুরকে তিনি তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ইহতেমামির দায়িত্ব পালন করে জীবনের পড়ন্ত বিকেলে এসে একবার মাদ্রাসার এহতেমামির দায়িত্ব ছেড়ে দিলেও কিছুদিনের মধ্যেই আবার তাকে পীড়াপীড়ি করে ইহতেমামির দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি সম্মত হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত ইতমিনানের সঙ্গে মাদ্রাসার দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
উল্লেখ্য, দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে চলে আসার পর দরগাহপুর নামে যে মাদ্রাসাটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, এটি তার শৈশবে থাকলেও পাকিস্তান আমলে এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তিনি এখানে পুনরায় মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপন করেন।
শায়খে গাজিনগরী দুটি বিয়ে করেন। তন্মধ্যে প্রথম বিয়ে মাদানি (রহ.)-এর নির্দেশে দেওবন্দে থাকার সময়ে ১৩৭৭ হিজরিতে দিরাই উপজেলার তারাপাশা গ্রামের মুমতাজ বেগমের সঙ্গে। তার গর্ভে মোট ১৩ জন সন্তান জন্মগ্রহণ করেন, ৬ ছেলে ও ৭ মেয়ে।
ইসলামি রাজনীতির অঙ্গনে শায়খ আবদুল হক গাজিনগরী (রহ.)-এর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। আকাবির ও আসলাফের সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সদস্য, সহ-সভাপতি এবং মৃত্যু অবধি জময়িতের সিলেট জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে খেজুরগাছ প্রতীক নিয়ে সংসদণ্ডনির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া তিনি ফেদায়ে মিল্লাত সায়্যিদ আসআদ মাদানি (রহ.) প্রতিষ্ঠিত ইসলাহুল মুসলিমিন বাংলাদেশের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
অজপাড়াগাঁয়ে গাড়ি বা নৌকায়, কখনো মাইলের পর মাইল হেঁটে হেঁটে গিয়ে মানুষদের ওয়াজ-নসিহত করতেন। দ্বীনের তালিম দিতেন। পথভোলা, পথহারা মানুষজনকে সঠিক পথের সন্ধান দিতেন। বায়আত করতেন, আত্মার চিকিৎসা করতেন। মানুষদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ইসলামমুখী করতেন।
ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়ার বুকে কত হাজার কোটি মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, ক্ষণজন্মা কত মনীষীর পদধূলিতে ধণ্য হয়েছে এই পৃথিবী; কিন্তু কেউ চিরদিন বেঁচে থাকেননি। স্রষ্টার চিরায়ত নিয়মের মধ্য দিয়েই একদিন তাঁকে চলে যেতে হয়েছে পরপারে, ভক্ত-মুরিদ, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, যশখ্যাতি, ধনসম্পদ এ সবকিছুই বিসর্জন দিয়ে লাব্বায়িক বলতে হয় মহান মাওলার ডাকে সাড়া দিতে। পৃথিবীর বুকে বিচরণশীল প্রত্যেক প্রাণীকেই একদিন-না একদিনই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে; সে যতই ক্ষমতাধর হোক-না কেন। এ জন্য বুজুর্গরা কখনো মৃত্যুকে ভয় করতেন না। মহান মাওলার সান্নিধ্যলাভের আশায় তারা সদণ্ডসর্বদা ব্যাকুল থাকতেন। খলিফায়ে মাদানি আবদুল হক শায়খে গাজিনগরী (রহ.) ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ২ ডিসেম্বর সোমবার স্থানীয় সময় রাত ৩টায় ইন্তেকাল করেন। পরদিন তাকে জান্নাতুল মুয়াল্লার ৮১/১৬ নং কবরে উম্মুল মোমেনিন খাদিজা (রা.)-এর কবরের পাশে দাফন করা হয়। আল্লাহ তাকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন, আমিন।