মক্তব ছাড়া সাধারণ মুসলমানের ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন। মক্তবে পড়ানো ও পড়তে যাওয়া ঈমান চর্চার তাগিদে হয়ে থাকে। তাই মুসলিম সমাজে মক্তবের গুরুত্ব অপরিসীম। মসজিদভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের শিক্ষালয়কে মক্তব বলে। মক্তব বাঙালি মুসলমানের হাজার বছরের ঐতিহ্য। সাধারণত মক্তব বলতে আমরা বুঝি এমন স্থান, যেখানে বাচ্চাদের শুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত শেখানো হয়। বিশেষত ইসলামের প্রাথমিক, মৌলিক ও প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসাইল শিক্ষা দেয়া হয়। মূলত কোরআন-হাদিসের প্রাথমিক বিষয়গুলো পাঠদান করা হয় মক্তবে। সেই সঙ্গে ইবাদত-বন্দেগি, অজু-গোসল, নামাজ-রোজা, জানাজা- এসবের বিধানাবলি ও বিভিন্ন দোয়া শেখানো হয় মক্তবে। ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, মক্তব শিক্ষা হচ্ছে শিশুদের ঈমান বৃদ্ধির দুর্গ, ধর্মীয় মূল্যবোধের পাঠশালা, ঈমান জাগানিয়া শিক্ষা ও কোরআন মাজিদ শিক্ষার প্রাথমিক স্তর। মক্তব মুসলমানদের আদি ও মৌলিক শিক্ষাক্রম। একজন মুসলমান হিসেবে যতটুকু জ্ঞানার্জন জরুরি, তার সিংহভাগ মক্তব থেকে অর্জন করা সম্ভব।
মক্তব শিক্ষায় রয়েছে ইতিবাচক প্রভাব : মক্তবের শিক্ষা একজন মুসলিম শিশুর জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। মক্তবের পাঠ যে যত গভীর থেকে ধারণ করতে পারে, সে তত মার্জিত ও শালীন হয়। মোটাদাগে এ কথা বলা যায়, মক্তবে পড়ার কারণে একজন শিশু মানবিক ও সুনাগরিক হয়ে ওঠে। মক্তবগুলো গ্রামে সাধারণত ফজর নামাজের পর থেকে দুই ঘণ্টা সময়ের জন্য পরিচালিত হয়। শহরের বিভিন্ন সরকারি আবাসিক এলাকায় সাধারণত মক্তব জোহর বা আসরের পর পরিচালিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য মুসলিম বাচ্চাদের ধর্মের মূল কথাগুলো শেখানো; যাতে তারা মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করতে পারে, ইবাদত পালনে কোনো ধরনের ত্রুটি সৃষ্টি না হয়। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ভারত উপমহাদেশে মক্তবভিত্তিক ধর্ম শেখার শিক্ষালয় চালু হয়েছে হাজার বছর আগে। বিশেষত ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার লাভ করলে মসজিদভিত্তিক মক্তব ব্যাপকতা লাভ করে।
হাজার বছরের ঐতিহ্যের শিক্ষা : মক্তবভিত্তিক পাঠদানের নিয়ম ও প্রচলন আজও আছে। তবে মক্তবগুলো এখন আর আগের মতো খুব গুরুত্বের সঙ্গে পরিচালিত হয় না। এর মূলে দুটো কারণ আছে- এক. সকালবেলার স্কুল ব্যাপক হওয়া, দুই. মসজিদের ইমামদের প্রতি অবহেলা, তাদের জন্য সম্মানদায়ক বেতন নির্ধারণ না করা। এ দুটো কারণ বর্তমান সময়ে মক্তব শিক্ষার অবনতির পেছনে দায়ী। বর্তমানে মিডিয়া ও তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারও মক্তব শিক্ষার আবেদন হারানোর জন্য আংশিক দায়ী। মক্তব ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন- আদব-কায়দা, শিষ্টাচার, সভ্যতা, ভদ্রতা, সৌজন্য, নম্রতা, বড়দের শ্রদ্ধা, ছোটদের স্নেহ করার শিক্ষা দেয়া হয় মক্তবে। এ ছাড়া হালাল-হারাম, পাক-পবিত্রতার মতো প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোও শেখানো হয় সেখানে। মক্তবে কোরআন শিক্ষার পাশাপাশি মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন ও বড়দের সালাম এবং সম্মান দেয়া, সুন্দর ও মার্জিত ভাষায় কথা বলাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিষয় শেখানো হয়। শৈশবে এ আলোকে সন্তানদের গড়ে তোলা না গেলে কারণে-অকারণে সে সুযোগ হয়ে ওঠে না। বিখ্যাত দার্শনিক ও কবি আল্লামা ইকবাল (রহ.) মক্তব সম্পর্কে কবিতা লিখেছেন। যার সারমর্ম হলো, যদি এ মক্তব-মাদ্রাসা না থাকত, তাহলে মুসলমানের সন্তানরা নৈতিকতা হারিয়ে ইহুদি-খ্রিষ্টানের অন্ধ অনুসরণে নিজেদের পরিচয়টুকুও হারিয়ে ফেলত। মুছে যেত মুসলমানের আদর্শ, স্বকীয়তা ও আত্মগৌরব।
মক্তবে পড়ার সুফল : সকালের মক্তবে যারা পড়েছে, তাদের সহজে কেউ ঈমানহারা করতে পারে না। শিশুর মন নরম কাদামাটির মতো। এ হৃদয়ে যখন সে গেঁথে নিয়েছে ‘আমানতু বিল্লাহি কামাহুয়া’ ও ‘আমানতু বিল্লাহি ওয়া মালাইকাতিহি’, তখন তার হৃদয়টা শক্ত ঈমানে বেষ্টিত হয়েছে। লোভ-লালসা কিংবা দুনিয়াবি কোনো কারণে ফরজ বিধানগুলো সাময়িক ছেড়ে দিতে পারে, কিন্তু ঈমান কখনও ছাড়বে না। একটি পরিসংখ্যানে ফুটে উঠেছে, বিশ্বের আধুনিক দেশগুলোতে লক্ষ করলে দেখা যায়, যেকোনো ধর্মের হোক, অনায়াসে নাস্তিকদের দল বড় হচ্ছে; ধর্ম থেকে সরে আসছে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। কারণ, হিসেবে উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশে মক্তবের তখনকার সময়ে গুরুত্ব ছিল, নিকট-অতীতেও বাংলার প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় মক্তবের ব্যাপক চর্চা ছিল। বাংলার পথেঘাটে ভোরের পাখিদের সঙ্গে মক্তবগামী কোরআনের পাখিদের দেখা মিলত। আর এটাই মক্তবের সফলতা। বাঙালি মুসলমানের ঈমান ও আমল আজও মক্তবের শিক্ষাকে ধারণ করে পরিচালিত হয়। তাই দেশে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যতই বৃদ্ধি পাক, মক্তবের আবেদন কখনও ম্লান হবে না। মক্তব সবার জন্য এবং সব সময়ের জন্য জরুরি।
মক্তব নিয়ে ষড়যন্ত্র চলমান : দিন দিন মক্তবে শিক্ষার্থী কমছে। ১৯৯৫ সালে মহল্লার প্রতিটি ঘর থেকে মক্তবে পড়তে যেত শিশুরা। ২০০৫ সালেও এ ধারা অব্যাহত ছিল। এক জরিপে দেখা যায়, ২০০৫ সালে যে মক্তবে ১০০ শিক্ষার্থী ছিল, বর্তমানে সেই মক্তব চলে ২০ জন শিক্ষার্থী দিয়ে। তাও মাঝেমধ্যে বন্ধ থাকে, বিকেলবেলা শিক্ষার্থীরা আসে, ভোরবেলায় এক্সামণ্ডপ্রাইভেট অথবা ঘুমের টাইম। যে ক’জন শিক্ষার্থী ভোরবেলা আসে, পারিবারিকভাবে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, যৌথ পরিবার, বয়োবৃদ্ধ দাদা-দাদি পরিবারে আছে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী এমন পরিবারের সন্তানরাই আসে। অথচ মহল্লায় বসতি বেড়েছে, মুসলিম শিশুসংখ্যা বেড়েছে, শিক্ষার্থী কমেছে। কারণ খুঁজলে দেখা যায়, মক্তবের গলার কাঁটা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেগুলো প্রথমে মর্নিং স্কুলের বেশে এ দেশে প্রবেশ করেছে।
সচেতনতা ও সতর্কতা প্রয়োজন : সমাজে মসজিদভিত্তিক মক্তবের গুরুত্ব বাড়াতে হবে। মক্তবের ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিশুদের ঈমান শেখানোর জন্য, ধর্মের প্রাথমিক জ্ঞানদানের জন্য ভোরবেলা ফ্রি টাইম বের করতে হবে। ‘স্কুল শেষ হলে’ উপযুক্ত সময়ে শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আজকাল দেশের বিভিন্ন শহরে ‘আফটার স্কুল মক্তব’ চালু হয়েছে। যারা সকালের মক্তবে বাচ্চাদের দিতে পারেন না, খোঁজ নিয়ে বিকেলবেলা এসব মক্তবে হলেও শিশুর ধর্মের মৌলিক শিক্ষা তাদের নিশ্চিত করা কর্তব্য।