বিয়ে একটি বৈধ সম্পর্ক। বিয়ের মাধ্যমে সমাজে সুশৃঙ্খল পরিবেশ ও শালীন সভ্যতা গড়ে ওঠে। অশ্লীলতা ও বেয়াপনার সয়লাব রোধে বিয়ে কার্যকরী মাধ্যম। বিয়ে নারী-পুরুষের শারীরিক সম্পর্কের একটি বৈধ প্রক্রিয়া বা ধর্মসম্মত চুক্তি। এ পবিত্র সম্পর্ক স্থাপন করতে এবং এর দাবি ও আবেদন বজায় রাখতে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। যা ধর্মীয় বৈবাহিক রীতি হিসেবে প্রচলিত। ধর্মীয় রীতি উপেক্ষা করে বিয়ে করা হলে তা রাষ্ট্রীয় আইনে বৈধ হলেও ধর্মীয় আইনে বৈধ নয়। বিয়ে যেহেতু একটি ধর্মীয় বিষয়, তাই এখানে চাপিয়ে দেয়া কোনো সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাচারিতামূলক আইন দিয়ে ধর্মের মূল ও মৌলিক বিধানকে উপেক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। তাদের ধর্ম ইসলাম। সঙ্গত কারণেই এ দেশে মুসলিমদের বিয়েশাদিতে মুসলিম আইন যথাযথ প্রয়োগ হবে, এটাই বাস্তবসম্মত কথা এবং ধর্মীয় ও সাংবিধানিক রীতি। একজন মুসলিম পুরুষ অপর একজন মুসলিম নারীকে বিয়ে করতে হবে। এমনিভাবে একজন মুসলিম নারী অপর একজন মুসলিম পুরুষকেই বিয়ে করতে হবে। কোনো মুসলিম পুরুষ নিজ ধর্মে থেকে অপর কোনো হিন্দু বা খ্রিষ্টান নারীকে তার স্বধর্মে রেখে বিয়ে করলে ইসলামি আইনমতে তা শুদ্ধ নয়। হিন্দু ও মুসলিম নিজ নিজ ধর্মে থেকে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করলে ইসলামি বিধানমতে এ সম্পর্ক জিনার সম্পর্কে পরিণত হবে।
হিন্দু ও মুসলিম নিজ নিজ ধর্মে থেকে বিয়ে করাকে আজকাল প্রগতিশীলরা অসাম্প্রদায়িকতা চর্চা বা ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে থাকে। ধর্মকে ছাপিয়ে ব্যক্তির খেয়ালখুশিকে প্রাধান্য দিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিয়ের একটি সরব প্রচারণা এরই মধ্যে চলছে বাঙালি সভ্যতায়। এটা মূলত সভ্যতার উন্নতি নয়, সভ্যতার হীনতা ও উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিজীবনের প্রতিচ্ছবি। মানুষ যাদের বিনোদনশিল্পী হিসেবে গ্রহণ করে; যারা শোবিজ জগতের মানুষ হিসেবে পরিচিত, তুলনামূলক তাদের মধ্যে অনেকের বৈবাহিক জীবন আন্তঃধর্মীয় বৈবাহিক জীবন। স্বামী মুসলিম, বউ হিন্দু বা বউ মুসলিম, স্বামী হিন্দু- এমন প্রথা বেশ ব্যাপকতা লাভ করেছে। এ প্রথা ভারত ও বাংলাদেশের শোবিজপাড়ায় খুব আড়ম্বরপূর্ণভাবে গৃহীত হয়। ২৭ জুন ২০২৪ তারিখে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে একটি নিবন্ধে লেখা হলো, ‘বলিউডের অভিনেত্রী সোনাক্ষী সিনহার বিয়ে হলো অভিনেতা জহির ইকবাল রতনসির সঙ্গে। সোনাক্ষী হিন্দু, জহির মুসলমান; কিন্তু তাদের বিয়ে হিন্দুরীতিতে হয়নি; মুসলিম রীতিতেও হয়নি। হয়েছে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট বা বিশেষ বিয়ে আইন নামক আইনের অধীনে। ‘বিশেষ বিয়ে আইন’ ইংরেজরা প্রথম তৈরি করেছিল ১৮৭২ সালে। ভিন্ন জাতের এবং ভিন্ন ধর্মের মানুষরা পরস্পরকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চাইলে এ আইনের আশ্রয় নিয়ে যেন নির্বিঘ্নে বিয়ে করতে পারে। আইনটিতে বিয়ে নিবন্ধিত করার শর্তজুড়ে দিয়ে ১৯৫৪ সালে কিছুটা সংশোধন করা হয়েছে। এ আইনে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলমান, জৈন, শিখ, পার্সি, ইহুদি- যে কারও সঙ্গে যে কারও বিয়ে হতে পারে এবং সে বিয়েতে কোনো ধর্ম ও ধর্মীয় রীতির উপস্থিতি জরুরি নয়। বিয়ের পাত্রপাত্রীকে একই ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার প্রয়োজন নেই। যার যার ধর্মবিশ্বাস তার তার থেকে যায়। বিয়ের কারণে সোনাক্ষী এবং জহির কাউকেই তাদের ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তন করতে হয়নি। জহিরের যদি নামাজ-রোজা করতে ইচ্ছে হয় করবে। আর সোনাক্ষীর যদি পুজো করতে ইচ্ছে হয় করবে। একই বাড়িতে দু’ধর্মই পালিত হবে। কেউ কাউকে স্বধর্ম পালনে বাধা দেবে না। শাহরুখ খানের বাড়িতে তো এমনই হয়। তার বাড়ি মান্নাতে গণেশ আর লক্ষ্মী মূর্তি আছে। কোরআনও আছে একই বাড়িতে। পুত্র আরিয়ান ভালো গায়ত্রী মন্ত্র জানে। মান্নাতে ঘটা করে দেওয়ালি পালন করা হয়, ঘটা করে ঈদও পালিত হয়। শাহরুখ আর গৌরির সন্তানরা হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্ম সম্পর্কেই জানে। দুই ধর্মই পালন করে। নিবন্ধের সবশেষে আবেদন রাখা হয়েছে, ‘হিন্দু-মুসলমানে যত বেশি বিয়ে হবে, সমাজ তত বেশি অসাম্প্রদায়িক হবে।’
আবেগ নয়, বিবেকের সচেতনতা আবশ্যক : প্রশ্ন হলো, অসাম্প্রদায়িক হওয়ার জন্য ধর্মহীন একটি প্রজন্ম গড়ে তোলার চেষ্টা সর্বদা অব্যাহত আছে; কিন্তু এর দ্বারা কি প্রকৃত অর্থে সাম্যমৈত্রী-সম্প্রীতি তৈরি হয়েছে? হবে কখনও? মোটেই নয়; বরং সমাজে বিশৃঙ্খলা ও ব্যক্তিস্বেচ্ছাচারিতা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে; যা একটি সভ্য সমাজের স্থিতিকে বিনষ্ট করবে। মানুষের ধর্মীয় চেতনা ও আত্মশুদ্ধির প্রেরণাকে শিথিল ও মন্তপ্রায় করে তুলবে। যা কালক্রমে সামাজিক অবক্ষয়ের রূপ ধারণ করবে। বিচক্ষণ ব্যক্তিমাত্রই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে, ধর্মচর্চা ছাড়া কোনো কালেই সুস্থ সভ্যতা, মানবতা ও মনুষ্যত্ববোধের বিকাশ ঘটেনি, ঘটবেও না। হিন্দু-মুসলিম বিয়ে ইসলামি সভ্যতায় অনুমোদিত নয়। কোনো মুসলমান অমুসলিমকে বিয়ে করতে চাইলে অমুসলিমকে আগে মুসলিম হতে হবে। এটা অমুসলিমের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার। এতে শিরক থেকে মুক্ত হয়ে চির শান্তির ধর্ম ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে তার। কিন্তু বিষয়টি যদি উল্টো হয়, একজন মুসলিম মেয়ে হিন্দু ছেলেকে বা একজন মুসলিম ছেলে হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করার জন্য নিজের ধর্ম ত্যাগ করে, এটা তার জন্য বড় হতভাগ্যের বিষয়। ভালোলাগা আর ভালোবাসার দোহাই দিয়ে ইসলাম ত্যাগ করে বা নিজ ধর্মে থেকে অন্য ধর্মের অনুসারীর সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে বিরত থাকা একজন মুসলিমের অবশ্যই ধর্মীয় ও বিবেকপ্রসূত সিদ্ধান্ত। অমুসলিমকে তার নিজ ধর্মে বহাল রেখে কোনো মুসলিম তাকে বিয়ে করতে পারে না।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা মুশরিক নারীদের বিয়ে করো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। নিঃসন্দেহে একজন মোমিন দাসী যে কোনো মুশরিক নারীর চেয়ে অনেক উত্তম। যদিও এ মুশরিক নারীকে তোমাদের বেশি ভালো লাগে। আর তোমরা (তোমাদের নারীদের) মুশরিক পুরুষদের কাছে বিয়ে দিও না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। নিঃসন্দেহে একজন মোমিন দাস যে কোনো মুশরিক পুরুষের চেয়ে অনেক উত্তম। যদিও সেই মুশরিক পুরুষকে তোমাদের বেশি ভালো লাগে। কারণ, তারা (মুশরিকরা) সকলে তো জাহান্নামের দিকে ডাকে আর আল্লাহ তার বিধানের মাধ্যমে জান্নাত ও মাগফিরাতের দিকে আহ্বান করেন। তিনি তার আয়াতগুলো মানুষের উপকারার্থে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন; যাতে তারা তা অনুসরণ করতে পারে।’ (সুরা বাকারা : ২২১)।
আইনের আড়ালে ধর্ম অস্বীকার : বিশেষ বিয়ে আইন ১৯৫৪ হলো ভারতীয় সংসদের একটি আইন। ভারতের জনগণের জন্য এবং বিদেশে বসবাসকারী সব ভারতীয় নাগরিকের জন্য বিয়ের বিশেষ রূপ দিতে এ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। উভয় পক্ষের ধর্ম বা বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন, এ আইনের দ্বারা বিয়ে করলে, সেগুলো কোনো বাধা হয় না। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে একটি আইন প্রস্তাবিত হয়েছিল। তারই একটি অংশ থেকে এ আইনটি উদ্ভুত হয়েছে। বিশেষ বিয়ে আইনের অধীনে বৈধ বিয়ে ব্যক্তিগত আইন দ্বারা শাসিত হয় না। ‘বিশেষ বিয়ে আইনে’ হিন্দু-মুসলিম বিয়ে করার ঘটনা বাড়ছে। এ বিয়েতে বর-কনে নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় বা নাম পরিবর্তন না করে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। শুধু ভিন্ন ধর্মীয় নয়, দুজন মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসী কিংবা হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীরাও এ আইনে বিয়ে করছেন। যাকে তারা বলছেন প্রচলিত ধর্মমতের বাইরে বিয়ে। বিয়ের ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাস কোনো বাধা না হওয়ায় তরুণ-তরুণীরা ধর্ম ও নাম পরিবর্তন না করে দুজন ভিন্ন ধর্মের প্রাপ্তবয়স্ক যে কেউ বিশেষ বিয়ে আইন ১৮৭২ (সংশোধিত ২০০৭) অনুযায়ী বিয়ে করতে পারে। আইনের ৪ ধারায় বলা আছে, বিয়ের জন্য প্রথমে বিশেষ বিয়ে নিবন্ধকের কাছে গিয়ে যে কোনো এক পক্ষ অপর পক্ষের কাছে বিয়ের জন্য লিখিত নোটিশ পাঠাবে।
এ নোটিশ দেয়ার ১৪ দিন পর বিয়ে সম্পাদন করতে হবে। এক পক্ষ নিবন্ধকের মাধ্যমে বিয়ের ১৪ দিন আগে অপর পক্ষকে নোটিশ না পাঠালে বিয়ে করা যাবে না। যদি ১৪ দিনের মধ্যে কেউ আপত্তি করে, তবে বিয়ে সম্পন্ন করা যাবে না। এর ১১ ধারায় বলা আছে, বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে রেজিস্ট্রার এবং ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদানকারী তিনজন সাক্ষীর সামনে। এরপর এ আইনের অধীনে অনুষ্ঠিত বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয়। এ বিয়ের জন্য ছেলেমেয়ে উভয়কে একটা হলফনামা দিতে হয়, তারা কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন না। এ হলফনামাটি নোটারি পাবলিক দিয়ে সত্যায়িত করে স্পেশাল ম্যারিজ রেজিস্ট্রারের কাছে যেতে হয়। এ বিয়ের ফলে স্বামী-স্ত্রী যে যার ধর্ম পালন করতে পারবে। কাউকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা যাবে না। সুতরাং নিজ নিজ ধর্মে বহাল থেকে হিন্দু মুসলিম পরস্পরে বিয়ে করতে হলে আগে ধর্মকে অস্বীকার করতে হয়। ধর্ম অস্বীকার করাকে ধর্মহীনতা বা নাস্তিকতা বলে। যার পরিণাম দুনিয়া ও আখেরাতে শোচনীয়।
ঈমানের স্বাদ পাবে যারা : ঈমানের স্বাদ সবাই পায় না। ঈমানের স্বাদ পেতে কিছু বৈশিষ্ট্য হাসিল করতে হয়। আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘ যার মাঝে তিনটি গুণ থাকবে, সে ঈমানের স্বাদ পাবে- এক. আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল (সা.) যার কাছে সবকিছু থেকে অধিক প্রিয় হবে, দুই. যে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই কোনো বান্দাকে মহব্বত করবে, তিন. কুফর থেকে আল্লাহ মুক্তি দেয়ার পর যে কুফরে ফিরে যাওয়াকে এমন অপছন্দ করবে, যেমন আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করে।’ (বোখারি : ২১, মুসলিম : ৪৩)। হাদিসের ভাষ্যমতে, কোনো ঈমানদার লোক কখনও নিজ ধর্ম ত্যাগ করতে পারে না।