রাসুলুল্লাহ (সা.) এর স্বাভাবিক জীবনধারা হলো সুন্নাহ, যা মূলত কোরআনেরই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। সাহাবিরা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সুন্নাহ পালন করতেন। ফলে তারা সুন্নাহ অনুসরণের মাপকাঠিতে পরিণত হয়েছেন। তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট এবং আল্লাহও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। সুন্নাহ ও সাহাবিদের জামাতকে অনুসরণকারীরাই পরকালে জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত দল ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত’।
সুন্নাহ পরিচিতি : সুন্নাহ অর্থ স্বভাব, পদ্ধতি, রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার, অভ্যাস, চিরন্তন নিয়ম (tradition) ইত্যাদি। পরিভাষায় যে পন্থা ও রীতিনীতি রাসুলুল্লাহ (সা.) অবলম্বন করতেন তাই সুন্নাহ। মূলত রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অনুপম আদর্শ ও আচার-আচরণই সুন্নাহ নামে পরিচিত। (ইমাম রাগিব আল-ইস্পাহানি, আল-মুফরাদাত, পৃ. ২৪৫)। অনুরূপভাবে সাহাবি, তাবিঈ ও তাবে-তাবিঈদের আচার ও ফতোয়াকেও সুন্নাহ বলে অভিহিত করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের ওপর অবশ্য পালনীয় হলো আমার সুন্নাহ ও সুপথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নাহ।’ (তিরমিজি : ২৬৭৬; আবু দাউদ : ৪৬০৯)। মোটকথা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর শাশ্বত নির্দেশনা, আমল এবং আকাক্সক্ষা যেগুলো সাহাবায়ে কেরাম পালন করেছেন এবং বাস্তবায়ন করেছেন সেগুলোই সুন্নাহ।
সুন্নাহর গুরুত্ব : সুন্নাহর গুরুত্ব অপরিসীম। কোরআনের মতো সুন্নাহও আল্লাহর ওহি। দুটোই জিবরাইল (আ.) এর মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়েছে। কোরআন মাতলু (পঠিত) ওহি আর সুন্নাহ গায়রে মাতলু (অপঠিত) ওহি। রাসুলুল্লাহ (সা.) যে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন মানব জাতিকে উপহার দিয়েছেন সুন্নাহ তারই বহিঃপ্রকাশ। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব (কোরআন) ও হিকমাত (সুন্নাহ) নাজিল করেছেন।’ (সুরা নিসা, ৪ : ১১৩)। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জেনে রেখো, নিশ্চয়ই আমাকে কোরআন ও তার সঙ্গে অনুরূপ বিষয় (সুন্নাহ) দান করা হয়েছে।’ (আবু দাউদ : ৪৬০৬)।
সুন্নাহর অনুসরণ : রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বদা ‘সুন্নাহ’ অনুসরণের কথা বলেছেন। যেমন
এক. ইরবায ইব্ন সারিয়া (রা.) বলেন, ‘একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের নিয়ে নামাজ পড়ালেন অতঃপর আমাদের দিকে মুখ ফিরে বসলেন এবং এক মর্মস্পর্শী উপদেশ প্রদান করলেন, যাতে আমাদের চোখগুলো অশ্রুসিক্ত হলো এবং অন্তরগুলো বিগলিত হলো। এক ব্যক্তি বলে উঠল, হে আল্লাহর রাসুল! মনে হয় এটি বিদায়ী উপদেশ। তখন তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের তাকওয়া তথা আল্লাহকে ভয় করার উপদেশ প্রদান করছি এবং আমিরের কথা শুনতে ও তার আনুগত্য করতে বলছি, যদিও তিনি হাবশি দাস হন। আমার পর তোমাদের মধ্যে যে বেঁচে থাকবে, সে অচিরেই অনেক মতনৈক্য দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাহ এবং সৎপথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশিদিনের সুন্নাহ আঁকড়ে ধরবে। আর তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে নতুন মতবাদ থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ, প্রত্যেক নতুন সৃষ্টি বিদাত এবং প্রত্যেক বিদাতই পথভ্রষ্টতা।’ (তিরমিজি : ২৬৭৬; আবু দাউদ : ৪৬০৯; ইবনে মাজাহ : ৪২)।
দুই. আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেছেন, ‘হে প্রিয় বৎস! যদি তুমি এভাবে সকাল ও সন্ধ্যা করতে পার যে, তোমার অন্তরে কারও জন্য কোনো হিংসা নেই, তাহলে তা করো। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, হে প্রিয় বৎস! তা আমার সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। যে আমার সুন্নাহকে মহব্বত করল, সে আমাকে মহব্বত করল। আর যে আমাকে মহব্বত করল সে আমার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে।’ (তিরমিজি : ২৬৭৮)।
তিন. মালেক (রহ.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মধ্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত তা ধরে রাখবে পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।’ (মুয়াত্তায়ে মালেক : ৩৩৩৮)।
চার. আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল খাবে এবং সুন্নাহর ওপর আমল করবে, আর মানুষ যার ক্ষতি থেকে নিরাপদে থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (তিরমিজি : ২৫২০)।
পাঁচ. আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) এর একদল সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর স্ত্রীদের তাঁর গোপনে আমলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। অতঃপর কেউ বলল, আমি নারীদের বিয়ে করব না। কেউ বলল, আমি আর গোশত খাব না। কেউ বলল, আমি আর বিছানায় ঘুমাব না। অতঃপর তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং তাঁর গুণাগুণ বর্ণনা করলেন আর বললেন, ‘মানুষের কি হলো তারা এমন এমন বলে। অথচ আমি নামাজ পড়ি এবং ঘুমাই। রোজা রাখি এবং ছেড়ে দেই। আর আমি নারীদের বিয়েও করি। যে আমার সুন্নাহ থেকে বিমুখ হবে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (মুসলিম : ৩৪৬৯)। এছাড়া আরও অনেক হাদিসেই সুন্নাহর অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। কোথাও হাদিস অনুসরণের কথা বলা হয়নি। কাজেই হাদিস সহিহ হলেই সেটি আমলযোগ্য হবে বিষয়টি এমন নয়।
হাদিস ও সুন্নাহ : উম্মতের জন্য দ্বীনের ওপর চলার অনুসরণীয় পথ হলো সুন্নাহ। অন্যদিকে নবী (সা.) যা কিছু বলেছেন, করেছেন এবং বলার বা করার অনুমতি দিয়েছেন অথবা সমর্থন জানিয়েছেন তাকে হাদিস বলা হয়। মুহাদ্দিসরা এর সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কিত বর্ণনা ও তার গুণাবলি সম্পর্কিত বিবরণকেও হাদিসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। মোটকথা হাদিস হলো নবী (সা.) এর পুরো জীবনের (ৎবপড়ৎফ) লেখ্য নথি। কাজেই সব সুন্নাহ হাদিস হলেও সব হাদিস সুন্নাহ নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় এক. ইসলামের প্রথম যুগের কিছু বিধান পরবর্তী সময়ে রহিত হয়েছে। রহিত বিধান সংবলিত হাদিসগুলো সহিহ হওয়ার পরও তা আমলযোগ্য নয়। যেমন নামাজরত অবস্থায় কথা বলা, সালাম দেওয়া, সালামের উত্তর দেওয়া সংক্রান্ত হাদিস (দ্র. বোখারি : ১১৪১), আগুনে রান্নাকৃত খাবার খেলে অজু ভেঙে যাওয়ার বিধান সংবলিত হাদিস (দ্র. বোখারি : ২০৫) এবং হিজরতের পর মদিনায় ১৬-১৭ মাস বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করার হাদিস (দ্র. বোখারি : ৬৮২৫)। এসব হাদিসের বিধান রহিত হয়ে যাওয়ার কারণে উম্মতের জন্য এখন আর অনুসরণীয় নয়। কাজেই এগুলো সহিহ হাদিস হওয়ার পরও সুন্নাহ নয়।
দুই. এমন অনেক হাদিস আছে যার বিধান নবী (সা.) এর জন্য নির্ধারিত। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর চারের অধিক বিয়ের প্রসঙ্গ সংবলিত হাদিস। এগুলো সহিহ হাদিসে বর্ণিত হলেও সুন্নাহ নয়।
তিন. হাদিসে এমন অনেক আমলের কথা বর্ণিত আছে, যেগুলো রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনও কোনো বিশেষ প্রয়োজনে করেছেন। যেমন কোমরে ব্যথা থাকার কারণে কিংবা এস্তেঞ্জা করার স্থানে বসার কারণে শরীরে বা কাপড়ে নাপাকি লেগে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি সারা জীবনে মাত্র দুইবার দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করেছেন। কিন্তু হাদিসের বর্ণনায় এসব কারণের কথা উল্লেখ না করে শুধু দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার কথা বর্ণিত হয়েছে। এ হাদিসের ওপর আমল করে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করাকে সুন্নাহ বলা যাবে না। কারণ অন্য হাদিসে আয়েশা (রা.) নবী (সা.) এর চিরায়ত আমল উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, যে বলবে, নবী (সা.) দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করেছেন, তোমরা বিশ্বাস করবে না। তিনি বসেই প্রস্রাব করতেন। (তিরমিজি : ১২)।
চার. কাজের বৈধতা বোঝানোর জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) কিছু কাজ করেছেন। যেমন তিনি একবার তার নাতনি উমামা বিনতে জয়নবকে কোলে নিয়ে নামাজ পড়িয়েছেন। (বোখারি : ৪৯৪)। আবার তিনি রোজা অবস্থায় কোনো এক স্ত্রীকে চুম্বন করেছেন। (বোখারি : ১৮২৬)। এসব ঘটনা সহিহ হাদিসে এসেছে। তাই বলে সব সময় শিশু কোলে নিয়ে নামাজ পড়া বা পড়ানো অথবা রোজা অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন করা সুন্নাহ নয়। তবে অনাকাক্সিক্ষতভাবে ঘটে গেলে নামাজ বা রোজা হয়ে যাবে।
৫. সুন্নাহ নির্ণয়ের পথ : সুন্নাহ নির্ণয়ের পথ হলো সাহাবিদের আমল। হাদিসের ওপর তাদের আমলের প্রমাণ পাওয়া গেলে সেটি সুন্নাহ। তারা কোনো হাদিসের ওপর আমল না করার ব্যাপারে একমত হলে সেটি সুন্নাহ নয়। আল্লাহ বলেন, ‘মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে প্রথম অগ্রবর্তী দল এবং যারা নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, সেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে। এটাই মহাসাফল্য।’ (সুরা তাওবা : ১০০)। সাহাবিদের ঈমান ও আমলের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের বলা হয়, যেসব লোক ঈমান এনেছে, তোমরাও তাদের মতো ঈমান আনো, তারা বলে, নির্বোধরা যেভাবে ঈমান এনেছে আমরাও কি সেরূপ ঈমান আনব? সাবধান! এরাই নির্বেধা; কিন্তু তারা জানে না।’ (সুরা বাকারা : ১৩)। এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, ‘ইমামরা এবং হাদিস বিশারদ ফকিহরা সহিহ হাদিসের ওপর তখনই আমল করেন যখন কোনো সাহাবি, তাবেয়ি অথবা তাদের নির্দিষ্ট কোনো একটি দল থেকে হাদিসটির ওপর আমলের প্রমাণ পাওয়া যায়। আর সাহাবিরা যে হাদিসের ওপর আমল না করার ব্যাপারে একমত হয়েছেন তার ওপর আমল করা বৈধ নয়; কারণ তারা সেটা জেনেই হাদিসটি ছেড়ে দিয়েছেন।’
৬. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত : হাদিসে বলা হয়েছে আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বনি ইসরাইলের যা হয়েছিল আমার উম্মতেরও তাই হবে। যেমন এক পায়ের জুতা অন্য পায়ের জুতার সমান হয়। এমনকি যদি তাদের মধ্যে কেউ তার মায়ের সঙ্গে প্রকাশ্যে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তবে আমার উম্মতের মধ্যেও এরূপ লোক হবে। এছাড়া বনি ইসরাইল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল, আর আমার উম্মত তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। একদল ছাড়া তাদের সবাই জাহান্নামে যাবে। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, তারা কারা হবে? রাসুলুল্লাহ (সা). বললেন, আমি এবং আমার সাহাবারা যে মতাদর্শের ওপর রয়েছি যারা তার ওপর থাকবে।’ (তিরমিজি : ২৬৪১)। বোঝা যায়, সুন্নাহ ও সাহাবিদের জামাতকে অনুসরণকারীরাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত এবং তারাই পরকালে জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত দল। কাজেই বিদাত পরিহার করে যথাযথভাবে সুন্নাহ ও সাহাবাদের জামাতকে অনুসরণ করার মাধ্যমে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়