ঢাকা সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইতিহাস

মুঘল শাসনামলে মুসলিম স্থাপত্য

মাহবুবুর রহমান
মুঘল শাসনামলে মুসলিম স্থাপত্য

মুঘল সাম্রাজ্য (১৫২৬-১৮৫৭) ভারতীয় উপমহাদেশে স্থাপত্যশৈলীর এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। এই শাসনামলে মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। পারস্য, মধ্য এশিয়া এবং ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে যে অসাধারণ রূপটি গড়ে ওঠে, তা আজও বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করে। মুঘল স্থাপত্য শুধু নান্দনিকতার প্রতীক নয়, বরং রাজকীয় শক্তি, ধর্মীয় আবেগ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ।

মুঘল স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য : মুঘল স্থাপত্যশিল্পের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো:

১. মিনার ও গম্বুজের ব্যবহার মুঘল স্থাপত্যে মিনার এবং গম্বুজের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গম্বুজ : এটি ইসলামের আধ্যাত্মিকতা এবং আকাশের সাথে সংযোগের প্রতীক। হুমায়ুনের সমাধি, তাজমহল, এবং জামে মসজিদে এই গম্বুজের সৌন্দর্য স্পষ্ট। গম্বুজের সাথে ইসলামের সম্পর্ক অনেক বেশি। গম্বুজের প্রচলন প্রাচীন আমল থেকেই চলে আসছিল। ইসলামে এটির পরিপূর্ণতা ঘটে। যুগে যুগে মুসলিম শাসনামলে মসজিদের সৌন্দর্য বর্ধক হিসাবে গম্বুজের ব্যবহার অতি লক্ষণীয়।

মিনার : মসজিদ এবং প্রাসাদে মিনারগুলো ধর্মীয় বিশ্বাস এবং শক্তিমত্তার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, দিল্লির কুতুব মিনার মুঘল স্থাপত্যের অনুপ্রেরণায় গড়ে ওঠা অন্যতম নিদর্শন। মুঘল শাসনামলে বড় বড় সব মসজিদে মিনারের ব্যবহার পরিলক্ষিত হতো। এমন কোন বৃহৎ মসজিদ হতো না যেখানে তার সুন্দর মিনার থাকত না। মসজিদ এবং মিনারের ব্যবহার একসাথে ফুটে উঠেছে।

২. চাহার বাগ নকশা (চার বাগানের বিন্যাস) : পারস্য থেকে প্রভাবিত এই নকশায় স্থাপনাগুলোকে চারদিকে বাগান দিয়ে ঘেরা হতো। স্থাপত্যগুলো ঘেরার জন্য চারদিকে বাগান স্থাপন করা হতো। যা স্থাপত্যকে রক্ষা করার পাশাপাশি সৌন্দর্যকে হাজার গুণ বৃদ্ধি করত। উদাহরণ: হুমায়ুনের সমাধি এবং তাজমহল। চাহার বাগ নকশা প্রকৃতির সাথে স্থাপনার একত্ব বোঝায় এবং মুঘলদের শিল্পকর্মে সামঞ্জস্যের প্রতি ঝোঁক প্রকাশ করে। তাজমহলের সুন্দর বিশ্ববাসীর কাছে নতুন কিছু নয়। তাজমহলের সৌন্দর্যকে তার চারিপাশের বাগান সৌন্দর্যমন্ডিত ও শোভা বর্ধিত করেছে।

৩. সিমেট্রি এবং জ্যামিতিক সৌন্দর্য : মুঘল স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল স্থাপনাগুলোর নিখুঁত সিমেট্রি। প্রতিটি দিক, প্রতিটি গম্বুজ এবং প্রবেশপথে নিখুঁত সমন্বয় দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তাজমহলের প্রতিটি অংশ সিমেট্রিকভাবে ডিজাইন করা। এ যেন শিল্পীর হাতে অংকের খেলা। তারা এমনভাবে স্থাপত্য নির্মাণ করত, যা গণিতের সূত্রে এমন গাঁথা হত, যেন কোথাও এক সুতো হের ফের না হয়।

৪. লাল বেলেপাথর এবং সাদা মার্বেলের ব্যবহার : মুঘল স্থাপত্যের শুরুর দিকে (আকবরের আমলে) লাল বেলেপাথর বেশি ব্যবহৃত হতো। যেমন, ফতেহপুর সিক্রি। পরবর্তী সময় (শাহজাহানের আমলে) মার্বেলের ব্যবহার বেশি দেখা যায়, যা মুঘল স্থাপত্যে এক রাজকীয় বৈশিষ্ট্য যোগ করে।

৫. অলংকরণ ও খোদাই কাজ : মুঘল স্থাপত্যের দেয়াল এবং স্তম্ভগুলোতে ফুল-লতার নকশা, জ্যামিতিক মোটিফ এবং কোরআনের আয়াত খোদাই করা হতো। যেমন- তাজমহলের দেয়ালে মার্বেল খোদাই এবং হুমায়ুনের সমাধির ভেতরের অলংকরণ।

৬. মিশ্র স্থাপত্য রীতি : মুঘল স্থাপত্যে পারস্য, ইসলামি, তুর্কি এবং ভারতীয় রীতির অপূর্ব মিশ্রণ দেখা যায়। যেমন- ফতেহপুর সিক্রির দেওয়ান-ই-খাস এবং বুলন্দ দরওয়াজায় রাজস্থানি ও ইসলামিক স্থাপত্যের সমন্বয়।

নিখিল ভারতে মুঘল স্থাপত্য :

১. তাজমহল (১৬৩২-১৬৪৮) : শাহজাহানের প্রিয় স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত তাজমহল, মুঘল স্থাপত্যের সর্বোচ্চ নিদর্শন। এটি সম্পূর্ণ মার্বেলে তৈরি এবং চাহার বাগ নকশায় পরিকল্পিত। গম্বুজের উচ্চতা ৭৩ মিটার। এর অলংকরণ খুবই চমৎকার। মার্বেল পাথরের মধ্যে খচিত রয়েছে ফুল-লতার নকশা এবং কোরআনের আয়াত। এটি ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

২. ফতেহপুর সিক্রি (১৫৭১-১৫৮৫) : সম্রাট আকবরের রাজধানী ফতেহপুর সিক্রি একটি পরিকল্পিত শহর। বুলন্দ দরওয়াজা : বিজয়ের প্রতীক। দেওয়ান-ই-আম ও দেওয়ান-ই-খাস : শাসন কার্য পরিচালনার স্থান। জামে মসজিদ : রাজকীয় মসজিদ। ফতেহপুর সিক্রিতে ভারতীয় এবং ইসলামিক স্থাপত্যের নিখুঁত মিশ্রণ দেখা যায়।

৩. হুমায়ুনের সমাধি (১৫৬৫) : সম্রাট আকবরের নির্দেশে নির্মিত এই সমাধি মুঘল স্থাপত্যের প্রথম চাহার বাগ শৈলীর উদাহরণ। এটি তাজমহলের প্রভাবশালী পূর্বসূরি। পুরো স্থাপনাটি লাল বেলেপাথর এবং সাদা মার্বেলের মিশ্রণে তৈরি।

৪. আগ্রা দুর্গ (১৫৬৫-১৫৭৩) : আকবরের সময়ে নির্মিত এই দুর্গটি ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তি এবং প্রশাসনিক কেন্দ্র। দুর্গের ভেতরে রয়েছে জাহাঙ্গির মহল এবং খাস মহল। লাল বেলেপাথর ব্যবহার করে এটি নির্মাণ করা হয়েছে।

৫. জামে মসজিদ (১৬৫৬) : দিল্লির পুরানি দিল্লিতে অবস্থিত এই মসজিদ মুঘল সাম্রাজ্যের বৃহত্তম মসজিদ। এতে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারে। এটি মার্বেল এবং লাল বেলেপাথরে তৈরি।

মুঘল স্থাপত্যের প্রভাব ও গুরুত্ব : ইসলামের ইতিহাসে মুঘল স্থাপত্য এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। ১৫২৬ সালে বাবরের নেতৃত্বে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ১৮৫৭ সালে এই সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত, মুঘল স্থাপত্য শিল্প এক সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় রূপে গড়ে ওঠে। এটি ভারতীয়, পারস্য, তুর্কি এবং ইসলামি স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে বিশেষভাবে আলোকিত। মুঘল স্থাপত্য ইসলামের সৌন্দর্য, শক্তি এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত।

মুঘল স্থাপত্যের প্রভাব

১. ধর্মীয় স্থাপত্য : মুঘল সাম্রাজ্যে মসজিদ ও মাদরাসার নির্মাণ ইসলামি স্থাপত্যশৈলীর প্রসারের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। উদাহরণস্বরূপ, দিল্লির জামে মসজিদ এবং লাহোরের বাদশাহী মসজিদ।

২. পারস্য ও ভারতীয় ঐতিহ্যের সমন্বয় : মুঘল স্থাপত্যে পারস্যের জাঁকজমক ও ভারতীয় স্থাপত্যের স্থানীয় উপাদান একত্রিত হয়। এই বৈশিষ্ট্য তাজমহলের মতো স্থাপত্যে সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।

৩. বাগান স্থাপত্যের বিকাশ : ‘চারবাগ’ পদ্ধতি (চার ভাগে বিভক্ত বাগান) মুঘল স্থাপত্যে প্রভাবশালী ছিল। এই নকশা পারস্যের প্রভাব বহন করে এবং মুঘল সম্রাটদের রাজকীয় প্রাসাদ ও সমাধি সৌধে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, আগ্রার তাজমহল এবং দিল্লির হুমায়ুনের সমাধি।

৪. অভিজাত প্রাসাদ : রাজকীয় প্রাসাদ যেমন আগ্রা ফোর্ট ও লাল কেল্লা মুঘল স্থাপত্যের শৈল্পিক দক্ষতার উজ্জ্বল উদাহরণ।

৫. ইসলামি ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার : স্থাপত্যে কোরআনের আয়াত এবং আরবি ও ফার্সি লিপি ব্যবহৃত হয়েছে, যা ধর্মীয় ও নান্দনিক গভীরতা যোগ করে।

মুঘল স্থাপত্যের গুরুত্ব

১. ধর্মীয় ঐতিহ্য রক্ষা: মুঘল স্থাপত্য ইসলামের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

২. সাংস্কৃতিক সমন্বয় : মুঘল স্থাপত্য ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানীয় সংস্কৃতি ও ইসলামি ঐতিহ্যের একটি মিলিত প্রতীক।

৩. পর্যটন ও অর্থনীতি : মুঘল স্থাপত্য আজও ভারতের পর্যটন শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাজমহলকে বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

৪. প্রভাবিত ভবিষ্যৎ স্থাপত্য : মুঘল স্থাপত্য পরবর্তী সময়ে ভারতীয় ও ব্রিটিশ স্থাপত্যেও প্রভাব ফেলেছে। মুঘল স্থাপত্য শুধু একটি স্থাপত্যশৈলী নয়, বরং এটি এক গভীর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহন করে, যা ইসলামের সৌন্দর্য এবং ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটায়। সুতরাং, মুঘল শাসনামলের মুসলিম স্থাপত্য শুধু কারিগরি দক্ষতা এবং নান্দনিকতা নয়, এটি শাসকদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতিফলন। এই স্থাপনাগুলো শুধু ঐতিহাসিক নয়, বরং উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মূর্ত প্রতীক।

লেখক : প্রভাষক, রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত