ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সকাল বেলার বরকত

ইবরাহীম আল খলীল
সকাল বেলার বরকত

মহান আল্লাহতায়ালা সময়কে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। রাত ও দিন। এ দিন-রাত আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি। তিনিই এগুলো সৃষ্টি করেছেন এবং পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণও করেন। তার ইচ্ছার বাইরে একটি শুকনো পাতাও গাছ থেকে ঝরে না। সে হিসেবে দিন রাতের বিষয়টি তো আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না। তবুও আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের এক আয়াতে নিজের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে- তিনি সেই সত্তা, যিনি সৃষ্টি করেছেন রাত ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র। (সুরা আম্বিয়া : ৩৩)।

দিন-রাত এই দুটোকে দুই কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। দিনকে কাজ কর্মের জন্য আর রাতকে আরাম বা ঘুমের জন্য। দিনের বেলা জীবিকা অনুসন্ধানের কথা বলা হয়েছে এবং তা ?দিনের শুরুতে সকাল বেলা শুরু করার প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে। কেননা, একজন মোমিন মাত্রই দিনের সূচনা করবে ফজরের নামাজের মাধ্যমে। রবের ইবাদত ও নির্দেশনা পালন করার পর নিজের জীবিকার তালাশে সে জমিনে ছড়িয়ে পড়বে।

সকালের কাজে বরকত হয় : পার্থিব জীবনে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল কাজে বরকত, সাফল্য ও অগ্রগতি লাভের জন্য ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার বিকল্প নেই। ভোররাতে বা দিনের শুরুতে সবচেয়ে বেশি বরকত এবং কল্যাণ থাকে। শুধু ইবাদত-বন্দেগিই নয়, সাধারণ কাজের জন্যও সবচেয়ে যথাযোগ্য ও বরকতপূর্ণ সময় এটি। নবীবি (সা.) দিনের সূচনা করতেন ফজরের নামাজ দিয়ে। এরপর জীবিকা নির্বাহের কাজসহ অন্যান্য কাজ শুরু করতেন। প্রিয়নবী (সা.) ভোরবেলার কাজে বরকতের জন্য দোয়া করেছেন। হজরত সাখার আল-গামেদি (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) দোয়া করেছেন, ‘হে আল্লাহ, আমার উম্মতের জন্য দিনের শুরুকে বরকতময় করুন। (আবু দাউদ : ২৬০৬)। এ জন্যই হাদিস শরিফে আমরা দেখতে পাই রাসুল (সা.) কোনো যুদ্ধ অভিযানে বাহিনী পাঠানোর সময় দিনের শুরুতে পাঠাতেন। ফজরের পর ভোর আলোকিত হলে বিভিন্ন দিকনির্দেশনার মাধ্যমে তাদের বিদায় জানাতেন।

সকালের আবহাওয়া স্বাস্থের জন্য উপকারী : দিনের বেলায় আলো ঝলমল আকাশ, সকালের স্নিগ্ধ বাতাস। যা স্বাস্থের জন্য খুবই উপকারী। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলে শারীরিক এবং মানসিক প্রশান্তি মিলে। কাজে উদ্যমতা আসে। সময়ে বরকত পাওয়া যায়। সকালে ওঠা মানুষগুলো সবার থেকে ভিন্ন ও কর্মদক্ষ হয়ে থাকেন। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন কিংবা রাতে কম ঘুমান, অন্যদের তুলনায় তাদের উপস্থিত বুদ্ধি ভালো হয়।

সকালবেলার ঘুম অনেক সময় শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অনুরূপভাবে সফলতা অর্জনেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। হজরত ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ (সা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রাসুল (সা.) আমার ঘরে এসে আমাকে ভোরবেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলেন, তখন আমাকে পা দিয়ে নাড়া দিলেন এবং বললেন, ওঠো! তোমার রবের পক্ষ থেকে রিজিক গ্রহণ করো! অলসদের দলভুক্ত হইও না। কেননা, আল্লাহ সুবহে সাদেক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত মানুষের মধ্যে রিজিক বণ্টন করে থাকেন। (আত-তারগিব : ২৬১৬)। তাই ফজরের নামাজ আদায়ের পর থেকেই নিজ নিজ কর্ম শুরু করা উচিত, যেন বেশি বেশি বরকত নাজিল হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, বর্তমানে আমাদের সমাজে অনেক মানুষ সকাল ৮-৯ পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে। ফলে সব বরকত থেকে বঞ্চিত হয়। এই অভ্যাস অবশ্যই বর্জনীয়। রাসুল (সা.) এজন্যই এশার পর জেগে থাকাকে অপসন্দ করতেন। রাতের প্রথম অংশে জেগে থাকার মাঝে কল্যাণ নেই। বরং কল্যাণ আছে শেষ রাত্রে। এই সময় আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন। এরপর থেকেই বরকত নাজিল হতে থাকে।

আল্লাহ দিনকে নির্ধারণ করেছেন কাজ কর্মের জন্য : দিনের আলোয় মানুষ নানা রকম কাজকর্মে জড়িয়ে থাকে। রাতের একটি বড় অংশ কেটে যায় বিশ্রামে। দিনের আলো সরিয়ে নিজের জায়গা করে নেয় রাতের অন্ধকার। কাজকর্ম আর পরিশ্রমের ক্লান্তি শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য উপযুক্ত সময় রাতই, ঠিক যেমন আয়-উপার্জনের জন্যে উপযুক্ত সময় দিন। আল্লাহতায়ালা বলেন, আপন মেহেরবানিতেই তিনি তোমাদের জন্য রাত ও দিন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা রাতে বিশ্রাম করতে পার আর (দিনে) তার অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা শোকর আদায় করতে পার। (সুরা কাসাস : ৭৩)। মুফাসসিরগণ উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে অনুগ্রহ অনুসন্ধান দ্বারা জীবিকার অনুসন্ধান উদ্দেশ্য এবং তার সম্পর্ক আয়াতে উল্লিখিত দিনের সঙ্গে।

দিনের আলোর রয়েছে নানাবিধ উপকার। এ বিষয়টি আধুনিক গবেষণাতেও প্রমাণিত। মানুষের শরীরের অতি প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি-এর প্রধান উৎস সূর্যের আলো। এ আলোতে শোভাময় হয়ে ওঠে বিভিন্ন ধরনের ফল-ফসলের বাগান। এ আলো যেখানে পর্যাপ্ত থাকে না, সেখানকার ফসলও ভালো হয় না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো আমরা অনেকে রাতের বেলা দেরিতে ঘুমাই। আর দিনের অনেক সময়কে আমরা ঘুমের মধ্যে কাটিয়ে দেই। অনেকের জীবনযাত্রায় সকালের ঘুম যেন একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। কর্মব্যস্ততা ও রাতজাগার সংস্কৃতির কারণে অনেকেই দেরিতে ঘুম থেকে ওঠেন। সকাল বেলার বরকত থেকে বঞ্চিত হন। যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। কেননা, রাসুল (সা.) সকালে ঘুম থেকে উঠার অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সকাল বেলায় রিজিকের অন্বেষণ কর। কেননা, সকালবেলা বরকতময় ও সফলতা অর্জনের জন্য উপযুক্ত সময়। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ : ৬২২০)।

সকালের ঘুমে ক্ষতি : সকালে ঘুম থেকে না ওঠে শুয়ে থাকায়

নানাবিধ ক্ষতি রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- এক. সকালের সজিবতা থেকে বঞ্চিত হওয়া। যা একজন মানুষের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। দুই. সকালের ঘুম অলসতার লক্ষণ। এ সময়ের ঘুম শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তিন. সকাল বেলা জীবিকা বণ্টনের সময়। যে ঘুমিয়ে বা অন্যভাবে সকালের যতটুকু সময় নষ্ট করবে, সে ততটা জীবিকা থেকে বঞ্চিত হবে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) তার এক ছেলেকে সকালে ঘুমাতে দেখে বলেন, উঠো! তুমি কি এমন সময় ঘুমাবে যখন জীবিকাগুলো বণ্টিত হয়। (আল-আদাবুশ শরইয়্যা, পৃষ্ঠা ১৪৭)। চার. সকালের ঘুমের ব্যাপারে সতর্ক করে হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, তোমরা সকালের ঘুম থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা, তা জ্বরের প্রকোপ বাড়ায়, যৌন ক্ষমতা কমায় এবং শরীরের সজীবতা নষ্ট করে। (আন-নিহায়াতু ফি গারিবীল হাদিস)। পাঁচ. যারা দেরি করে ঘুমায় তারা ফজরের নামাজ পূর্ণ একাগ্রতার সাথে আদায় করতে পারে না। কারণ তাদের চোখে ঘুমের ভাব থেকে যায়। ছয়. সকাল সকাল ঘুম থেকে না উঠার কারণে অনেকের ফজরের নামাজ কাযা হয়ে যায়।

চিকিৎসকদের পরামর্শ : সকালের কাজে শারীরিক উন্নতি হয় বলেও চিকিৎসকরা বলেছেন। ঠিক তেমনই সকালের ঘুমে মানুষের সমস্যা দেখা দেয় সেটাও বলা আছে চিকিৎসাশাস্ত্রে। চিকিৎসকদের মতে, সকালের ঘুম মানুষের শারীরিক ও মানসিক নানা সংকট তৈরি করে। আবার সকালের ঘুমের কারণে প্রতিদিন যে পরিমাণ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় তা জাতীয় উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলে। যারা খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, তারা অন্যদের চেয়ে আলাদা, তারা প্রাণবন্ত হয়ে থাকে।

ভোরে ঘুম থেকে উঠার উপকারিতা বিষয়ে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী বলেন, ‘সারা দিন উজ্জীবিত থাকতে চাইলে অবশ্যই সকালে উঠা উচিত। ভোরে উঠার অভ্যাস গোটা দিনটাকে আরো একটু বড় করে দেয়। সুস্থ থাকার জন্য সকালে একটু হাঁটা, ব্যায়াম করা, সময় নিয়ে আমিষসমৃদ্ধ নাশতা খাওয়া দরকার; যেটা সম্ভব হয় সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারলে। নিজের জন্যও একটু পরিচ্ছন্ন সময় পাওয়া যায় ভোরে উঠলে যারা ভাবেন, ভোরে উঠা অসম্ভব, তাদের জন্য বলব, অভ্যাসই মানুষের স্বভাব গঠন করে।’ তাই আসুন, আমরা রাতের বেলা অনর্থক সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি। শেষ রাতে আগেভাগে উঠার চেষ্টা করি। রাতে কোনো কাজ থাকলে তা সকাল বেলা করি। কেননা, তাতে অনেক বরকত হয়। রাত জাগার সভ্যতা বর্জন করে এশার পরপর ঘুমিয়ে যাওয়া আর ফজর পড়ার মধ্যদিয়ে সকাল শুরু করা মোমিন বান্দার বৈশিষ্ট্য ও ইসলামি সভ্যতার বরকতময় অনন্য নিদর্শন।

লেখক : সহকারী শিক্ষাসচিব, মাদ্রাসা আশরাফুল মাদারিস, তেজগাঁও ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত