ইতিহাস
চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমান
জুনাইদ মাহদি
প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইবনে সিনা : বিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা চিকিৎসাবিজ্ঞান। আর এই চিকিৎসাবিজ্ঞানে একজন মুসলিম বিজ্ঞানী বিশ্বজুড়ে সুনাম অর্জন করেছিলেন। যার লেখা চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থ ‘আল-কানুন ফিল-তিব’ দীর্ঘকাল ইউরোপে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতো। মানবদেহের অঙ্গসংস্থান ও শরীরতত্ত্ব সম্পর্কে তিনি যেসব তথ্য প্রদান করেছিলেন, সেগুলো সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত পৃথিবীর সব দেশের চিকিৎসকরা অনুসরণ করেছিলেন। বলা যায়, শল্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে তার কালজয়ী অবদান উল্লেখযোগ্য। এই খ্যাতিমান চিকিৎসাবিজ্ঞানী হলেন আবু আলি ইবনে সিনা। তিনি ইবনে সিনা নামে অধিক পরিচিত। তাকে বিশ্বের আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনকও বলা হয়।
কোরআনের হাফেজ : মাত্র দশ বছর বয়সে ইবনে সিনা পবিত্র কোরআন মুখস্থ করতে সক্ষম হন। ইবনে সিনা লাইব্রেরিতে পড়ার সুযোগ পেয়ে রীতিমতো অধ্যয়ন শুরু করেন এবং লাইব্রেরির সব বই মুখস্থ করে ফেলেন। প্রখর মেধা ও স্মৃতিশক্তির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এটি। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিত, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, ধর্মতত্ত্ব, চিকিৎসা বিজ্ঞান, কাব্য ও সাহিত্য বিষয়ে অসামান্য পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ২১ বছর বয়সে তিনি ‘আল মাজমুয়া’ নামে একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন। এতে তিনি গণিত ছাড়া সব বিষয় লিপিবদ্ধ করেন।
জন্ম ও পরিচয় : ইবনে সিনার মূল নাম আবু আলি ইবনে সিনা। তিনি আনুমানিক ৯৮০ খিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১০ ডিসেম্বর ১০৩৭ খিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। উজবেকিস্তানের বিখ্যাত শহর বোখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে তিনি বসবাস করতেন। ইরানের হামাদান শহরে তার সমাধি অবস্থিত।
শিক্ষাজীবন : শৈশবে ইবনে সিনা অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। মাত্র দশ বছর বয়সেই তিনি পবিত্র কোরআনের ৩০ পারা মুখস্থ করেছিলেন। এছাড়া তিনজন গৃহ শিক্ষকের নিকট তিনি ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহ, তাফসির, গণিতশাস্ত্র, দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র এবং জ্যামিতি বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। এভাবে তিনি মাত্র ১৭ বছর বয়সে তৎকালীন প্রচলিত সকল জ্ঞান অর্জন করেন। জ্ঞান সাধনায় তার মনোনিবেশ ছিল গভীর। ইউক্লিড ও টলেমির মতো বিজ্ঞানীর লেখাও তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন। তারপর এরিস্টটলের ‘মেটাফিজিক্স’ অধ্যয়ন করেছিলেন। তাছাড়া এরিস্টটলের দর্শন শাস্ত্রও ছিল তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। ইবনে সিনা সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, ইউক্লিডের জ্যামিতি, এরিস্টটলের দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং বীজগণিতে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তিনি আইনশাস্ত্রে অধ্যয়ন শেষে আঠার বছর বয়সে গণিত ও চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এতে তার যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়া তিনি দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তখনকার দিনে তিনি ‘হাকিম’ অর্থাৎ প্রজ্ঞাবান উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
কর্মজীবন : ইবনে সিনা মাত্র ১৭ বছর বয়সে চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এসময় তিনি বুখারার সামানীয় সুলতান নূহ বিন মানসুরের (৯৭৬ - ৯৯৭) ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে নিয়োজিত হন। সুলতান নূহ বিন মানসুর ছাড়াও আরো কয়েকজন রাজার দরবারে তিনি চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
অবদান : মাত্র ২১ বছর বয়সে ইবনে সিনা বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য বিষয়ে গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-কানুন ফিত-তিব’ ৫ খণ্ডে বিভক্ত। এ বিষয়ে তিনি আরো ১৫টি গ্রন্থ রচনা করেন। ইবনে সিনার ‘আল-কানুন ফিত-তিব’ গ্রন্থটি প্রাচ্য-প্রাশ্চাত্যের অত্যন্ত প্রভাবশালী গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করা হয়। একাদশ শতাব্দী হতে ১৭শ’ শতাব্দী পর্যন্ত এ গ্রন্থটির ল্যাটিন অনুবাদ ইউরোপের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল প্রতিষ্ঠানসমূহে পাঠ্য বই হিসেবে পড়ানো হতো। ইউনানি চিকিৎসায় এর অবদান উল্লেখ করার মতো। ইবনে সিনা হলিস্টিক মেডিসিনের প্রণেতা। তিনি মানুষের চোখের সঠিক এনাটমির বর্ণনা দেন। তিনি মেনিনজাইটিস রোগও প্রথম শনাক্ত করেন। তার আরেকটি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাব আল-শিফা’ যা ২০ খণ্ডে সমাপ্ত। তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘কিতাব আল-ইশারাত’।
ইবনে সিনা গ্রিক, রোমান, ভারত ও চীনা চিকিৎসা পদ্ধতির মূল নির্যাস সংগ্রহ করে চিকিৎসা শাস্ত্রের এই বিখ্যাত গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে ৭৫০টি গুল্ম, প্রাণীজ ও খণিজ ঔষুধের বর্ণনা দেন। এর মধ্যে অনেকগুলো ওষুধ এখনও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইউরোপে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইবনে সিনার প্রভাব অসামান্য। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকাতে টমাস ক্লিফোর্ড বলেন, ইবনে সিনার ‘কানুন’ গ্রন্থ হিপোক্রাটস ও গ্যালেনের কৃতিত্বকে অতিক্রম করেছে। কয়েক শতাব্দী ধরে ইউরোপের চিকিৎসা শাস্ত্রের এই গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ইবনে সিনা মুখে অনুভূতিবিলোপকারী (চেতনানাশক) পদ্ধতির ধারণা দিয়েছিলেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কানুন’ চিকিৎসাবিজ্ঞানের বাইবেল নামে খ্যাত। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের অনুসরণীয় চিকিৎসাবিদ্যার এই গ্রন্থে তিনি মাথাধরা, মৃগী, অবশতা, চোখ, কান, নাক, গলা এবং দাঁতের অসুখ, হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুসের রোগ, পেট, অন্ত্র, যকৃৎ, পিত্ত ও প্লিহার রোগ, জ্বর, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া প্রভৃতি রোগের প্রতিকারের পদ্ধতির বিশদ বর্ণনা করেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ৪৫০টি গবেষণা গ্রন্থ লিখেছিলেন। ইবনে সিনা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক অবদান রাখলেও তার সুনাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে। আরবরা তাকে অভিহিত করেছিলেন আল-শায়খ আল-রাঈস তথা জ্ঞানীকুল শিরোমণি হিসেবে। সমসাময়িককালে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও রাজনীতিজ্ঞ।
আল রাজি (৮৪১-৯২৬) : নবম শতকের চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম ব্যক্তিত্ব আল রাজি। তিনি দীর্ঘ ৩৫ বছর চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। আল রাজি চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে ১১৭টি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি হাম, শিশুরোগ সম্পর্কে নতুন মতবাদ প্রবর্তন করেন। আল-রাজি স্নায়ু-দুর্বলতা, মানসিক রোগ, পক্ষাঘাত চিকিৎসার ধারণা প্রদান করেন।
ইবনে জহুর (১০৯৪-১১৬৩) : গ্যাস্ট্রিক টিউবের মাধ্যমে কৃত্রিম খাবারের যে ব্যবস্থাপদ্ধতি আবিষ্কার করেন, তা আজও বহুলভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
ইবনে আল-নাফিস (১২১২-১২৮৮) : ইবনে আল-নাফিস ফুসফুস সংক্রান্ত রোগের নিরাময় পদ্ধতি প্রথম আবিষ্কার করেন। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার সবচেয়ে পরিচিত বিজ্ঞানীর নাম আলী ইবনে আব্বাস (৯৩৬-১০১৩)। এই আন্দালুসিয়ান-আরব চিকিৎসাবিদ এবং বিজ্ঞানীকে ‘আধুনিক শল্যচিকিৎসার জনক’ বলা হয়। তিনি একজিমা, পাঁচড়া, মেছতা, গোদ, কুষ্ঠ, বসন্ত ও যৌনবিষয়ক রোগের কারণ ও প্রতিকার বিশদভাবে বর্ণনা করেন। এ ছাড়াও অনেক মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার ভিত্তি রচনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এদের কয়েকজন হলেন জাবির ইবনে হাইয়ান, আল-বাতরিক (মৃ-৭৯৬), আলি ইবনে রাব্বান, আবুল হাসান আত-তারাবি, হাসান ইবনে নুহ, ইসমাইল আল-জুরজানি, ইবনে রুশদ, হুনায়েন ইবনে ইসহাক (৮০৯-৮৭৭), সাবেত বিন কুরা (মৃত্যু-২৮৮ হিজরি) প্রমুখ।
(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া ও পত্রপত্রিকা)