রমজান মাসে মহানবীর আমল

জাকারিয়া জুবায়ের

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সভ্যতা বিনির্মাণ ও মনুষ্যত্ব অর্জনের কার্যকর প্রশিক্ষণের বার্তা নিয়ে আগমন করে মাহে রমজান। শাবান মাস শেষে পশ্চিম আকাশে বাঁকা চাঁদ উঁকি দিতেই রহমতের ফল্গুধারা নেমে আসে ধরাপৃষ্ঠে। শুরু হয় মাহে রমজান। মোমেন মুসলমানের দীর্ঘ প্রতীক্ষার স্নিগ্ধ প্রহর। সম্মানিত মাস। কোরআন নাযিলের মাস। (সুরা বাকারা-১৮৫) রহমত ক্ষমা ও মুক্তির মাস। (সহি ইবনে খুজায়মা-১৮৮৭) কবরবাসীর করুণাপ্রাপ্তি ও নাজাতের মাস। (মুসনাদে আহমাদণ্ড৬৬৪) গোনাহসমূহ কাফফারার মাস। (মুসলিমণ্ড২৩৩) এ মাসে আছে এমন একটি রাত যা হাজার মাস থেকে উত্তম। (সুরা-কদর ১-৫) দোয়া কবুলের মাস। (মুসনাদে আহমেদণ্ড৬৬৪) শয়তান শিকলে আবদ্ধ হওয়ার মাস। (মুসলিমণ্ড১০৭৯) সামাজিক জীবনে একে অপরের প্রতি সৌহার্দ্য, সহানুভূতি ও অনুকম্পা প্রকাশের মাস। সর্বোপরি রমজানের গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। এজন্য রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন দু'মাস পূর্ব থেকেই। বেশি বেশি প্রার্থনা করতেন, ‘হে আল্লাহ আপনি আমাদের জন্য রজব ও শাবানে বরকত নাজিল করুন এবং আমাদের হায়াতকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। (মুসনাদে-আহমেদণ্ড২৪৯)।

রাসুলের আদর্শ অনুকরণ : এ বরকতপূর্ণ মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) আমলের খুব পাবন্দি করতেন। রাসুলের কর্মাদর্শ উম্মতের জন্য অপরিহার্য অনুসরণীয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা আমার ও আমার সাহাবীদের অনুসরণ করো এবং তা মাড়ির দাঁত দিয়ে আঁকড়ে ধরো। (মুসনাদে আহমাদণ্ড১৭১৪৫, আবু দাউদণ্ড১৬০৭) আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘আর রাসুল তোমাদের কাছে যা নিয়ে এসেছেন তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা থেকে তোমাদের নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক। (সুরা-হাশর-৭) আল্লাহতায়ালা অপর আয়াতে বলেছেন, ‘হে রাসুল আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তাহলে আমাকে অনুসরণ কর। (সুরা-আল ইমরান-৩১) আল্লাহর ভালোবাসা লাভের জন্য মহিমান্বিত রমজান একটি সুবর্ণ সুযোগ। রমজানে রাসুলের পূর্ণ আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয় হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখা চাই প্রতিটি মোমেন নর ও নারীর। রাসুল (সা.) রমজানে কী আমল করতেন তা খুঁজে খুঁজে আমল করা উচিত।

রমজানে রাসুল (সা.)-এর আমল সাহরি খাওয়া : রাতের শেষ প্রহরে সুবহে সাদিকের পূর্বে রোজার নিয়তে কিছু খাওয়াকে সাহরি খাওয়া বলে। সাহরিতে আল্লাহতায়ালা বরকত রেখেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাও, কারণ সাহরিতে বরকত রয়েছে।’ (বোখারি : ১৯২৩, মুসলিমণ্ড২৪১৫)।

আরেক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন মুসলমান ও ইহুদি নাসারাদের মাঝে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া। (মুসলিম : ২৪১৬, আবু দাউদ : ২৩৩৬) সাহরি মধ্যরাতে বা অধিক পূর্বে না খেয়ে সুবহে সাদিকের পূর্ববর্তী সময়ে খাওয়া উত্তম। হাদিসে আছে, যায়েদ বিন সাবেত (রা.) বলেন,‘ আমরা আল্লাহর রাসুলের সাথে সাহরি খাই। এরপর তিনি নামাজের জন্য দাঁড়ান। বর্ণনাকারী বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম ফজরের আজান ও সাহরির মধ্যে কতটুকু সময়ের ব্যবধান ছিল? তিনি বললেন, ৫০ আয়াত (পাঠ বা ১৫-২০ মিনিট) পরিমাণ। (বোখারি : ১৯২১, মুসলিমণ্ড২৪১৮)।

কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া দরুদ পড়া : রমজান মাস বরকতের মাস। আল্লাহতায়ালা রমজানে বান্দাকে অশেষ রহমত দান করেন। হাদিসে এসেছে, রমজান মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল আদায় করল সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করল। আর যে এ মাসে একটি ফরজ আদায় করল সে যেন অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায় করল। (শুআবুল ঈমান ৩/৩০৫-৩০৬ ) রমজানে নবীজি (সা.) বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করতেন, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রমজান মাসে প্রতিরাতে নবীজির কাছে জিবরাইল আলাইহিস সালাম আসতেন। তারা একে অপরকে কোরআন শোনাতেন। (বোখারি : ৩৫৫৪)। কোরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি বেশি বেশি ইস্তেগফার ও দোয়া দরুদ পাঠ করা রমজানের অন্যতম আমল। রমজানে কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজের পাপ মার্জনা করে নেওয়া অতি জরুরি একটি আমল। কেননা, যে রমজান পেয়েও নিজের পাপ মাফ করাতে পারল না সে হতভাগা। জিবরাঈল (আ.) একবার বললেন ‘যে রমজান পেল এবং কৃত গোনাহ মাফ করাতে পারল না, সে ধ্বংস হোক।’ এ দোয়া শুনে রাসুল বললেন ‘আমিন’। (বায়হাকি : ১৫৭২)। তাই মোমিনের হৃদয়ে পুরো রমজানজুড়ে এটি বাসনা থাকবে আমি আমার গতদিনগুলোর পাপ মাফ করাতে পেরেছি তো? এ আত্মজিজ্ঞাসা নিজের পাপ বর্জন ও মার্জনার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

মেসওয়াক করা : মেসওয়াক করা রাসুলের প্রিয় সুন্নাতসমূহের মধ্যে একটি। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মেসওয়াক মুখ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যম এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপায়। (নাসায়ি : ৫)। আরেক হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যদি আমি আমার উম্মতের ওপর কষ্টকর হওয়ার আশঙ্কা না করতাম, তাহলে প্রত্যেক নামাজের সময় মেসওয়াক করার আদেশ দিতাম। (বোখারি : ৮৮৭)।

হজরত হাসান (রা.) কে রমজানে রোজা রেখে মেসওয়াক করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, রোজা রেখে মেসওয়াক করতে কোনো সমস্যা নেই। মেসওয়াক পবিত্রতার মাধ্যম। সুতরাং দিনের শুরুতে এবং শেষে মেসওয়াক করো। (মুসান্নাফে আবদুর রাজজাক : ৪/২০২)।

ইফতার করতে দেরি না করা : ইফতারের নির্ধারিত সময়ে ইফতার করা, অযথা বিলম্ব না করা। ইফতার করাও একটি আলাদা ইবাদত। নবীজি সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করতেন। ইফতার শেষ করে সাহাবিদের নিয়ে নামাজের জামাতে দাঁড়াতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘লোকেরা যত দিন যথাসময়ে ইফতার করবে, তত দিন তারা কল্যাণের ওপর থাকবে।’ (বোখারি : ১৯৫৭) হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার বান্দাদের মধ্যে তারা আমার সবচেয়ে প্রিয়, যারা দ্রুত ইফতার করে।’ (তিরমিজি, আলফিয়্যাতুল হাদিস- ৫৬০)।

রোজাদারকে ইফতারি করানো : আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে সে ওই রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে এবং রোজাদারের সওয়াবও কমানো হবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৮০৭) যায়েদ ইবনে খালেদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে সে রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। রোজাদারের সওয়াব থেকে একটুও কমানো হবে না।’ (সুনানে তিরমিজি: ৮০৭, সুনানে ইবনে মাজাহ, ১৭৪৬, ইবনে হিব্বান-৮/২১৬; সহি আল-জামে: ৬৪১৫)।

খেজুর দ্বারা ইফতার করা : হজরত সালমান ইবনে আমির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ ইফতার করে, সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। কেননা, তাতে বরকত ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে।’ (মেশকাত -১৮৯৩)। অন্য হাদিসে হজরত আনাস বিন মালেক (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজের আগে কয়েকটি কাঁচা খেজুর খেয়ে ইফতার করতেন। যদি কাঁচা খেজুর না থাকত, তাহলে শুকনো খেজুর দিয়ে। যদি শুকনো খেজুরও না থাকত, তাহলে কয়েক ঢোক পানি দিয়ে ইফতার করতেন।’ (তিরমিজি-৬৩২)।

তারাবি নামাজ পড়া : তারাবি নামাজ রাসুলের সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তাবে তাবেয়িন আইম্মায়ে মুজতাহিদিন ও মুসলিম উম্মাহর যুগ যুগান্তরের আমল হলো তারাবির নামাজ বিশ রাকাত পড়া। ইমাম বোখারি ও ইমাম মুসলিম (রহ.)-এর উস্তাদ ইমাম আবু বকর ইবনে শায়বা (রহ.) বর্ণনা করেন, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবি এবং বিতর পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা-৭৬৯০; সুনানে কুবরা-২/৪৯৮; মুজামে কাবির-১১/৩৯৬; আল-মুনতাখাব- ৬৫৩)। বিশ রাকাত তারাবির নামাজ খোলাফায়ে রাশেদিনের স্বীকৃত আমলসমূহের একটি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং সৎপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নাতকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধর। (সুনানে আবু দাউদ : ৪৬০৭, সুনানে তিরমিজি: ২৬৭৬, মুসনাদে আহমাদণ্ড১৬৬৯২, সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪২,সহি ইবনে হিব্বান-৫) সহি সনদে প্রমাণিত যে, খুলাফায়ে রাশেদীন বিশ রাকাত তারাবি পড়তেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র.) বলেন- বিশ রাকাত তারাবি খুলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নাতের দ্বারা প্রমাণিত। (মাজামুউল ফাতাওয়া-২৩/১১৩)।

তাহাজ্জুদ পড়া : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে তাহাজ্জুদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। তবে তিনি অবশ্য পালনীয় বিষয় হিসেবে নির্দেশ দেননি। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও নিষ্ঠার সঙ্গে রমজানে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করবে, আল্লাহতায়ালা তার পূর্ববর্তী পাপ মার্জনা করবেন। (সুনানে নাসায়ি : ২১৯৭)। ফরজ নামাজের পর শেষরাতের নামাজ তথা তাহাজ্জুদ ছিল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। তিনি বলেন, রমজানের রোজার পর সবচেয়ে উত্তম রোজা মহররমের। আর ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম হলো রাতের নামাজ। (মুসলিম : ১১৬৩)।

দান সদকা করা : রমজানে রাসুল (সা.) বেশি বেশি দান সদকা করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। রমজানে তিনি আরো বেশি দানশীল হতেন। (বোখারি : ৩৫৫৪)। হজরত আবদুুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত ‘রমজান এলে রাসুল (সা.) দানের হাতকে আরও বেশি প্রসারিত করে দিতেন।’ আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানের হাত এতটা প্রসারিত ছিল যে, সকাল বেলা যদি ওহুদ পরিমাণ সম্পদও রাসুল (সা.) এর কাছে রাখা হয়, আমার মনে হয়, মাগরিব আসার আগেই তিনি সব দান করে শেষ করে ফেলবেন। (বোখারি ও মুসলিম)।

শেষ দশকে মসজিদে এতেকাফ করা : প্রতি বছর রাসুল (সা.) রমজানে মদিনায় (মসজিদে নববিতে) এতেকাফ করতেন। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) প্রতি রমজানে এতেকাফ পালন করতেন। (বোখারি : ২০৪১)।

অন্য এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি কদরের রাত্রির সন্ধানে প্রথম দশ দিন এতেকাফ করলাম। এরপর এতেকাফ করলাম মধ্যবর্তী দশদিনে। অতঃপর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানানো হলো যে, তা শেষ দশ দিনে। সুতরাং তোমাদের যে এতেকাফ পছন্দ করবে, সে যেন এতেকাফ করে। ফলে, মানুষ তার সঙ্গে এতেকাফ করল। (মুসলিম : ১১৬৭)। হজরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করেছেন। (বোখারি : ২০২৬)।