ইসলাম প্রচারের জন্য বহু সুফি দরবেশ ভারত উপমহাদেশে আগমন করেছেন। নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে এসে তারা দ্বীন প্রচার করেছেন। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এ অঞ্চলের মানুষ দ্বীনের সবক পেয়েছে। অনেক মহান পুরুষ দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষা প্রসারে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)-অন্যতম। শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.) বোখারার অধিবাসী ছিলেন। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে আনুমানিক ১২৭৭ খ্রিষ্টব্দে সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের শাসনকালে (১২৬৬-৮৭) তিনি দিল্লিতে পৌঁছেন এবং সেখান থেকে বাংলায় আসেন।
জ্ঞানতাপস, সুফিসাধক মাওলানা শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার নেতৃত্বে সে সময়ের বাংলার রাজধানী সোনারগাঁ ইসলামি শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। সোনারগাঁয়ে আবু তাওয়ামা তাঁর খানকাহ ও একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ইসলামি ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শিক্ষাদান করা হত। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই জ্ঞানতাপস মাওলানা শরফুদ্দিনের নিষ্ঠায় এর খ্যাতি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ডক্টর এম এ রহিম বলেছেন: ‘শায়খ আবু তাওয়ামা ছিলেন সোনারগাঁ ও পূর্ব বাংলার মহান গৌরবের প্রকৃত কর্ণধার’।
কবি আবদুল হাইশিকদার লিখেছেন : ‘মনে প্রশ্ন জাগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কী হলো? তার সামান্য ভগ্নাবশেষও কি কোথায়ও নেই? আবু তাওয়ামার মৃত্যুর পর আর কতদিন টিকেছিল ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়? ইতিহাস বলে এই বিশ্ববিদ্যালয় সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের শাসনামল পর্যন্ত টিকেছিল। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ রাজা গণেশের চক্রান্তে খুন হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। এরপর ইলিয়াস শাহী বংশের পতনের পর যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন রাজা গণেশ, তখন থেকে আর কিছু জানা যায় না বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্বন্ধে। সম্ভবত রাজা গণেশ বিশ্ববিদ্যালয়টি ধ্বংস করে দেন।’
রাজা গণেশ মুসলিমদের পঙ্গু করার উদ্দেশ্যে প্রথমেই আঘাত হানে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। এদেশের শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। সেই সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়টিও বন্ধ হয়ে যায়। নাসিরুদ্দিন বুগরা খানের পুত্র রোকনুদ্দিন কায়কাউসের (১২৯১-১৩০১ খ্রিষ্টাব্দ) প্রশাসনের সময়, শায়খ আবু তাওয়ামা ছাত্রদের উদ্দেশে যে ফিকহ বিষয়ক বক্তৃতা দিতেন, এ বক্তৃতাগুলো ফার্সি ভাষায় সংকলিত হয় ‘নামে-ই-হক’ নামে। এ বইটি ১০ খণ্ডে রচিত।
এই বইতে ১৮০টি কবিতা আছে। গ্রন্থটি ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই) থেকে এবং ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে কানপুর থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়া আবু তাওয়ামার তাসাউফের উপর লেখা বই ‘মাকামাত ’ বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিল। সোনারগাঁ ছিল ইসলামি শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। এখানে বসে অনেক ইসলামি কাজ করেছেন আলেমগণ। এসব কাজে সহায়তা করেছে প্রশাসন। এ ধারাবাহিকতায় সোনারগাঁওয়ের তুঘলক গভর্নর তাতার খানের উদ্যোগে ফতোয়া-ই-তাতারখানি সংকলিত হয়েছিল। এটি ফিকহে হানাফির সমৃদ্ধ একটি ফতোয়াগ্রন্থ।