সভ্যতা গড়ে ওঠে মানুষের যাপিত জীবনের নানান দিক নিয়ে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জীবনাচার মিলে জাতির আদর্শ ও সভ্যতার বিকাশ ঘটে। পৃথিবীতে মানুষ সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নানানভাবে সংজ্ঞায়িত করলেও আদর্শ মানুষ ও সভ্য জাতি গঠনে ইসলামি শিক্ষার বিকল্প নেই। ইসলামি শিক্ষা ছাড়া মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। এ কথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্যও তা প্রমাণ বহন করে। বলা বাহুল্য, ছাপার অক্ষরে গুচ্ছ কবিতা কিংবা গদ্যের গতানুগতিক চর্বিত চর্বনকে শিক্ষা আখ্যায়িত করা একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রবঞ্চনা মাত্র। যদি সে গদ্য ও পদ্য প্রকৃত মানুষ হওয়ার প্রেরণা না জোগায়। তাই নিশ্চিন্তে বলা যায়, একজন মানুষের জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষা। যে শিক্ষার আলোকে ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পরিবার-সমাজ তথা দেশকে ভালো কিছু উপহার দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে প্রত্যেকেই। কিন্তু এ প্রকৃত শিক্ষা আমরা পাব কোথায়? আমাদের দেশে কি এমন শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে যে, যা থেকে আমরা প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি? যে কোনো সমাজ সচেতন মানুষ এক বাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য, আমাদের দেশে যে ভঙ্গুর শিক্ষানীতির ছত্রছায়ায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করছে, তা কোনভাবেই প্রকৃত মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না। বলা বাহুল্য যে, শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য হলো প্রকৃত মানুষ সৃষ্টি করা।
কিন্তু খুব দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, পৃথিবীব্যাপী শিক্ষার যদিও আশাতীত প্রসার লাভ ঘটেছে বলে অনেকে মনে করেন, কিন্তু আমরা তা মানতে পারছি না। কারণ, প্রকৃত মানুষ কিংবা পূর্ণাঙ্গ মানুষ কোথাও তৈরি হচ্ছে বলে আমরা মনে করি না। কেউ যদি মনে করেন, এটা আমার বাড়াবাড়ি কিংবা মনগড়া কথা, তাহলে আমার এ ব্যাপারে বলার কিছু নেই। তবে আমরা এটা সরাসরি বলতে পারি, পৃথিবীর সর্বশীর্ষে সমাসীন পর্যন্ত শিক্ষা ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী হয়ে যখন একজন মানুষ হয় লম্পট, চোর, বদমাইশ এবং অসভ্যতার কোনটাই তার মাঝে বাকি থাকে না, তখন নিশ্চয়ই তাকে মানুষ বলা যায় না; কোনোভাবেই তাকে প্রকৃত শিক্ষিত বলে গণ্য করা যায় না। যদি কেউ একে শিক্ষিত বলে মনে করেন, আমরা বলব, তিনি শিক্ষা ও শিক্ষিতের প্রকৃত সংজ্ঞা জানেন না বলেই ‘শিক্ষা ও শিক্ষিত’ শব্দটিকে লেজেগোবড়ে করে ফেলছেন। আরো একটু গভীরে গিয়ে যদি বলি, যে প্রকৃত শিক্ষা তথা শিক্ষিত মানুষ দেশ তথা বিশ্বে খুঁজে পাওয়া বিরল, কেননা, আমরা প্রত্যেকেই মূর্খ কোনো না কোনো বিষয়ে। যা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
উদাহরণ স্বরূপ যদি বলি, তাহলে আবার সে পুরোনো বঁাঁশিটির সুর শোনাতে হবে। যেমন- আমরা সকলেই জ্ঞান অন্বেষণ কালে জানার জন্যই অধ্যয়ণ করে থাকি। ভালো-মন্দও জানি পড়ার মাধ্যমে। কিন্তু পড়া যখন শেষ করি, তা কি আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে মেনে চলি? নিশ্চয়ই না। আর যদি মেনেই চলতাম, তাহলে কেনইবা মিথ্যার মতো জঘন্য শব্দটি হতো আমাদের সঙ্গী? মানুষের অনিষ্ট কেনইবা হতো আমাদের দ্বারা? আর কেনোই বা সমগ্র বিশ্বব্যাপী নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের অপপ্রয়াসে লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে করা হতো হত্যা? এমনি করে অসংখ্য বিবেক বর্জিত, মানবতাবিরোধী, সুশিক্ষার পরিপন্থি জঘন্যতম কর্মকাণ্ড বিশ্বের সর্বত্রই চলছে বিরামহীনভাবে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষদের দ্বারা; বা চলমান শিক্ষার কারিকুলামে শিক্ষিত ব্যক্তি-গোষ্ঠী দ্বারা। যা কোনোভাবেই প্রকৃত শিক্ষা ও শিক্ষিত ব্যক্তি-গোষ্ঠীর পর্যায়ে পড়ে না।
আর এ কুশিক্ষা বা অশিক্ষার মোহে আমরা অন্ধ হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে ভালো মন্দ বাছবিচার করার ক্ষমতাও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। প্রত্যেক মানুষ জন্ম লাভের পর পরিবেশ থেকেই ভালো-মন্দ বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে। আস্তে আস্তে তার বয়স বাড়ার পাশাপাশি বিবেক-বুদ্ধি, প্রবৃত্তি তথা বোধশক্তি বৃদ্ধি পায় এটাই স্বাভাবিক। সে যে সমাজে বাস করে যেখানেই ভালো-মন্দ দৃশ্য দেখে, ভালো-মন্দ কথা বলতে শেখে, ভালো-মন্দ চিন্তা করে, ভালো-মন্দ কর্ম করতে শেখে। এমনি করে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভালো-মন্দ তার মস্তিষ্কে ধারণ হতে থাকে। পাশাপাশি কুপ্রবৃত্তি ও সু-প্রবৃত্তি ভালো-মন্দ বিষয়গুলো ভাগাভাগি করে নেয়। যখন দেখা যায়, খারাপত্বের প্রভাবে কৃপ্রবৃত্তি চাঙ্গা হয়ে ওঠে, তখন সুপ্রবৃত্তি অবদমিত হয়ে পড়ে। যে কারণে ভালো দৃশ্য, ভালো চিন্তা, ভালো কাজ ও ভালো কথা শোনাতে তার ভালো লাগে না। মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে সে তখন দিশাহারা হয়ে ওঠে। তার বিবেক তখন কখনো তন্দ্রাচ্ছন্ন আবার কখনো ঘুমিয়ে পড়ে এবং এমনও দেখা যায় অনেকের বিবেক অর্ধ মৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। আর যখন বিবেক সত্তা পুরোপুরী বিনষ্ট হয়ে যায়, তখন তার মৃত্যুই অনিবার্য। যা মানব জীবনের সুস্থ চিন্তাচেতনা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দেয় এবং এক পর্যায়ে সে এই সুন্দর ধরণী থেকে বিদায় নেয় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে। সমাজ ও জাতিকে ভালো কিছু উপহারের বদলে এমন কিছুব্যাধী ছড়িয়ে দিয়ে যায়, যা যুগ-শতাব্দী কিংবা হাজার বছর পর্যন্ত গড়ায়। আর তাহলো নিঃসন্দেহে কুশিক্ষা। আর এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সর্বাগ্রে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে সত্য ও সুন্দরের চাষাবাদ করতে হবে। প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করে প্রকৃত মানুষ হতে হবে। তবে এ কাজটি এত সহজ নয়। যারা প্রকৃত মানুষ হওয়ার সংকল্প করবে তাদের সর্ব প্রথম নিজের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে; খারাপত্বকে পরিহার করে ভালোত্বের সন্নিবেশ ঘটাতে হবে মস্তিষ্কে।
এটা অবশ্য হুট করে সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে অনুশীলনে রপ্ত হয়ে যাবে আপনাআপনিই। প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহেও যদি আমরা আমাদের মস্তিষ্কে জমে থাকা খারাপত্বের দিকগুলোকে কিছু কিছু করে বাদ দেয়ার চেষ্টা করি এবং ভালোত্বকে গ্রহণ করি তাহলে দেখা যাবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের সুপ্রবৃত্তি তথা বিবেক নামের পাঠশালার দোর উন্মেচিত হবে। বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ভয়ে সকল খারাপত্ব পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে। কুপ্রবৃত্তিরও প্রাণ যায় যায় অবস্থা হবে। আর তখনই আমরা যা পড়ব, যা জানব তা আমাদের জীবনে যথাযথ প্রয়োগ করতে পারব এবং তখনই আমরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারব। এর চেয়েও বড় কথা, সভ্য মানুষ হতে প্রয়োজন ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা। ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা যদি আমাদের মাঝে বিস্তার না ঘটে তাহলে কোনকালেই এ সকল সুস্থ চিন্তার বিকাশ ঘটবে না।
আমরা পারব না প্রকৃত আলোকিত মানুষ হতে। যে কারণে, একমাত্র ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থাই পারে আমাদের ব্যক্তি- পরিবার-জাতি-দেশ তথা বিশ্বকে সুস্থ ও সুন্দর জীবন-যাপনের পথ সুগম করতে। কেননা, ইসলামি শিক্ষার মূলে আছে পবিত্র কোরআন ও রাসুল (সা.)-এর হাদিস। যা কল্যাণের সমাহার। কল্যাণ ও মানবতার শীর্ষ ব্যবস্থাপত্র রয়েছে কোরআন ও হাদিসে। যা পৃথিবীর অন্য কোনো গ্রন্থে বা পাঠশালায় অনুপস্থিত। আমাদের উচিত, প্রতিদিন কোরআনের পরশে নিজেকে শুধরে নেয়া। হাদিসের আলোকে আলোকিত করা। তবেই আমরা প্রকৃত মানবতা ও সভ্যতার অধিকারী হতে পারব।
লেখক : কবি ও সংগঠক