ফিলিস্তিনে চলছে মানবতার চরম লঙ্ঘন। প্রতিদিন হত্যার শিকার হচ্ছে নারী ও শিশু। তাদের পক্ষে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সময়ের দাবি। আমাদের সীমাবদ্ধতা, আত্মিক ও নানান দুর্বলতা আমাদের অসহায়ত্বকে প্রকটভাবে প্রকাশ করে। আমরা ভীতু ও লজ্জিত। এ লজ্জা ও ভয় আমাদের পায়ে গোলামির শেকল পরায়। যা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। সে শেকলে আটকা পড়ে আমরা দূর প্রান্তর থেকে কাঁদি। মাজলুমের পক্ষে একাত্মতা ও সংহতি জানাই। এ সংহতি পিপাসায় নোনা পানির মতো। পানি পেয়েও পিপাসা মিটে না। তৃপ্তি তো দূর। আমরা কী করতে পারছি তাদের জন্য, এ প্রশ্ন থেকেই যায় মনের ভেতর। আমাদের ধর্মবিশ্বাস মতে, আমরা হাশরের মাঠে আল্লাহর সামনে কী উত্তর দেব? যদি মহান আল্লাহ প্রশ্ন করেন- তোমার ওপর তো ফরজ ছিল নির্যাতিত মুসলিমের পাশে দাঁড়ানো। তাদের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেয়া। তুমি কি দাঁড়িয়েছিলে তাদের পাশে? এগিয়ে গিয়েছিলে নির্যাতিতের পক্ষ হয়ে?
আমরা জানি না- কী উত্তর দেব সেদিন! নিঃসন্দেহে ফিলিস্তিন পবিত্র ভূমি। নবী-রাসুলের দেশ। ইতিহাসের বিখ্যাত দায়ী ও বীর মুজাহিদগণ জন্ম নিয়েছেন ফিলিস্তিনের মাটিতে। খাঁটি ঈমানদারদের আবাসস্থল হিসেবে ফিলিস্তিন এক ঐতিহাসিক স্থান। ইসলামের ইতিহাস, মুসলমানের বীরত্বগাথা, ভাবাবেগ ও ইবাদত মিশে আছে ফিলিস্তিনের সঙ্গে। তাই ইহুদিদের দ্বারা ফিলিস্তিন আক্রান্ত হলে সারা বিশ্বের মুসলমানের হৃদয়ে রক্ত ক্ষরিত হয়। প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে বিশ্বের মুসলিম জনতা। এটা মুসলমানের ঈমানের বহিঃপ্রকাশ। মুসলমান ঈমানের বলে বলীয়ান হলে কখনো নির্যাতিত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সারা বিশ্বে শুধু মুসলমানরাই নির্যাতিত হচ্ছে। মুসলিম শিশু ও নারীরাই গণহত্যার শিকার হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বর্তমান পৃথিবীতে মানবতা ও মানবাধিকার বলতে মুসলমানের জন্য কিছুই নেই, ‘মানবতা ও গণতন্ত্র’ সুবিধাবাদীদের মুখরোচক কথামাত্র। এর সুফল মুসলিমবিশ্ব কখনোই ভোগ করেনি।
বাস্তবতা হলো এ মানবতার স্লোগাননির্ভর পতাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে, বুলিমাত্র কাগুজে সান্ত¡না দিয়ে নির্যাতিত মুসলমান ঘুরে দাঁড়ানোর সময় তাদের শান্ত রাখা হয়। মানবতার কথা তখনই জোরেশোরে উচ্চারিত হয়, যখন কোনো মুসলিম দেশ আত্মরক্ষার তাগিদে অমুসলিম দেশে আক্রমণ করে। এর বিপরীতে কোনো অমুসলিম দেশ মুসলিম দেশে সামরিক আক্রমণ করে নির্বিচারে বেসামরিক লোক হত্যা করলে, এমনকি হাজার-হাজার নারী ও শিশুহত্যা করলেও মানবতা লঙ্ঘিত হয় না। মুসলমানের বিপক্ষে দুনিয়ার পাওয়ারফুল দেশ ও সংস্থাগুলো পরিকল্পনামাফিক কাজ করে যাচ্ছে- মুসলিম শিশু ও নারী হত্যা রোধে জাতিসংঘের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করা এ কথাই বারবার প্রমাণ করে। বিশ্বের মানবতাকর্মীদের বিবৃতির ধরন ও উদ্যোগ থেকে এমনটাই ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। বর্তমান ফিলিস্তিনে নারী ও শিশু হত্যার কিছু রিপোর্ট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুসলমান নির্যাতিত হলে বিবৃতিসর্বস্ব বুলিময় মানবতা বিলি করা ছাড়া কিছুই করে না মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
ফিলিস্তিনে নারী ও শিশুহত্যা : ফিলিস্তিনের গাজায় নির্বিচারে মানুষ হত্যা চলছে। দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ইসরাইল। নারী ও শিশুহত্যায় আগপিছ ভাবছে না তারা। একটি জাতিকে ধ্বংস করাই তাদের লক্ষ্য। নারী ও শিশুহত্যার এমন অমানবিক আচরণ থেকে তা-ই বোঝা যাচ্ছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিএইচআর) এর মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি গত শুক্রবার বলেছেন, ১৮ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত গাজা উপত্যকার বিভিন্ন আবাসিক ভবন ও বাস্তুচ্যুত মানুষের আশ্রয় নেয়া তাঁবুতে ইসরাইলের ২২৪টি বিমান হামলা চালানোর ঘটনা নথিভুক্ত করেছে তার দপ্তর। তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে ৩৬টি হামলার ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের বিষয়ে সংগৃহীত তথ্যে দেখা গেছে, তারা সবাই নারী ও শিশু।’ এছাড়া এ সপ্তাহের শুরুর দিকে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এক মাসের বেশি হয়ে গেল, গাজায় কোনো ত্রাণও যায়নি। সেখানে নেই কোনো খাবার, নেই জ্বালানি, নেই ওষুধ। নেই কোনো বাণিজ্যিক পণ্যের সরবরাহ।’ (গণমাধ্যমে প্রকাশ)।
অবরোধ ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ওপর ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত করছে। আর জাতিসংঘ বিবৃতি, তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ ছাড়া কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। এটা অপ্রিয় সত্য ও বেদনাদায়ক। গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ‘১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভাঙার পর গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৫০০ শিশু নিহত হয়েছে। গাজার স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত সোয়া ১ লাখ মানুষ। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি শিশু রয়েছে বলে জানিয়েছিল জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ। আহত হয়েছে ৩৪ হাজারের বেশি শিশু।’ গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন চলছে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে। এরপর দুই দফায় মোটামুটি ৫০ দিনের মতো বন্ধ ছিল আগ্রাসন। এই সময়ের মধ্যে অঞ্চলটিতে ১৭ হাজারের বেশি শিশুকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। আর ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে অনাথ হয়েছে ৩৯ হাজারের বেশি শিশু। ফিলিস্তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট মনিটর জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে ১৭ হাজারের বেশি শিশু নিহত হয়েছে।’
গাজার বর্তমান অবস্থা : ২ এপ্রিল থেকে ফিলিস্তিনের গাজায় কোনো ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। এতে গাজায় খাবার, পানি, জ্বালানিসহ জরুরি পণ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিকে ‘বিপর্যয়কর’ বলে উল্লেখ করেছেন ওসিএইচএর কর্মকর্তা ওলগা চেরেভকো। আল-জাজিরাকে জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা বলেন, ৪০ দিনের বেশি সময় ধরে তাদের হাতে কোনো ত্রাণ এসে পৌঁছায়নি। আগের মজুত প্রায় সব শেষ হয়ে গেছে। চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকট চলছে। উপত্যকাটির ৩৮টি হাসপাতালের মধ্যে ৩৪টিই ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজা কর্তৃপক্ষের হিসাবে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজার ৯০ শতাংশের বেশি পানি সরবরাহ অবকাঠামো ধ্বংস করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। সেগুলো মেরামত করতেও বাধা দিচ্ছে তারা। এ ছাড়া চলতি মাসের শুরুর দিকে গাজায় ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান মেকোরোত পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এতে উপত্যকাটির ৭০ শতাংশ পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
ইসলামিক স্কলারদের ফতোয়া : ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সরকারের ধ্বংসাত্মক আক্রমণের কারণে সমস্ত মুসলিম এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোকে জিহাদ করার জন্য ফতোয়া জারি করেছে বিশিষ্ট ইসলামি পণ্ডিতদের নিয়ে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলার্স (IUMS)। অবরুদ্ধ গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ১৭ মাস ধরে চলা ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পর ১৪ জন বিশিষ্ট মুসলিম পণ্ডিতের সমর্থনে এই ফতোয়া জারি করা হয়। ইউনিয়নের মহাসচিব আলী আল-কারাদাভি এক বিবৃতিতে বলেছেন, সমস্ত মুসলিম দেশকে এই গণহত্যা এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করতে অবিলম্বে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে।
‘ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতিতে সব মুসলিম রাষ্ট্রের ওপর এখন সশস্ত্র জিহাদ করা ফরজ’- পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে জাতীয় ফিলিস্তিন সম্মেলনে বক্তব্য দিতে গিয়ে বিশ্বের প্রখ্যাত ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের শরীয়া বেঞ্চের সাবেক বিচারপতি মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানি এ কথা বলেন। মুফতি তাকি উসমানি বলেন, আসল করণীয় ছিল আমরা এখানে জড়ো হওয়ার পরিবর্তে গাজায় গিয়ে জড়ো হওয়া। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা ফিলিস্তিনি মুজাহিদদের জন্য বাস্তবে কিছুই করতে পারিনি। ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য জান-মাল উৎসর্গ করা পুরো মুসলিম উম্মাহর ওপর ফরজ। তিনি বলেন, কালেমা পাঠ করা ৫৫ হাজারেরও বেশি মুসলিমকে নিহত হতে দেখে কি এখনো জিহাদ ফরজ হয়নি?
জিহাদ কখন ফরজ হয় : তিন অবস্থায় জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। ১. যখন (মোমিন-কাফের) উভয় বাহিনী লড়াইয়ের জন্য কাতারবন্দি হয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন উপস্থিত প্রত্যেক মুসলমানের জন্য পলায়ন করা হারাম এবং অটল থেকে জিহাদ করা ফরজে আইন। ২. কাফেররা কোনো এলাকায় আক্রমণ চালালে উক্ত এলাকার অধিবাসীদের উপর তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করা এবং তাদের প্রতিরোধ করা ফরজে আইন। ৩. ইমাম যদি কোনো সম্প্রদায়কে জিহাদে বের হতে আহ্বান করেন, তাহলে তাদের সকলের জন্য জিহাদে বের হওয়া ফরজে আইন।” (আলমুগনী: ১২/৪২৩, বিস্তারিত : বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৯১ ও ৭/৯৮, আলবিনায়া : ৭/৯৬, রদ্দুল মুহতার : ৪/১২৭)।
মুসলমানের করণীয় : গাজার বর্তমান পরিস্থিতিরভিত্তিতে ফিলিস্তিনি মুসলমানের প্রতি সংহতি প্রকাশে যার যার অবস্থান থেকে যে যেভাবে পারে সেভাবেই ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করা উচিত। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তাদের জন্য সামরিক সহায়তা, খাদ্য ও পানীয় ব্যবস্থা করা মুসলিম শাসকদের জন্য আবশ্যক দায়িত্ব।
সাধারণ জনগণের করণীয় : সাধারণ মুসলমানরা ইসরায়েলের এ গণহত্যার প্রতিবাদ করবে। তাদের এ হীন কর্মকে ঘৃণা করবে। ফিলিস্তিনি মুসলমানদের জন্য দোয়া অব্যাহত রাখবে। সাধ্য ও ফুরসত হলে রাষ্ট্র বা বিশ্বস্ত সংস্থার মাধ্যমে খাদ্যপানীয় ও বস্ত্র জোগান দেয়ার চেষ্টা করবে। ব্যক্তি জীবনে ইজরায়েলি পণ্য বর্জন করবে। শিশুদের গাজার ইতিহাস, বায়তুল মুকাদ্দাসের ইতিহাস শেখাবে। গত ১২ এপ্রিল রাজধানী ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্টের আয়োজনে ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ফিলিস্তিনের পক্ষে একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ঘোষণাপত্রে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়, তারা যেন ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং অবিলম্বে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের পক্ষ থেকে এটি ছিল একটি প্রতিবাদ। এভাবে সমন্বিত প্রতিবাদ ও ইসরায়েলি পণ্য বর্জন করার মাধ্যমে সাধারণ জনগণ ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানাবে। আর হৃদয়ে লালন করবে ইসলামের প্রথম কেবলা মসজিদে আকসার ভালোবাসা।
লেখক : মুহাদ্দিস ও গণমাধ্যমকর্মী