ঢাকা শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মসজিদে আকসার ফজিলত

ফয়জুল্লাহ রিয়াদ
মসজিদে আকসার ফজিলত

ফিলিস্তিন কোরআন ও হাদিসের আলোকে প্রমাণিত বরকতময় ভূমি। এই ভূমিতে রয়েছে অগণিত নবী-রাসুলের কবর। এটি কোরআন স্বীকৃত পবিত্র ভূমি। বর্ণিত হয়েছে, ‘মুসা (আ.) বলেন, হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তাতে প্রবেশ কর এবং পেছন দিকে প্রত্যাবর্তন কর না। অন্যথায় তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।’ (সুরা মায়েদা : ২১)। এখানে ‘পবিত্র ভূমি’ দ্বারা শাম ও ফিলিস্তিন অঞ্চলকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহতায়ালা নবী-রাসুল পাঠানোর জন্য এ ভূমিকে বেছে নিয়েছিলেন। তাই একে পবিত্র ভূমি বলা হয়েছে।

ফিলিস্তিনের জেরুজালেম শহরে অবস্থিত মসজিদে আকসা পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় প্রাচীনতম মসজিদ। কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর এটি নির্মিত হয়েছিল। কোরআন ও হাদিসে প্রাচীনতম এ মসজিদ ও তৎসংলগ্ন এলাকার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও অনেক ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে।

মেরাজের স্মৃতিধন্য : মসজিদে আকসা ইসরা ও মেরাজের স্মৃতিধন্য মসজিদ। এখান থেকেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঊর্ধ্বাকাশ ভ্রমণ আরম্ভ হয়েছিল। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার কাছে (মেরাজের রজনীতে) বোরাক আনা হলো। বোরাক গাধা থেকে বড় এবং খচ্চর থেকে ছোট। যতদূর চোখ যায়, এক পদক্ষেপে সে ততদূর চলে। তিনি বলেন, আমি এতে আরোহণ করলাম এবং মসজিদে আকসা পর্যন্ত এসে পৌঁছলাম। এরপর অন্যান্য নবীগণ যে রশিতে তাদের বাহন বাঁধতেন, আমি সেখানে আমার বাহন বাঁধলাম। অতঃপর মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলাম। জিবরাইল (আ.) একটি শরাব ও একটি দুধের পাত্র নিয়ে এলেন। আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। জিবরাইল (আ.) আমাকে বললেন, আপনি ফিতরাতকেই গ্রহণ করেছেন। তারপর তিনি আমাকে নিয়ে ঊর্ধ্বলোকে গমন করলেন।’ (মুসলিম : ১৬২)।

বরকতময় ভূমি : মসজিদে আকসার আশপাশের এলাকা তথা শাম ও ফিলিস্তিন অঞ্চলকে বরকতময় ভূমি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চারপাশে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, তাকে আমার কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ০১)।

দ্বিতীয় প্রাচীনতম মসজিদ : পৃথিবীর ইতিহাসে নির্মিত সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ হলো মসজিদে হারাম। এর পরেই দ্বিতীয় প্রাচীনতম মসজিদে আকসা। হজরত আবু জর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন মসজিদটি তৈরি হয়েছে? তিনি বললেন, মসজিদে হারাম। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদে আকসা। আমি বললাম, উভয় মসজিদ (তৈরির) মাঝে কতদিনের ব্যবধান ছিল? তিনি বললেন, ৪০ বছর।’ (বোখারি : ৩৪২৫)।

প্রথম কেবলা : ইসলাম ও মুসলমানদের প্রথম কেবলা ছিল মসজিদে আকসা। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের ষোলো কিংবা সতেরো মাস পর আল্লাহতায়ালা কেবলা পরিবর্তন করে কাবা শরিফকে কেবলা বানিয়ে দেন। সুরা বাকারায় বলা হয়েছে, ‘(হে নবী) নিশ্চয় আমি আপনাকে বারবার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব, আমি অবশ্যই আপনাকে সে কেবলার দিকেই ফিরিয়ে দেব যাকে আপনি পছন্দ করেন। সুতরাং আপনি মসজিদে হারামের দিকে চেহারা ফেরান এবং (ভবিষ্যতে) তোমরা যেখানেই থাকো (নামাজ আদায়কালে) তোমাদের চেহারা সেদিকেই ফেরাবে।’ (সুরা বাকারা : ১৪৪)। হজরত বারা ইবনে আজেব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে (মদিনায় হিজরতের পর) ষোলো কিংবা সতেরো মাস মসজিদে আকসার দিকে ফিরে নামাজ পড়েছি। অতঃপর আল্লাহতায়ালা তাকে কেবলার (কাবার) দিকে ফিরিয়ে দেন।’ (বোখারি : ৪৪৯২)।

তৃতীয় মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ : পৃথিবীর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ হলো মসজিদে হারাম। অতঃপর যথাক্রমে মসজিদে নববি ও মসজিদে আকসা। এই তিন মসজিদ ব্যতীত নিকটতম মসজিদ অতিক্রম করে কেবল নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে অন্যকোনো দূরের মসজিদে গমন করতে হাদিস শরিফে নিষেধ করা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মসজিদে হারাম, মসজিদে রাসুল (মসজিদে নববি) এবং মসজিদে আকসা, এই তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্যকোনো মসজিদে (নামাজের জন্য) হাওদা বাঁধা যাবে না। অর্থাৎ নামাজের উদ্দেশ্যে সফর করবে না।’ (বোখারি : ১১৮৯)।

নামাজের সওয়াব : সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ হলো মসজিদে হারাম। এখানে ইবাদত করতে পারলে সবচেয়ে বেশি প্রতিদান পাওয়া যায়। এখানের এক নামাজ অন্য জায়গার এক লাখ নামাজের সমান। দ্বিতীয় ফজিলতপূর্ণ হলো মসজিদে নববি। এখানের এক নামাজ অন্য জায়গার এক হাজার নামাজের সমান। তৃতীয় ফজিলতপূর্ণ হলো মসজিদে আকসা। এখানের এক নামাজ অন্য জায়গার পাঁচশত নামাজের সমান। হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মসজিদে হারামের নামাজ এক লাখ নামাজের সমান। আমার মসজিদের (মসজিদে নববির) নামাজ এক হাজার নামাজের সমতুল্য। আর মসজিদে আকসার নামাজ পাঁচশত নামাজের সমতুল্য।’ (মুসনাদে বাজ্জার : ৪১৪২)।

নিরাপদ ভূমি : কেয়ামত-পূর্ব সময়ে মসজিদে আকসা ও তৎসংলগ্ন এলাকা দাজ্জালের ভয়াবহ ফেৎনা থেকে নিরাপদ থাকবে। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, দাজ্জাল পৃথিবীতে ৪০ দিন অবস্থান করবে। চারটি মসজিদ ব্যতীত তার কর্তৃত্ব সমগ্র পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করবে। মসজিদে হারাম, মসজিদে নববি, মসজিদে আকসা ও মসজিদে তুর। এই চারটি মসজিদ তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকবে। (মুসনাদে আহমাদ : ২৩১৩৯)।

হাশরের ময়দান : কেয়ামতের দিন মসজিদে আকসা হবে হাশরের ময়দান। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস থেকে এমনটাই প্রমাণিত হয়। হজরত মাইমুনা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! মসজিদে আকসা সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন। তিনি বললেন, কেয়ামতের দিন এটা হবে হাশরের ময়দান। এখান থেকে মানুষ নিজ নিজ গন্তব্যে যাবে। তোমরা এখানে এসো এবং নামাজ আদায় করো।’ (মুসনাদে আবু ইয়ালা: ৭০৮৮)।

বিশেষ দোয়া : হজরত সুলাইমান (আ.) মসজিদে আকসার নির্মাণকাজ শেষ করার পর তিনটি বিশেষ দোয়া করেছেন। তন্মধ্যে একটি দোয়া মসজিদে আকসার জিয়ারতকারীদের জন্য। রাসুলুল্লাহ (সা.)ও এই দোয়া কবুল হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। দোয়াটি হলো, ‘কেবল নামাজের উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি এই মসজিদে গমন করবে, আল্লাহতায়ালা যেন তাকে সেদিনের মতো নিষ্পাপ করে দেন, যেদিন সে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।’ (সুনানে নাসায়ি : ৬৯২)।

আকসার সান্নিধ্য : মসজিদে আকসার আশপাশে বসবাস করা অনেক সৌভাগ্যের বিষয়। হজরত আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অচিরেই এমন সময় আসবে, তখন কেউ যদি ঘোড়ার রশি পরিমাণ এমন জায়গা পেয়ে যায়, যেখান থেকে মসজিদে আকসা দেখা যায়, তবে এটা তার জন্য গোটা দুনিয়া অপেক্ষা উত্তম।’ (আল মুজামুল আওসাত : ৬৯৭৯)।

হকপন্থিদের অবস্থানস্থল : মসজিদে আকসার আশপাশে বসবাসকারীদের মধ্যে একটা দল সবসময় সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে বলে হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয়। হজরত আবু উমামা বাহিলি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের একটা জামাত সবসময় সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তারা শত্রুদের উপর বিজয়ী থাকবে। তাদের সঙ্গ ত্যাগ করে কেউ তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। অবশেষে আল্লাহর নির্দেশ আসবে এবং তারা এভাবেই থেকে যাবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, এই দলটির অবস্থানস্থল কোথায় হবে? তিনি বললেন, মসজিদে আকসা ও তার আশপাশে?।’ (মুসনাদে আহমাদ : ২২৩২০)।

চূড়ান্ত লড়াই : পৃথিবীর শুরুলগ্ন থেকেই সত্যমিথ্যার লড়াই চলছে। কেয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। মিথ্যা সবসময়ই সত্যের সামনে মাথানত করবে। তবে কেয়ামত-পূর্ব সময়ে সত্যমিথ্যার চূড়ান্ত লড়াই হবে মসজিদে আকসা অঞ্চলে।

এতেও সত্যের বিজয় হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যতক্ষণ মুসলমানরা ইহুদিদের সঙ্গে লড়াই করে তাদের হত্যা না করবে, ততদিন কেয়ামত সংঘটিত হবে না। এমনকি ইহুদিরা যে পাথর কিংবা গাছের আড়ালে আত্মগোপন করবে, সে পাথর এবং গাছও বলে ওঠবে, হে মুসলিম! হে আল্লাহর বান্দা! এই যে আমার পেছনে ইহুদি আছে, এসো তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক বৃক্ষ কিছু বলবে না। কারণ এটা ইহুদিদের গাছ।’ (বোখারি : ২৯২৬)। আল্লাহতায়ালা ফিলিস্তিন ও গাজ্জাবাসীকে নিরাপদ রাখুন। মসজিদে আকসার স্বাধীনতা রক্ষায় মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করে দিন। মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের সুমতি দান করুন।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুস সুন্নাহ রাজাবাড়ী, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত