সামরিক সরঞ্জাম তৈরি ও ব্যবহারে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান

প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  মুহাম্মদ আবু জাফর হুসাইন

মুসলমানরা বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের মতো সামরিক বিজ্ঞানেও প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। ষষ্ঠ থেকে পরবর্তী ২০০ বছরের ভেতরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রন্থ পাওয়া যায়। সম্ভবত ক্রুসেডের কারণেই মুসলিম সামরিক বিশেষজ্ঞরা এদিকে মনোযোগ দেন। সামরিক বিষয়ে লেখা বইগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। প্রথমটি ফুরুসিয়া, যা ঘোড়সওয়ার বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দ্বিতীয়টি ধনুরবিদ্যা এবং তৃতীয়টি সামরিক সংগঠন ও অস্ত্রশস্ত্রবিষয়ক। এই তিন বিষয়ের ৫০টির মতো বই এখনও টিকে আছে। সবচেয়ে বিখ্যাত বই হলো সুপরিচিত মুসলিম বীর নাযম আল-দীন আইয়ুব আল আহদাব হাসান আল রাম্মাহ (ইন্তেকাল হিজরি ৬৯৪, ১২৯৫ ঈসায়ি) তার রচিত কিতাব ‘আল ফুরুসিয়া বিরাসসম আল জিহাদ’। সে সময় মুসলমানদের সংগঠিত অশ্বারোহী সৈন্যদল, অস্ত্র ও প্রয়োজনীয় ট্রেনিং সবই ছিল। এজন্যই তারা সারা বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল।

নিক্ষেপ যন্ত্র : সাধারণ ভাষায় যাকে গুলতি বলা হয়, সে রকম যন্ত্রই ক্লাসিক্যাল সময়ে মিসাইলের মতো কাজ করত। ইস্তান্বুুলের তোপকাপি সারাই জাদুঘরে সংরক্ষিত হিজরি অষ্টম (চতুর্দশ ঈসায়ি) শতাব্দীর কিছু পা-ুলিপি থেকে বোঝা যায়, সে সময় মিসাইল নিক্ষেপের কলাকৌশল কী রকম ছিল। দুটি কাঠের টাওয়ারের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত অক্ষদ-। এর সঙ্গে সংযুক্ত একটি কাঠের মাস্তুল এরকম হচ্ছে একটি যন্ত্রের গঠন। যন্ত্রের ছোট বাহুটার সঙ্গে বেশ কয়েক গোছা রশি আটকানো থাকত, কখনও রশির বদলে শক্ত কাঠ। এরকম আরও কিছু নমুনার বিবরণ বেশ কিছু সংরক্ষিত পা-ুলিপি থেকে পাওয়া যায়।

রকেট : রকেটের কাজ ছিল আগুনে বস্তু অর্থাৎ গোলা নিয়ে উড়ে যাওয়া। বহুল ব্যবহৃত রকেটগুলো অনেকটা তীরের মতো ছিল। এটি আগুনে বোমা ব্যবহার করত। মাহীসুরের টিপু সুলতান সার্থকভাবে হিজরি ১১৯৪ (১৭৮০ ঈসায়ি) সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন। তার রকেট অনেক উন্নত ছিল। তিনই ধাতব সিলিন্ডারের রকেট ব্যবহার করেন। এছাড়া মুসলিমদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের রকেটের নাম শোনা যায়। যেমন : তাইয়ার, আল মজনু ইত্যাদি।

টর্পেডো : পানিতে চলাচল করতে পারে এমন টর্পেডোর নকশা আল রাম্মাহর গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়। লৌহপাতের ভেতর বারুদ পুরে দেওয়া হতো। রকেটের সাহায্য নিয়ে এটি পানিতে ধাবমান হতাে। তৎকালীন মুসলিম সাম্রাজ্যে টর্পেডো অবশ্যই অনেক বড় এক যুদ্ধাস্ত্র ছিল।

সোরা বা যবক্ষার : সোরা বা যবক্ষার প্রকৃতপক্ষে পটাসিয়াম নাইট্রেট। হিজরি ৮০০ (১৫০০ ঈসায়ি) সালের পর থেকে এটি মুসলিম বিশ্বে পরিচিত হয়ে আসছে। অথচ ব্রিটিশরা এর সঙ্গে পরিচিত আরও ২০০ বছর পর থেকে। সুতরাং মুসলিমরাই এটি আবিষ্কারের দাবি রাখে। আবার বারুদ শব্দটা আরবি থেকেই প্রাপ্ত। পটাশিয়াম নাইট্রেট পরিশুদ্ধকরণ প্রথম বর্ণনা করেন ইবনে বাখতাওয়াহ হিজরি ৪২০ (১০২৯ ঈসায়ি) সালে তার আল মুকাদ্দিমাত নামক বইতে। এছাড়া পরিপূর্ণভাবে হাসান আল রাম্মাহ তার বিখ্যাত আল ফুরুসিয়া আল মানাসিব ওয়া হারবিয়্যাহ বইতে। সামরিক কাজে এই বারুদ ব্যবহার করা হতো।

গ্রেনেড : আগ্নেয় পদার্থ ভর্তি পাত্রের আকার ছোট থেকে বড় যেকোনো হতে পারে। মূলত সাধারণ আকারের আগ্নেয় ভর্তি পাত্রকে কারাজ (গ্রেনেড) বলা হত। কাচ বা কাদা দিয়ে এটি তৈরি হতো। কারাজের সবচেয়ে বড়টির নাম কিদর। নিক্ষেপণ যন্ত্রের সাহায্যে এটি নিক্ষেপ করা হতো। ৬৬৮ থেকে ৬৭৮ হিজরি (ঈসায়ি ১২৭০-৮০) সালের ভেতরে লিখিত সামরিক গ্রন্থ হাসান আল রাম্মাহের আল ফুরুসিয়া আল মানাসিব ওয়া হারবিয়্যাহ বই থেকে এসবের বর্ণনা পাওয়া যায়।

বিস্ফোরক পদার্থ : বর্তমানে বিস্ফোরক পদার্থ তৈরিতে যে যে উপদান ব্যবহৃত হয় হাসান আল রাম্মাহ তার ঠিক কাছাকাছি মিশ্রণের বর্ণনা তার বিখ্যাত ‘আল ফুরুসিয়া আল মানাসিব ওয়া হারবিয়্যাহ’ বইতে করে গেছেন। ৭৪ ভাগ সল্টপিটার, ১০ ভাগ সালফার, ১৫ ভাগ কার্বন। তিনি আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির ফর্মুলাও বর্ণনা করেন। তিনি আরও বলেন, এগুলোর অনেক কিছুই তার বাবা-দাদারাও জানতেন। এগুলো ষষ্ঠ হিজরি (১২ ঈসায়ি) শতকের কথা। অষ্টম হিজরি (১৪ ঈসায়ি) শতকের আগ পর্যন্ত চীন কিংবা ইউরোপ এগুলোর সম্পর্কে কিছুই জানত না। মধ্যযুগে ক্রুসেডের সময়ে যে মুসলমানরা বিস্ফোরক দ্রবের ব্যবহার করত তার বর্ণনাও পাওয়া যায়।

কামান : বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ থেকে পাওয়া যায়, মামলুক সেনাবাহিনী মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত হাল্কা কামান ব্যবহার করেন ৬৫৬ হিজরি (১২৫৮ ঈসায়ি) সালে। আর পাশ্চ্যাতে কামান ব্যবহার শুরু হয় হিজরি ৭৪৬ (১৩৪৬ ঈসায়ি) সালে ক্রেসির যুদ্ধে। তৎকালীন সময়ে কামানের ব্যবহার যুদ্ধক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য বয়ে আনত। ইতিহাসবিদ , বিশ্বকোষ প্রনেতা শিহাবুদ্দিন আবুল আব্বাস আহমাদ ইবন ইয়াহইয়া ইবন ফাদলুল্লাহ আল উমারি (৭০০-৭৪৯ হিজরি; ১৩০১-১৩৯৪ ঈসায়ি) মামলুক সাম্রাজ্যের একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি ছিলেন। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে অন্যতম আল-তারিফ বিল মুস্তালাহ আল শরিফ। এই বইতে জনপ্রিয় ছয় ধরনের নিক্ষেপক যন্ত্রের বর্ণনা করেছেন একটি আলাদা অধ্যায়ে। স্পেনে অনুষ্ঠিত ৭৪০-৭৪৩ হিজরি (১৩৪০-১৩৪৩ ঈসায়ি) সনের প্রতিটি যুদ্ধে কামানের ব্যবহার হয়ে ছিল। আবার সপ্তম হিজরি শতকে কুবলাই খানের আমল থেকেই মুসলমানেরা ক্ষেপণাস্ত্র বানান। চীনা সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আলাদ্দিন এবং ইসমাইল হিজরি ৬৬৯-৬৭১ (ঈসায়ি ১২৭০-১২৭২) সালের ভেতরে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেন।

আগ্নেয়াস্ত্র : ফাতহুল্লাহ সিরাজি মুঘল আমলেই মেশিনগান তৈরি করেন। এখানে বারুদ ব্যবহৃত হতো। আবার আব্বাসীয় সেনাদলে আগ্নেয়াস্ত্র বিশেষজ্ঞ সৈন্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদের বলা হতো নাফফাতুন, এরা অগ্নিনিরোধক কাপড় পরিধান করত। আবার মামলুক সৈন্যরা ১০-১১ হিজরি (১৬-১৭ ঈসায়ি) শতকের দিকে আবুস নামক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতেন। এটা বেশ উন্নতমানের ছিল।

অগ্নিনিরোধক কাপড় ও অন্যান্য : মিশরিয়রা ৬৫৮ হিজরি (১২৬০ ঈসায়ি) সালে আইন জালুতের যুদ্ধে প্রথম অগ্নিনিরোধক কাপড় ব্যবহার করেন। এছারা দুর্গ নির্মাণ, তলোয়ার নির্মাণ, তির-ধনুক নির্মাণে মুসলমানদের অগ্রগণ্য এবং অসাধারণ পারদর্শিতা দেখান।

নৌবাহিনী : যেকোনো সাম্রাজ্যে শক্তিশালী বুনিয়াদ রচনা করে কার্যকর নৌবাহিনী। মুসলমান শাসকরা তাদের অধিকৃত অঞ্চল বিস্তারের নিমিত্তে নিজস্ব নৌবাহিনী গঠনসহ এর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণে ব্রতী হন। ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়, উত্তর আফ্রিকা এবং স্পেন বিজয়ের ৪০ বছর পর মুসলিম নৌবাহিনী পুরো ভূমধ্যসাগরে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপনে সচেষ্ট হন এবং এই গৌরব পরবর্তী ২০০ বছর পর পর্যন্ত অক্ষুণœ থাকে। ২১১ হিজরি (ঈসায়ি ৮২৬) সালে উত্তর আফ্রিকা থেকে মুসলিম বাহিনী অগ্রসর হয়ে সিসিলি অধিক্রমণ করেন এবং ইতালি ও দক্ষিণ ফ্রান্সের উপকূলে প্রচেষ্টা চালান।

‘শিনি’ নামক ১৪৩টি দাঁড় বিশিষ্ট বিশালাকার যুদ্ধজাহাজের সন্ধান পাওয়া যায়, ৩৪৬ হিজরি (৯৫৭ ঈসায়ি) সালের দিকে ফাতেমীয় খলিফ মুইজ্জলি দীনিল্লাহ মিসরের মাকসের ডকইয়ার্ড থেকে ৬০০টি শিনি যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণ করেন। ‘বুত্তাসা’ নামে আরেকটি যুদ্ধজাহাজের নাম পাওয়া যায়। এই ছিল পালতোলা। এটি ৪০টি পাল, ১৪০০-১৫০০ অস্ত্রধারী নাবিক নিযুক্ত থাকতেন। এই জাহাজের অগ্রভাগ হত সুচালো, কাকের পায়ের মতো।

এছাড়া ছিল কার্গো বহনের জন্য জাহাজ শালান্দি এবং রসদ বহনকারী জাহাজ কুরকুরা। বড় জাহাজের পাশাপাশি নৌবাহিনীতে অন্যান্য ছোট ছোট জাহাজও অন্তর্ভুক্ত থাকত। রসদ বহন, শত্রুপক্ষের অবস্থান জানার জন্য, বড় জাহাজ ও তিরের যোগাযোগ প্রভৃতি কাজে ছোট জাহাজ ব্যবহৃত হতো। এদের বেশিরভ হতো দাঁড়টানা। এছাড়া শুব্বাবা নামে পালতোলা জাহাজেরও সন্ধান পাওয়া যায়। তখনকার সময়ে জাহাজগুলো আগ্নেয় গোলাবারুদের রসদ, কামান কিংবা নিক্ষেপক ব্যবহার করত। প্রথমে এসব নিক্ষেপকের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের শক্তি কমিয়ে তারপর সরাসরি আক্রমণ সূচিত হতো। আল-রাম্মাহ তার রচিত গ্রন্থে এরকম এক যুদ্ধ সাজে সজ্জিত নৌবহরের বিবরণ পাওয়া যায়।