ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দিনাজপুরে পাঁচ শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ স্মরনে

মহারাজা দিবস আজ

মহারাজা দিবস আজ

দিনাজপুর জেলার ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর দিন আজ শুক্রবার ৬ জানুয়ারি। ১৯৭২ সালের এই দিনে দিনাজপুর শহরের মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুলের ট্রানজিট ক্যাম্পে ভয়াবহ মাইন বিস্ফোরণে ৫ শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। এই দিবস উপলক্ষ্যে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদ, মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুল ও দিনাজপুর প্রেসক্লাব বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

জানা গেছে, ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে দেশ স্বাধীনের পর দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়ীর মহারাজা হাই স্কুলে স্থাপন করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প। বিজয় অর্জনের পর ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ক্যাম্পে এসে সমবেতন হন দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ আশপাশের জেলাগুলোর বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হামজাপুর, তরঙ্গপুর, পতিরাম ও বাঙালবাড়ি ক্যাম্পের বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখানে সমবেত বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮ শতাধিক। রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে শত্রুদের পুঁতে রাখা মাইনমুক্ত করতে সমবেত বীর মুক্তিযোদ্ধারা কাজ করছিলেন। ক্যাম্প থেকে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা বেরিয়ে পড়তেন পাক সেনাদের ফেলে যাওয়া, লুকিয়ে রাখা ও পুতে রাখা মাইন ও অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের সন্ধানে। সন্ধ্যার দিকে উদ্ধারকৃত মাইন ও অস্ত্রাদি জমা করা হতো মহারাজা স্কুলের দক্ষিণাংশে খনন করা বাংকারে।

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রুটিন ওয়ার্কের এক পর্যায়ে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। উদ্ধারকৃত অস্ত্র বাংকারে নামানোর সময় অসতর্ক মুহূর্তে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে একটি মাইন পড়ে যায়। এতে করে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাংকারের পুরো অস্ত্রভান্ডার বিস্ফোরিত হয়। ভয়াবহ ও বিকট বিস্ফোরণে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হয় মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গনসহ এর আশপাশের এলাকায়। এতে পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং বহুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার চরাড়হাট গ্রামের আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ জানান, সেদিন মাইন বিস্ফোরণে কতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায়নি। তবে সকালের রোলকলে উপস্থিত ছিলেন ৭৮০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সাড়ে ৪শ’ বীর মুক্তিযোদ্ধা তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তিনিসহ ক্যাম্পে অবস্থানরত অনেক মুক্তিযোদ্ধার হাত-পা, মাথা অনেক দূরে ছিটকে যায়। দুর্ঘটনার পর পরই শতাধিক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ভর্তি করা হয়েছিল দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল ও সেন্ট ভিসেন্ট মিশন হাসপাতালে। এদের মধ্যে থেকে পরে ২৯ জন মারা যান। তাকে ভর্তি করা হয়েছিল দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে ১৭ দিন চিকিৎসার পর তা জ্ঞান ফিরে। পরে তাকে ভারতের কলিকাতার একটি হাসপাতালে সাড়ে ৪ মাস চিকিৎসার পর শরীরের বাম পা কেটে ফেলে দেশে ফিরে আসে। এখন এই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা সরকারি ভাতা পান। ওই দুর্ঘটনায় তার মতো আরো ৩৭ জন মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন স্থানে জীবিত থেকে সরকারি ভাতা পাচ্ছে।

দিনাজপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল হক ছুটু জানান, ঘটনার সময় তিনি তার শহরের বাসাতেই অবস্থান করছিলেন। দুর্ঘটনার পর শহরের সব স্তরের মানুষ ঘটনাস্থলে গিয়ে জীবিত ও মৃত্যুদের উদ্ধার করে। যারা আহত ছিল তাদেরকে চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সে সময় হাসপাতালের পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও ঔষধপত্র না থাকায় ঠিকমত চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়নি। তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনার পরদিন ৭ জানুয়ারি দিনাজপুর গোর-এ শহীদ বড় ময়দানে শহীদদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে সামরিক মর্যাদায় ১২৫ জন শহীদের লাশ দাফন করা হয় ঐতিহাসিক চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে। এরপর চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে আরো দাফন করা হয় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করা ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধা লাশ। নিহতদের মধ্যে সে সময় ৫৮ জনের নাম পরিচয় পাওয়া যায়। পরে পর্যায়ক্রমে পাওয়া যায় আরো ৬৪ শহীদদের নাম ও পরিচয়। দিনাজপুরবাসীর দাবীর প্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুর গোর-এ শহীদ বড় ময়দানে জনসভায় ৬ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রাজেডিস্থলে শহীদদের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক আজহারুল আজাদ জুয়েল জানান, দিবসটি যথাযথ পালনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ই জানুয়ারি সকাল ৯টায় স্মৃতি পরিষদের সদস্যসহ সর্বস্তরের জনগণ দিনাজপুর প্রেসক্লাবে সমবেত হয়ে চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের জন্য রওনা হবেন। শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ শেষে মহারাজা স্কুল অবস্থিত শহিদ স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা অর্পণ করবেন। বাদ আছর মহারাজা স্কুল মসজিদে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পারলৌকিক মুক্তি কামনায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত