এক সময়ের ছাত্রনেতা দিনাজপুরের ফেরদৌস আর তার স্ত্রী সাথীর বাড়ি ঠাকুরগাঁও। তারা দুজনে এখন দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার রাজাবাসর গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাদের পরিচয় হয়। ২০০৮ সালে তারা বিয়ে করেন। সিরাজুম মুনিরার সাথীর কর্মস্থল জেলা শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে রেল জংশন খ্যাত গ্রামীণ শহর পার্বতীপুরে। আর ফেরদৌস জেলা সদরে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন। পেশাগত ও পারিবারিক দায়িত্ব পালনের পরও তারা নতুন কিছু করার ভাবনার একপর্যায়ে প্রক্রিয়াজাত পাটজাত দ্রব্য নিয়ে কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই এলাকাগুলোতে তাঁতের কাজ চালু থাকলেও নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় শাড়ি ও অন্যান্য সুলভ কাপড়ের দাপটে তাঁতশিল্প বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে এখানে এ ধরনের সৌখিন কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো কারিগর খুঁজে পাওয়া যায় না। নিজেদের প্রয়োজনে ফেরদৌস-সাথী দম্পতি এই কাজে আগ্রহী নারীদের সংগঠিত করতে থাকেন। কিন্তু কাজটি তারা যতটা সহজ মনে করেছিলেন, বাস্তবে সেটি তত সহজ ছিল না। সংসারের কাজ ফেলে বাড়ির বাইরে গিয়ে নারীদের কাজ করার ব্যাপারে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও বোঝাতে হয়েছে। তাদের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় অবশেষে তৈরি হয় কাজের উপযোগী পরিবেশ। রংপুর থেকে প্রশিক্ষক এনে প্রথমে শ্রমিকদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেয়া হয়। একটু একটু করে এগোতে থাকে কাজ। মাত্র ২০ জন নারী শ্রমিককে সঙ্গে নিয়ে ২০১৭ সালে শুরু হয় ফেরদৌস-সাথী দম্পতির ‘সুতার কাব্য’।
সেখানে তৈরি হতে থাকে পুতুল, ফ্লোর ম্যাট, প্লেস ম্যাট, ফ্লোর র্যাগ, টেবিল রানার, ব্যাগ, শতরঞ্জি, ওয়াল হ্যাঙ্গিং, প্ল্যান্ট হ্যাঙ্গিং, প্ল্যান্ট বাস্কেট, লন্ড্রি বাস্কেট, টুল/মোড়া, টয়েজ, মিরর, উডেন শো পিস, গ্লাস কোস্টার, কুশন কভার, এপ্লিক বেড কভার, পেন হোল্ডার, বুকমার্ক, গ্রেটিংস কার্ড, কি হোল্ডার, কিডস রাগ, টাফটিং রাগ। সময়ের ধারাবাহিকতায় সুতার কাব্য আগামী ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকায় অনুষ্ঠিতব্য নিউইয়র্ক নাউ মেলায় অংশ নিতে যাচ্ছে। বর্তমানে পার্বতীপুর-দিনাজপুর সড়কের কোলঘেঁষে ১০ কাঠা জমির ওপর কারখানা গড়ে তুলেছেন ফেরদৌস-সাথী দম্পতি। সেখানে ৭০ জন শ্রমিক দিন-রাত বুনে চলেছেন স্বপ্নের পসরা।
কর্মরত শ্রমিকরা জানান, প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করে থাকেন। সে টাকা দিয়ে সংসার ও সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালান। সাথীর স্বামী ফেরদৌস আহমেদ বলেন, সাথীর ইচ্ছাশক্তি আর নিষ্ঠার কারণে সুতার কাব্য এগিয়ে চলছে। চাকরি করে সংসার সামলে বিকল্পধারার একটি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে অসম্ভব ইচ্ছাশক্তি প্রয়োজন। আমি ছুটির দিনগুলোতে তাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।
তবে মূল কাজগুলো শক্তহাতে সাথীকেই সামাল দিতে হয়। মনমথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওয়াদুদ আলী শাহ বলেন, সুতার কাব্য প্রতিষ্ঠানটি আমি ব্যক্তিগত ভাবে ভিজিট করে আসছি। সেখানে আমার ইউনিয়নের প্রায় ৫০ জন নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাদের হাতের পাটের সুতা দিয়ে তৈরিকৃত পণ্য দেশ ও দেশের বাহিরে যাচ্ছে। তাতে ফেরদৌস ও সাথী দেশে বসে বেকারদের কর্মসংস্থান ও পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন।