ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক পোলট্রি খামারিরা খাদ্যের অত্যাধিক মূল্য ও কর্পোরেট হাউজের সিন্ডিকেটের ফলে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। গত এক বছরে ৩০০ এরও অধিক খামারি আর্থিকভাবে দারুণ লোকসানের ফলে তাদের এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
দিনাজপুরের বিভিন্ন উপজেলার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক পোলট্রিরা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে এখন বিকল্প পেশার অন্বেষণ করছেন। পোলট্রি ফিডস, মেডিসিন ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় ভার কয়েকগুন বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই তারা লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যবসায় চলে যাচ্ছেন। খামারিদের অভিযোগ সরকারি নজরদারী ও পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় এবং বড় বড় কর্পোরেট হাউজের দৌরাত্ম্য তাদের ব্যবসাকে এখন গুটি কয়েক বৃহৎ ব্যবসায়ীদের নিরাপদ পেশায় পরিণত হয়েছে। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে স্বাভাবিকভাবেই এখন এক বছরে দিনাজপুরে ৩ শতাধিক পোলট্রি খামার বন্ধ করতে বাধ্য হন খামারিরা।
প্রান্তিক খামারিরা বলেন, বর্তমান বাজারে একটি ডিম উৎপাদনে ব্যয় হয় ৯ টাকা ৪০ পয়সা। আর সেই ডিম পাইকারি মূল্যে বিক্রি করে পাওয়া যায় ৮ টাকা ৭৫ পয়সা। প্রতিটি ডিমে লোকসান গুনতে হচ্ছে ৬৫ পয়সা। পাশাপাশি ১ কেজি মাংসের উৎপাদন খরচ পড়ে ১৬৬ টাকা ৩১ পয়সা। আর সেই মাংস কেজিপ্রতি বিক্রি করতে হয় ১৫০ টাকা। এখানেও কেজি প্রতি লোকসানের হার ১৬ টাকা। এভাবে সব ক্ষেত্রে খামারিদের প্রতি লোকসান গুনতে হচ্ছে। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আলতাফ হোসেন জানান, জেলায় ১৯৭টি লেয়ার খামার ৯০০টি ব্রয়লার, ৭৯০টি সোনালি মুরগির খামারসহ প্রায় ২ হাজার পোলট্রি ও লেয়ার খামার রয়েছে। তবে জেলার ১৩টি উপজেলায় ছোট ও বড় ও মাঝারি মিলিয়ে সর্বমোট খামারের সংখ্যা ৫ হাজারের অধিক। এসব খামারে ৫০০ থেকে ১ লাখ পর্যন্ত মুরগি রয়েছে। আর খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ হাজারের অধিক মানুষের। জেলায় বছরে ডিম উৎপাদন হয় ৪৮ কোটি ৭৬ লাখ। আর মাংসের উৎপাদনের পরিমাণ ২ লাখ ৮৫ হাজার কেজি। দিনাজপুরের স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত ডিম ও মাংস আশে পাশের জেলাগুলোতে পাঠানো হয়।
প্রাণিসম্পদ বিভাগ সব শ্রেণি খামারিদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিলেও সরকারি কোনো নীতিমালা ও পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় বৃহৎ কর্পোরেট হাউজের থাবায় বেসামাল ও দিশাহারা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিরা। লেয়ার খামারি মাসুদ আলী জানান, প্রতি কেজিতে কাচামাল কিনে নিজেরা ফিড তৈরি করলে খরচ পড়ে ৫৩ থেকে ৫৪ টাকা। আর বড় বড় কোম্পানির তৈরি ফিড বাজারে কিনতে গেলে তার দাম পড়ে কেজিপ্রতি ৬০ টাকা। তিনি বলেন, ২ বছর আগে প্রতি কেজি ভুট্টা কিনেছি ২৩ টাকা দরে। আর এখন সেই ভুট্টা কিনতে হয় ৪০ টাকা কেজি দরে। তিনি বলেন, একই ভাবে ৫০ কেজি ওজনের সোয়াবিনের বস্তা ২ হাজার ২০০ টাকার স্থলে ৪ হাজার ২০০ টাকা, ১ হাজার ২০০ টাকার রাইস ব্র্যান্ড ২ হাজার ৭০০ টাকা, ৪০০ টাকার লাইমস্ট্রোন ৭০০ টাকা, ৭ হাজার টাকা ডিএল মিথিওনিন ১০ হাজার টাকা, ৫ হাজার টাকার লাইসিন ৭ হাজার টাকা এবং ৬০০ টাকার খাবার সোডার বস্তা এখন ১ হাজার ৭০০ টাকা কিনতে হয়। ওষধ ও ভ্যাকসিনের দামও বেড়েছে কয়েকগুণ।
দিনাজপুর সদর উপজেলার পুলহাট এলাকার নুসাইবা এগ্রো ফার্মের খামারি নুর ইসলাম জানান, ১ হাজার মুরগির বাচ্চা ৬৫ হাজার টাকা করে কিনে খামার শুরু করেন। ৪ সপ্তাহে বিক্রির উপযোগী হয় মুরগির বাচ্চাগুলো এই পুরো সময় থেকে বাজারজাত করা পর্যন্ত মোট খরচ পড়েছে ৩ লাখ ১৬ হাজার টাকা। সর্বোচ্চ মাংস পাব ২ হাজার কেজি। মাংসের কেজি প্রতি ১৫০ টাকা দরে বিক্রি করে লোকসান গুনতে হচ্ছে কেজি প্রতি ১৬ টাকা। এভাবে কি আর ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব? দিনাজপুর শহরের প্রধান বাজার বাহাদুর বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির মাংস বিক্রি হয় ১৮০ টাকা কেজি আর খুচরা ডিম ৪২ টাকা হালি। খামারিদের অভিযোগ বাজার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। বড় বড় কর্পোরেট হ্উাসের ডিম ও মাংস উৎপাদনকারীরা প্রতিদিন সকালে সেদিনের দর নির্ধারন করে দেন। পশু খাদ্য বিক্রেতা প্রবীর কুন্ডু বলেন, পোলট্রি খাতে প্রতিটি পণ্যের দাম আগের তুলনায় ৩ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ভুট্টা দিয়ে চাহিদা পূরণ না হওয়ায় ভুট্টা আমদানি করতে হয়। কিন্তু সোয়াবিনের চাহিদা পূরণ হওয়ার পরও দাম কমছে না। দিন দিন পোলট্রি পণ্যের দাম বেড়েই চলছে।
দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্সের এক কর্মকর্তা বলেন, খামারিদের জন্য কোনো সরকরি নীতিমালা না থাকায় পোলট্রি শিল্প এখন হুমকির সম্মুখিন। যখন তখন ভারতীয় ডিম, বাচ্চা ও ওষুধ বাজারে আসছে। সেজন্য মোট খামারির ৪০ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিরা এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন পাশাপাশি সাধারণ ভোক্তাদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ব্যয়ভার। তাই খামারিদের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি সাধারণ ভোক্তাদের কমদামে ডিম ও মাংস কেনার সুযোগ দেয়ার জন্য অবিলম্বে সরকারি নজরদারি ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন বলে সবাই মনে করেন।