ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

লন্ডনে পড়াশোনা দেশে গরুর খামার

লন্ডনে পড়াশোনা দেশে গরুর খামার

লন্ডন নিউক্যাসল শহরের কেলে ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় স্নাতক করা রাকিবুল ইসলাম রাকিবের চোখে এখন ভিন্ন স্বপ্ন। বিদেশে লেখাপড়া করে দেশে ফিরে গড়েছেন গরুর খামার। আর খামারের স্বপ্ন নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন রাকিবুল ইসলাম রাকিব। তার স্বপ্নের সুতো ধরে অন্যরাও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। রাকিবের ভালো লাগে সারা দিন পরিশ্রম শেষে মানুষ যখন মাংস, দুধ আর দুধ থেকে তৈরি ভালোমানের খাবার কিনতে পান। দুধ থেকে মিষ্টান্ন খাবার তৈরি করে পেয়েছেন জনপ্রিয়তাও। সেই জনপ্রিয়তা থেকে ভোক্তাদের কাছে এখন সে মিঠাই রাকিব নামে পরিচিত।

জানা যায়, বগুড়া শহরের সান্তাহার রোডের নামাজগড়ে জন্ম রাকিবুল ইসলাম রাকিবের। বাবা রফিকুল ইসলাম ঠিকাদার ও রড সিমেন্টের ব্যবসা করেন। শৈশবকালে গরু দেখতে তার ভালো লাগত। কিন্তু ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণে গরুর কাছাকাছি থাকার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। লেখাপড়ায় মনোযোগী হয়ে রাকিব বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন। ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডন নিউক্যাসল শহরের কেলে ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় স্নাতক অর্জন করেন। বিদেশে শিক্ষা জীবন শেষ করে ২০১৪ সালে দেশে ফিরে কিছু করার চিন্তা করেন। এই চিন্তায় শৈশবের সেই ভালোলাগা গরুর খামার গড়ার ভাবনা ভর করে। ২০১৫ সালে নিজ পরিবার ও স্বজনদের মাঝে ভালোমানের দুধ ও গরুর মাংসের চাহিদা মেটাতে ৫টি গাভী ও ৫টি ষাঁড় দিয়ে খামার শুরু করেন। পারিবারিকভাবে দুধের চাহিদা মেটাতে গিয়ে স্বজনদের সংখ্যা বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে দুধ সরবরাহের কাজ শুরু করেন। দুধের মান ভালো বলে ব্যাপক সাড়া পেয়ে যান তিনি। ডেইরি ফার্মের পাশাপাশি ২০১৮ সালে এসে বাণিজ্যিকভাবে সূরা এগ্রো ফার্ম নামে গরুর খামার শুরু করেন। বগুড়া সদর উপজেলার বানদিঘি সোনারপাড়ায় বাবার জমিতে এই খামার গড়েন।

প্রথমে কোরবানি ও কসাইদের জন্য গরু মোটাতাজাকরণ শুরু করেন। বাণিজ্যিকভাবে গড়া খামারটি করোনাকালে নানাভাবে এলোমেলো হয়ে যায়। তারপর আবার নানাভাবে গড়তে থাকেন গরুর খামারটি। বর্তমানে তার খামারে সব মিলিয়ে ৫১টি গরু রয়েছে। এরমধ্যে শাহীওয়াল, ব্রামহা, জার্সি, হলিস্ট্যান ফ্রিজিশিয়ান, নেপালি ও দেশীজাতের গরু রয়েছে। গরুগুলো কোরবানির ঈদে বিক্রি হবে। আর খামারের গাভীর দুধ থেকে নিয়মিত তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন স্বাদের ও নামের মিষ্টি, দই, ঘি, মাঠা, ঘোলসহ দুগ্ধজাত পণ্য। দুধ বিক্রির জন্য শহরের ৫টি স্থানে চুক্তিভিত্তিক সেল সেন্টার দিয়েছেন। দুধ থেকে তৈরি দুগ্ধজাত পণ্য দিয়ে জেলা শহরের সদর থানার সামনে শোরুম সাজিয়েছেন। নাম দিয়েছেন মিঠাই মেলা। মিঠাই মেলা শহরের মিষ্টান্ন ভোক্তাদের কাছে এখন অতি পরিচিত একটি নাম। পরিচিতি পাওয়ায় এখন অনেকেই রাকিবকে ভালোবেসে ডাকেন মিঠাই রাকিব নামে। যদিও সহযোগী হিসেবে মিঠাই মেলার সঙ্গে জড়িত আছেন আরো দুইজন।

সূরা এগ্রো ফার্ম সূত্রে জানা যায়, ফার্মটি গড়ার শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০টি গরু বিক্রি করেছেন। ২০২২ সালে এই ফার্ম থেকে রাকিবুল ইসলাম কোরবানির ঈদে ৪২টি গরু মোটাতাজা করে কেনাবেচা করেন। এবারো এই ফার্ম থেকে কোরবানির গরু বিক্রি শুরু হয়েছে। এবার তিনি ২৭টি কোরবানি যোগ্য করে তুলেছেন। ৮০ হাজার থেকে শুরু করে সাড়ে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত তার খামারে এবার কোরবানির গরু পাওয়া যাবে। ফার্মে যে দুধ উৎপাদন হয় তা বিক্রি হয় প্রতি লিটার ৬০ টাকা করে। আর রমজান মাস এলে দুধ বিক্রি হয় ৫০ টাকা লিটার দরে। গরুর খাবারের মূল্য বেশি। সে কারণে বিদেশি নেপিয়ার ঘাসের চাষ করছেন। সূরা এগ্রো ফার্মে তিন বিঘা পুকুরে চলছে মাছ চাষ। আছে বিদেশি সৌখিন পাখিও।

রাকিব বগুড়া জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর আয়োজিত প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনী ২০২২-এ ‘প্রাণি প্রদর্শনী ক্যাটাগরি’তে প্রথম স্থান এবং ২০২৩ সালে প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনীতে ‘প্রাণিজাত পণ্য উৎপাদন ও প্রযুক্তি ক্যাটাগরি’তে প্রথম স্থান অর্জন করেন।

শিক্ষিত ও সফল উদ্যোক্তা রাকিবুল ইসলাম রাকিব জানান, নিউজিল্যান্ড থেকে পড়ালেখা করে বগুড়ার তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব, লন্ডন ফেরত আতিফা এগ্রোর প্রধানকর্তা আব্দুর রহমান খামারি হিসেবে নিজেদের দাঁড় করিয়েছেন। তাদের পাশে গিয়ে তিনি প্রতিনিয়ত শিখছেন। সেই সঙ্গে বগুড়া সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুস সামাদ তাকে বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তিনি প্রতিনিয়ত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রেখেছেন। ছোট ভাই শাহারিয়ারসহ বাবা-মা, স্ত্রী সন্তানদেরও সহযোগিতা রয়েছে। তিনি বিদেশে লেখাপড়া করার সময় সে দেশের কৃষি ফার্ম পরিদর্শন করে জ্ঞান অর্জন করেন। সেটি তিনি দেশে ফিরে কাজে লাগান। লেখাপড়া করে চাকরি পাওয়া একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। ছোট্ট দেশে এত চাকরি কি করে দেবে, নিজেকে গড়তে হবে উদ্যোক্তা হিসেবে। উৎপাদনমুখী দেশ হলে চাকরিই জনবলকে ডাকবে। এসব চিন্তা করেই সূরা এগ্রো ফার্ম গড়েন। এই ফার্মে অর্ধশত গরু রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৭ জন শ্রমিক রয়েছে। মাংসের জন্য গরু আর দুধ থেকে পুষ্টিমানের দুগ্ধজাতীয় খাবার তৈরি করা হচ্ছে। এবার কোরবানির গরু বিক্রি হবে প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। আস্ত গরু ওজন মেশিনে তুলে মেপে নিতে হয়। গত বছর প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। এবছর গরুর খাবারের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। খামারিদের জন্য বড় সমস্যা গরুর খাবার ও ওষুধ। ‘শুধু গরুর খামারের আয় থেকে লাভ করা কঠিন। তাই মাংস উৎপাদনের পাশাপাশি দুধের খামার গড়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে ফিরে গরুর ফার্ম গড়বেন এমনটা ভাবেননি। কিন্তু শৈশবের চিন্তাটিই ঘুরে ফিরে আসে। ফার্ম গড়ার পর অনেক যুবকই তার ফার্ম বিষয়ে জানতে আসেন। গরু ও খামার গড়ার বিষয়টি জেনে যান।

সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুস সামাদ জানান, রাকিবুল ইসলাম রাকিব বিদেশে লেখাপড়া করে দেশে ফিরে গরুর খামার গড়েছেন। প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে তাকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করা হচ্ছে। রাকিবের মতো বেকারদের এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উদ্যোগী হতে পারলে সমাজের বেকারত্ব দূর হওয়ার পাশাপাশি আর্থিকগতি বৃদ্ধি পাবে। দেশ হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে রাকিবের মতো দক্ষ উদ্যোক্তার বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত