ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জীবন সংগ্রামে হার না মানা জয়িতারা

জীবন সংগ্রামে হার না মানা জয়িতারা

অর্থনৈতিক বা শিক্ষা ও চাকরিতে অথবা সমাজ উন্নয়নে, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে কিংবা সফল জননী হিসাবে এগিয়ে চলা ৫ নারী জীবনযুদ্ধের বাকিটা সময়ে হার মানতে নারাজ। এমনটাই জানালেন, কুমিল্লার তিতাসে এবারের ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক কার্যক্রমের সেরা জয়িতা হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া সারমিন আক্তার, আমিরন বেগম, রত্না আক্তার, শারমিন জাহান ও শাহিদা বেগম। মনোবল, অদম্য সাহস, সততা আর আপন কর্মের মাধ্যমে তারা এলাকায় হয়ে উঠেছেন অনুকরণীয় গল্প। জন্ম থেকে অদ্যাবধি চলমান জীবনের ঘানি টানতে টানতে অনেকটা ক্লান্ত হলেও সফলতার প্রাপ্তিঘেরা জীবনকে অনেকটা স্বার্থক বলেই অভিহিত করেন এই পাঁচ জয়িতা। কথোপকথনে বেরিয়ে এসেছে তাদের জীবনের নীরব সংগ্রামের ইতিহাস।

সারমিন আক্তার : এক এক করে স্বপ্নগুলো যখন বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করছিল, তখন বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো আবির্ভাব হয় আমার স্বামীর আসল রূপ। যখন শুনতে পেলাম আমাকে না জানিয়ে সে দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম। কিন্তু পারলাম না, পরাজিত জীবনে পরাজয়ের স্বাদ নিয়েই শুধু চোখের পানি ঝরালাম। ১৯৯৩ সালে জন্ম নেয়া উপজেলার ওমরপুর গ্রামের কৃষক পরিবারের মেয়ে সারমিন আক্তার এভাবেই তার জীবনের অতীত স্মৃতিচারণ করেন। বাবা-মার প্রথম আদরের কন্যা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া সারমিন এমএসএস পর্যন্ত লেখাপড়া করে আর বেশি দূর এগুতে পারেনি। মাত্র ২০ বছর বয়সে পার্শ্ববর্তী হোমনা কালিকাপুর গ্রামে এক ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আর্থিক সংকটে থাকা স্বামীকে ব্যবসা করতে বাবার বাড়ি থেকে একাধিকবার টাকা দিয়েও স্বামীকে ব্যবসায় বসাতে পারেনি। বরং সেই টাকায় নেশার আসরের মাতলামিটা বাড়িয়ে দিয়েছিল বলেই তার অভিযোগ। কিছু বলতে গেলেই ঘোর অন্ধকারে চার দেয়ালের মধ্যে নেমে আসত বেদম প্রহার। একথাগুলো বলতে গিয়ে সারমিন আক্তার তার স্বামীর নামটি পর্যন্ত মুখে আনতে চায়নি। একদিন হঠাৎ জানতে পারলেন তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। কোনো কালক্ষেপণ না করে, পাড়ি জমান বাবার বাড়িতে। বুকের ভেতর কষ্ট লালন করে জীবনের বাকিটা পথ পাড়ি দিতে গবাদী পশু ও হাঁস-মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্তমানে একাই পথ চলছে। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু হওয়া সারমিন আক্তার বলেন, আমার জীবন নিঃস্ব, নির্যাতিত ও দুঃখের সাগরে ভাসমান জীবন। এ জীবনের আঁচ যেন কারো গায়ে না লাগে।

আমিরন বেগম: স্বামীর অসহায়ত্বের কথাগুলো যখন বাবা-মাকে জানাই তখন নিজের ভেতর খুব লজ্জাবোধ হচ্ছিল। বাবা-মা নিরাস করেনি। বিয়ের উপ-ঢৌকনগুলো বিক্রি করে আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে টাকাগুলো হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেদিন বাবা-মায়ের ভালোবাসার প্রতিদান হিসেবে দেহের কাপড়ের আঁচল দিয়ে দু’চোখের জল মুছে ছিলাম। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী ৪৫ বছরের আমিরন বেগম এভাবেই তার স্মৃতিচারণ করেন। অষ্টম শ্রেণি পাস ৪ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জননী আমিরন বেগম হাঁস-মুরগি ও ছাগল পালনের মধ্য দিয়ে আয়ের সূচনা করেন। উপার্জিত অর্থ দিয়ে প্রথম দুটি গাভী কিনে শুরু করলেও বর্তমানে তার একটি নিজস্ব খামার রয়েছে সেখানে বর্তমানে ১২টি গাভী রয়েছে। এসব গাভী থেকে প্রাপ্ত দুধ বিক্রি করে মাসে আয় হচ্ছে ৫০-৬০ হাজার টাকা। কড়িকান্দি বাজারে সন্তানকে দিয়েছেন একটি দোকান। দোকান আর খামারের আয় দিয়েই স্বাচ্ছন্দ্যে চলছে জীবনধারা। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী উপজেলার কড়িকান্দি গ্রামের নিজাম মোল্লার স্ত্রী আমিরন বেগম আরো বলেন, আয়ের টাকাগুলো যখন হাতে আসে, তখন জীবনের অতীত কষ্টগুলো আর মনে পড়ে না। হয়তো রোদ বৃষ্টিতে কষ্ট করেছি বলেই আজ আমি সার্থক।

রত্না আক্তার: ১৯৮৯ সালে যখন আমি জন্মগ্রহণ করি তখন বাবা-মা মন্তব্য করেছিলেন আমি নাকি তাদের ঘরে প্রদীপ হয়ে জন্মেছি। তখন বাবা-মা সখ করে নাম রেখেছিল রত্মা। আজ যখন এলাকার মেয়েদের শিক্ষা দিতে ক্লাসে প্রবেশ করি তখন অনুধাবন করি আসলে আমি উজ্জ্বল প্রদীপ হয়ে আলো ছড়াচ্ছি। এ যে এক চরম পাওয়া; যার অভিমত প্রকাশ করার মতো না। উপজেলার ইঞ্জিনিয়ার হারুন-উর-রশিদ গার্লস কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক রত্না আক্তার এভাবে তার অভিমত ব্যক্ত করেন। রত্মা আক্তার এসএসসি ও এইচএসসির পর ২০১০ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্নাস পাস করেন। ২০১১ সালে এ জয়িতা তিতাসের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ইঞ্জিনিয়ার হারুন-উর-রশিদ গার্লস কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জননী তিনি। রত্না আক্তারের স্বামী বর্তমানে পুলিশ বিভাগের এসআই হিসেবে কর্মরত আছেন। শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী রত্না আক্তার আরো বলেন, বাবা সরকারি চাকরি করতেন তারপরও লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজের খরচের জন্য পাইভেট ও কোচিং করাতাম। হয়তো সেই সুবাদে আজ আমি মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে সমাজে আলোর প্রদীপ ছড়ানোর জন্য এগিয়ে যাচ্ছি।

শারমিন জাহান: আমার স্বামী মো. কামরুজ্জামান একজন সহজ-সরল প্রকৃতির ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী কাজে সারাক্ষণ থাকায় তেমন সংসারে মন দিতে পারতেন না। সংসারটাকে আপন করে নিয়ে ছিলাম বলেই আজ ৬ সন্তানকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি। সফল জননী হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া উপজেলার কলাকান্দি গ্রামের মো. কামরুজ্জামানের স্ত্রী শারমিন জাহান এভাবে তার জীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। ১৯৭৭ সালে জন্মগ্রহণ করা শারমিন জাহানের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএসএস পাস। নিজেকে উচ্চশিক্ষার শীর্ষ আসনে নিতে চাইলেও সময় তাকে থমকে দেয় কিন্তু নিজের সন্তানদের ভেতর তিনি সেই অভাব পূরণটা দেখতে পান। শারমিন জাহানের দৃঢ় প্রচেষ্টায় তার বড় মেয়ে খাদিজা বিনতে জামান এমবিসিএস পাস করে বর্তমানে গাজীপুরে তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গাইনি বিভাগে কর্মরত আছে। দ্বিতীয় মেয়ে আয়েশা বিনতে জামান রাজধানীর মোহাম্মদপুর কলেজের ইংলিশে মাস্টার ও তৃতীয় মেয়ে মানারত ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটিতে অনার্সে (ফার্মাসি) অধ্যয়নরত আছে। চতুর্থ ছেলে নওয়াব হাবিবুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার এসএসসি পাস করেছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ ছেলে বর্তমানে তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসায় ৯ম ও ৭ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। মেধাবী-কঠোর পরিশ্রমী, পরোপকারী-আত্মীয় স্বজনদের প্রতি যত্মশীল, গরিব অসহায় মানুষের প্রতি দয়া-দায়িত্ববোধ, ধর্মীয় অনুভূতি ও দেশপ্রেমের প্রতি অগাদ ভালোবাসা থাকা শারমিন জাহান আরো বলেন, পরিশ্রম আজ আমাকে সার্থক করে তুলেছে। ছেলে-মেয়েদের মানুষের মতো গড়ে তুলতে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

শাহিদা বেগম: স্বামীর উত্তরাধীকার সূত্রে বিষয়-সম্পত্তির মালিক হিসাবে আমি মৌটুপী ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা কমপ্লেক্স ভবন, মাদ্রাসার নিজস্ব মসজিদ, ঈদগাহ ও কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ৮০ শতক জমি দান করেছিলাম। এসব স্থাপনায় যখন ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া ও খেলাধুলা করে তখন আনন্দে বুকটা ভরে যায়। অনেক সময় তাদের দুরন্তপনা দেখলে চোখ দিয়ে পানি ঝড়ে। তখন মনে হয় কি কষ্ট করে আমরা লেখাপড়া করেছি। সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা উপজেলার মৌটুপী গ্রামের সুজাত আলীর স্ত্রী শাহিদা বেগম এ কথাগুলো বলেন। ১৯৬২ সালে অজপাড়াগায়ে জন্মগ্রহণ করা শাহিদা বেগম আরো বলেন, সমাজের উন্নয়নে কাজ করাই আমার জীবনের ব্রত। তাই এলাকায় দরিদ্র দুঃস্থদের মাঝে শীত মৌসুমে শীতবস্ত্র বিতরণ, দরিদ্র মানুষের চিকিৎসাসহ মাদকবিরোধী আন্দোলন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের মতো কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছি।

এ ব্যাপারে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা রেহেনা বেগম বলেন, পুরুষ শাষিত সমাজের সব বাধা ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে জীবন সংগ্রামে নারীরা জয়ী হতে পারে তা-ই প্রমাণ করল এ পাঁচ জয়িতা।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার এটিএম মোর্শেদ বলেন, জীবনের বাধা বিপত্তিকে ঠেলে দৃঢ় মনোবল আর কর্মস্পৃহা নিয়ে কাজ করলে সফলতা অবশ্যই আসবে। জয়িতা সারমিন আক্তার, আমিরন বেগম, রত্না আক্তার, শারমিন জাহান ও শাহিদা বেগম সেটাই প্রমাণ করেছেন। তাদের এ সাফল্য পরবর্তী নারী প্রজন্মকে উৎসাহী করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত