ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চা শ্রমিকের মানবেতর জীবন

চা শ্রমিকের মানবেতর জীবন

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের শমসেরনগর চা বাগানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জীবনের পঁচিশটি বছর পার করেছেন রাজকুমারী বিন। এই বাগানের শ্রমিক ছিলেন তার বাবাও। বাবা অসুস্থ হলে বাগানের কাজ ধরেন তিনি। কিন্তু বয়স বাড়ায় আর কাজে যেতে পারেন না এখন। তার জায়গায় কাজে যোগ দিতে হয়েছে তার ভাইকে। কারণ, চা বাগানের নিয়ম অনুযায়ী বাগানে যদি একটি পরিবার থেকে ন্যূনতম একজন শ্রমিক কাজ না করেন, তবে তারা হয়ে যাবেন গৃহহীন। বসবাস করতে পারবেন না বাগানের বসতঘরে। শমসেরনগর চা বাগানে গিয়ে দেখা গেল রাজকুমারী বিন বাগানের কাঁচা পাতা সংগ্রহ করছেন। সেগুলো দিয়ে ভর্তা তৈরি করে দুপুরের খাবার খাবেন।

পাতা তুলতে তুলতে তিনি বলেন, অনেক বছর তো আমি কাজ করলাম। আগে মজুরি কম ছিল। এখন মজুরি কিছু বাড়ছে। তবে এ মজুরি দিয়ে আমাদের পোষায় না। আমাদের দেশে ১৭০ টাকায় আট ঘণ্টা কাজ করে দেবে এমন কেউ আছে? এটা তো মানায় না। কিন্তু আমরা তো বান্ধা পড়ে গেছি। না আমরা শিক্ষার দিকে আগাতে পারি, না জমি কিনে ঘরবাড়ি বানাতে পারি। সূর্যের দিকে যেভাবে তাকানো যায় না। আমাদের জীবনেও ওরকম, জীবনের দিকে তাকাতে পারি না। এটা সবাই জানে কিন্তু কেউ চোখ দিয়ে দেখে না। শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁও বাগানের চা শ্রমিক শীত কুমার রিকিয়াসন ও যমুনা রিকিয়াসন। তাদের তিন মেয়ে। শীত কুমার রিকিয়াসন কাজ করেন শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁও চা-বাগানে। ১৫ ফুট দৈর্ঘ্য আর ৬ ফুট প্রস্থের একটি ঘরের এক পাশে মাটির ওপর পাটি বিছিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন সবাই। আর অন্য পাশে থাকে তাদের পালিত গরু। গরু রাখার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৪ ফুট দৈর্ঘ্য আর ৩ ফুট প্রস্থের জায়গা। তার পাশেই পানির পাত্র আর রান্নার জন্য দুই-তিনটি হাঁড়িপাতিল। ঘরে উল্লেখ করার মতো আসবাবপত্র বলতে আছে তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ার।

শমসেরনগর চা বাগানের শ্রমিক সীমা আক্ষেপ করে বলেন, চা-বাগানের শ্রমিক হওয়ার জন্যই যেন আমাদের জন্ম। আমার মা-বাবা বাগানে কাজ করছেন। আমরা করছি। আমার সন্তানরাও করবে। সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে যে অন্য পেশায় পাঠাব, সেই ক্ষমতা তো আমাদের নেই। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া ও জুড়ীর চা শ্রমিকদের থাকার জায়গাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ শ্রমিকের বসবাস মাটির তৈরি ঘরে। ঘরের ওপরে কোনো কোনোটিতে শুকনো খড়ের আস্তরণ, আর কোনোটিতে টিন দেওয়া। অনেক ঘরেই খড় আর টিনের ফুটো দিয়ে আকাশ দেখা যায়। এসব কক্ষে তিন থেকে সাতজন গাদাগাদি করে থাকেন। অনেক কক্ষে আবার গৃহস্থের সঙ্গে গরু-ছাগলেরও বসবাস রয়েছে।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের বালিশিরা ভ্যালি ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক কর্ণ তাঁতি বলেন, স্থায়ী চা শ্রমিকরা সব কাজেই পান ১৭০ টাকা। অস্থায়ী চা শ্রমিকরা শুধু পাতা তোলার জন্য ১৭০ টাকা আর অন্য কাজের জন্য ১২০ টাকা বা এর কম পান। আমরা বারবার প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয়নি। যুগ যুগ ধরে কাজ করেও আমরা চা শ্রমিকরা বসতঘরের নিশ্চিয়তা পাই না। বাংলাদেশ চা শিল্প ২০১৯-এর তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ১৬৬টি চা বাগান রয়েছে। এসব বাগানে ১ লাখ ৩ হাজার ৭৪৭ জন স্থায়ী শ্রমিক এবং ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন অস্থায়ী শ্রমিক রয়েছেন। আর এসব শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা ৪ লাখ ৭২ লাখ ১২৫ জন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত