দেড় হাজার বছরের প্রাচীন নিদর্শন মহারাজা দিঘি

প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এসকে দোয়েল, পঞ্চগড়

উত্তরের পর্যটন নগরী হিমালয়কন্যা পঞ্চগড়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসহ হাজার বছরের প্রাচীন নিদর্শনের মধ্যে ইতিহাস হয়ে আছে পঞ্চগড়ের দেড় হাজার বছরের প্রাচীন মহারাজা দিঘি। দিঘিটি দেখতে বছরের সব সময় ছুটে আসে হাজার হাজার দর্শনার্থী। ত্রি-সীমান্ত জেলা হিসেবে পর্যটনের অংশ হয়ে উঠেছে এ প্রাচীন দিঘি। পাঁচগড়ের একটি গড় ভিতরগড়। এ ভিতরগড়ে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ দুর্গ নগরী। এ দুর্গ নগরীতে রাজপ্রাসাদ ছিল পৃথু রাজার। এটি ছিল জলেশ্বর রাজার রাজধানী। ‘কামরুপ বুরুঞ্জি’তে রাজা জলেশ্বরকে বলা হয়েছে পৃথু রাজা হিসেবে। পৃথু রাজা রাজত্ব পরিচালনার সময় ভিতরগড়ে নির্মাণ করেছিলেন রাজপ্রাসাদ, মন্দির ও খনন করেছিলেন সুবিশাল দিঘি। তার নামানুসারে এ দিঘিটির নাম মহারাজা দিঘি। দিঘিটি বিশাল আয়তনের একটি পুকুর বা জলাশয়। প্রায় ৩৩ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত এ মহারাজা দিঘি। এর পাড়সহ আয়তন প্রায় ৮০০ থেকে ৪০০ গজ। পাড়ের উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। অধিক গভীরতার কারণে দিঘিটির জল অনেক স্বচ্ছ। রয়েছে ইট বাঁধানো ১০টি ঘাট। ঘাটের উভয় পাশে ইট ও মাটি দিয়ে নির্মিত সুউচ্চ পাড় নৈসর্গিক দৃশ্যের এক অসাধারণ নিদর্শন। পৃথু রাজা একদিন কীচক নামক এক নিম্ন শ্রেণির লোকের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়। তখন তিনি ধর্ম নাশের ভয়ে উক্ত দিঘিতে আত্মহনন করেছিলেন। ইতিহাসবিদের মতে, সেসময় ভিতরগড় দুর্গ নগরীর বাইরের আবেষ্টনীর উত্তরাংশ, উত্তর-পশ্চিমাংশ এবং উত্তর-পূর্বাংশ বর্তমানে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত হওয়ায় ধারণা করা হয় যে, ষষ্ঠ শতকের শেষে কিংবা সপ্তম শতকের শুরুতে ভিতরগড় একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রাচীন বাণিজ্য সড়ক ও নদীপথের উপর অবস্থিত হওয়ায় ভিতরগড় এলাকার অধিবাসীরা সম্ভবত নেপাল, ভুটান, সিকিম, আসাম, কুচবিহার, তিব্বত, চীন, বিহার এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল। বহুকাল ধরেই এ দিঘি ঘিরে রয়েছে স্থানীয়দের নানান বিশ্বাস। পারিবারিক জীবনে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এ দিঘিতে কোনো মানত করলে ভালো ফল মিলে। এ বিশ্বাসে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানত করতে নানান সামগ্রী নিয়ে ছুটে আসেন। কোনো বিয়েশাদির আয়োজন করলে এ দিঘির পাড়ে গিয়ে থালা-বাসনের কথা বললে অদৃশ্যভাবে প্রয়োজন মতো চলে আসত প্রত্যাশিতভাবে চলে আসত থালা-বাসন। সেসব থাল-বাসন ব্যবহারের পরে পরিষ্কার করে ফেরত দিতে হত। স্থানীয় ৭০-এর বেশি বয়সি অসিমদ্দিন বলেন, ১৯৫৯ সাল থেকে এ ভিতরগড়ে বসবাস করছি। তখন তো অনেক ঝাড়-জঙ্গল ছিল। দিঘিটা নিয়ে অনেক গল্প রয়েছে। তার মধ্যে অনেকে বিয়েশাদির সময় এখানে এসে থালাবাসনের কথা বললে তা আশ্চর্যভাবে চলে আসত। পরে তা ব্যবহারের পর পরিষ্কার করে আবার পুকুরেই দিয়ে যেতে হয়। চৈত্র মাসে হিন্দুদের স্নান হয়। বৈশাখ মাসে মেলা বসে। পুকুরের পানি কখনো ঘোলা হয় না, খুব পরিষ্কার। বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সময় স্থানীয় আবু সাঈদ টুকু জানান, এ পুকুরের অনেক ইতিহাস ভাই। এখানে সময় কাটাতে মাছ ধরতে আসি। খুব ভালো লাগে এখানে আসলে। একদিনের চুক্তিতে ৩ হাজার টাকা দিয়ে মাছ ধরতে বসি। পুরো দিনটাই মাছ ধরার সঙ্গে পুকুরের সৌন্দর্যও উপভোগ করি। পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুদুল হক বলেন, মহারাজা দিঘি একটি পঞ্চগড় জেলার অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন দিঘি। কালের বিবর্বতনে ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের যে ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয় তা হচ্ছে এ দিঘি। এখানে আমাদের যে একটি গড় রয়েছে, ভিতরগড়। এই ভিতরগড়ের সামগ্রিক বিষয়টি পর্যটকদের আকর্ষণ করছে। এ পুকুরের চারপাশের সবুজের সমারোহ প্রকৃতির সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলেছে। যা পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ছে। তাই পর্যটকদের কথা চিন্তা করে এরই মধ্যে এখানে রাস্তা উন্নয়ন করা হয়েছে। পর্যটকরা যাতে দুই পারে ঘুরতে পারে সে জন্য চলাচল ব্যবস্থা ও উন্নতমানের শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে। আর সামগ্রীক উন্নয়নমূলক কাজ চলমান রয়েছে।